1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আসন সংরক্ষণ থেকে তিন তালাক, আশা নিরাশার কাহিনি

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড়
২৫ এপ্রিল ২০২৫

খাতায়-কলমে তো সবই থাকে। নারীদের সমানাধিকার, নারীদের সম্মান, সুরক্ষা, প্রতিনিধিত্ব দেয়ার ব্যবস্থা সবকিছুই তো আইনে আছে। কিন্তু আইনি ব্যবস্থা ও বাস্তব অবস্থার মধ্যে যে বিস্তর ফারাক, সেটা প্রতিদিনই নারীরা বুঝতে পারেন।

ন্যাশনাল ব্যুরো অফ ক্রাইম রেকর্ডসের তথ্য অনুযায়ী, ভারতে প্রতি এক লাখ মেয়ের মধ্যে গড়ে ৬৬ জনেরও বেশি মেয়ে অপরাধের শিকার হয়ছবি: Anushree Fadnavis/REUTERS

মালদহের চর দিয়েই শুরু করা যাক। গঙ্গা তার পাড় ভাঙে, মাটি, বালি বয়ে নিয়ে আসে, তৈরি করে চর।  বিশাল বিশাল চর। এমনই এক চরের নাম বানুটোলা। গত শীতের সকালে সেখানে গিয়েছিলাম চরের জীবন দেখতে। ধুলোময় রাস্তার ধারে মেয়েকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন এক নারী ও তার সঙ্গীরা। আমার মেয়ের প্রশ্নের জবাবে জানালেন, তার বয়স ২৫ বছর। ইতিমধ্যেই তিনটি সন্তান হয়েছে। আমার মেয়ের বয়সও তাই।  সে বললো, এখন আর বাচ্চা করো না। পাশ থেকে আরেক নারী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ''আমরা কি আর শখ করে করি? বাচ্চা করতে হয়। আমাদের ইচ্ছে-অনিচ্ছের কোনো দাম নেই।''

নারী স্বাধীনতা, সমানাধিকার, ম্যারিটাল রেপ, গার্হস্থ সহিংসতা নিয়ে আইন তো কম নেই। আদালতের কঠোর নির্দেশ আছে। কিন্তু তারপরেও কি অধিকাংশ নারী নিজের ইচ্ছেয় কিছু করতে পারে, মালদহের চরে তো নয়ই, গোটা পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতের কোথাও কতজন তা পারে? চরের ধুলোমাখা পথে এগিয়ে যাই। অল্পবয়সী কিছু মেয়ে বিড়ি বাঁধার কাজ করছে। আমার সফরসঙ্গী ও চর বিশেষজ্ঞ হাবিব প্রশ্ন করলেন, কার সদ্য বিয়ে হয়েছে রে? অন্যরা একটি অল্পবয়সি মেয়েকে দেখিয়ে দিলো। হাবিব প্রশ্ন করলেন, বর কতটা মারে? একটু হেসে মুখ নিচু করলো মেয়েটি, যার মুখ দেখে মনে হয়নি তার বিয়ে করার বয়স হয়েছে। তার ভঙ্গিই বুঝিয়ে দিচ্ছিলো, মারধরকে আমল দিলে চলে না। ওটা জীবনধারণের অঙ্গ।

মনে পড়ে গেলো ন্যাশনাল ব্যুরো অফ ক্রাইম রেকর্ডস-এর তথ্য। ২০১৮-র তুলনায় ২০২২ সালে মেয়েদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রায় ১৩ শতাংশ বেড়েছে। ভারতে প্রতি এক লাখ মেয়ের মধ্যে গড়ে ৬৬ জনেরও বেশি মেয়ে অপরাধের শিকার হয়। দিল্লি, হরিয়ানা, তেলেঙ্গানা, রাজস্থান, ওড়িশা, অন্ধ্র, পশ্চিমবঙ্গ-সহ ১৩টি রাজ্যে মেয়েদের বিরুদ্ধে অপরাধের পরিমাণ জাতীয় গড়ের তুলনায় অনেক বেশি।  আর এই অপরাধের মধ্যে ৩১ শতাংশের বেশি হলো স্বামী ও শ্বশুরবাড়িতে মানুষদের হাতে নারীর নিগ্রহ, ১৯ শতাংশ হলো অপহরণ,  প্রায় ১৯ শতাংশ হলো নানা ধরনের নির্যাতন। ভারতে প্রতিদিন অন্তত ৮৬ জন নারী ধর্ষণের মুখে পড়ে। ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার পরেও আরজিকর কাণ্ড হয়। ধর্ষণ হতেই থাকে।

তিন তালাক বন্ধের পর

আইন থাকে, প্রতিবছরই নতুন করে আইন হয়। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন হয় কি?

২০১৯ সালে তিন তালাক বন্ধ করে আইন পাস হয় ভারতের সংসদে। তার চার বছর পর ২০২৩ সালে নাজিমা পারভিন ইন্ডিয়া টুডে-তে একটা নিবন্ধ লেখেন। তিনি তিল তালাক আইন ও মুসলিম নারীদের সামাজিক অবস্থা নিয়ে গবেষণার জন্য দিল্লি ও হায়দরাবাদে ফিল্ডওয়ার্ক করেছেন। তার সেই ফিল্ডওয়ার্কের  অভিজ্ঞতা বলছে, তিন তালাক আইন নিয়ে মামলার জন্য এফআইআর করা এবং মুসলিম পুরুষদের স্ত্রীকে ছেড়ে দেয়া ও গ্রহণ না করার সমস্যা আদতে  ভয়ংকর জায়গায় পৌঁছেছে।

নাজিমা জানাচ্ছেন, তিন তালাক আইন অনুসারে, পুলিশকে দিয়ে এফআইআর করানোটাই খুব কঠিন বিষয়। তিনি তানভীরের কথা জানিয়েছেন, যিনি তিন তালাক আইন অনুসারে মুসলিম মেয়েদের ন্যায় দেয়ার চেষ্টা করেন। তার কাছে প্রচুর নারী অভিযোগ নিয়ে আসেন। প্রবলভাবে সক্রিয় থেকেও তানভীর খুব বেশি এফআইআর করাতে পারেননি।

নাজিমা জানিয়েছেন, হায়দরাবাদের অবস্থা আরো ভয়াবূহ। সংক্ষেপে বলতে গেলে, তিন তালাক বলে নারীদের বিবাহ বিচ্ছেদ করা হচ্ছে না। বরং তাদের উপর প্রবল অত্যাচার করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, হয় তারা বাড়ি ছেড়ে চলে যাক, নাহলে এই অত্যাচার সহ্য করুক। অনেক মেয়েই এই অত্যাচারের পর স্বামীর ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। সেই স্বামী এইভাবে স্ত্রীকে পরিত্যাগ করছে। শাহিন উইমেনস রিসোর্স অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন হায়দরাবাদে দুই হাজার ১০৬টি ঘরে সমীক্ষা করে দেখেছে, ৬৮৩ জন নারীকে স্বামী পরিত্যাগ করেছে। তিন তালাক আইন চালুর পর এই সংখ্যা হুহু করে বেড়েছে।

গত ২৯ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে জানতে চেয়েছে, সারা দেশে তিন তালাক আইন অনুসারে কতগুলি এফআইআর করা হয়েছে।

বেশ কিছু মুসলিম পুরুষ এই মামলা করেছেন। তারা দাবি করেছেন, এই আইনকে হাতিয়ার করে মুসলিম পুরুষদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রোশ চরিতার্থ করা হচ্ছে। অন্য ধর্মের ক্ষেত্রে এই ধরনের ঘটনাকে অপরাধ বলে গণ্য করা হয় না। তাহলে মুসলিমদের ক্ষেত্রে কেন হবে? প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না জানিয়েছেন, তিন তালাক বেআইনি। এখন প্রশ্ন হলো, এটা অপরাধ কিনা। সেটা তারা বিবেচনা করবেন।

কেন্দ্রীয় সরকার তথ্য দিলে এই বিষয়ে ছবিটা স্পষ্ট হবে।

সংসদে, বিধানসভায় আসন সংরক্ষণ

দীর্ঘদিন ধরে দাবি করার পর ২০২৩ সালে ভারতে লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভায় মেয়েদের জন্য ৩৩ শতাংশ আসন সংরক্ষণ করতে সংবিধান সংশোধন আইন পাস হয়েছে। তবে এখনো সেই সংরক্ষণ চালু হয়নি। বলা হয়েছে, এই আইন হওয়ার পর যে প্রথম জনগণনা হবে, তার ভিত্তিতে লোকসভার আসনগুলির সীমা পুনর্নিধারণ করা হবে। তখন এই সংরক্ষণ চালু হবে।

কিন্তু এখানেও জটিলতা কম নেই। এই জনগণনার পর লোকসভার আসনসংখ্যা বাড়ার কথা। ২০০১ সালে ঠিক হয়েছিল, আগামী ২৫ বছর লোকসভার আসনসংখ্যা বাড়বে না। এই সিদ্ধান্তের কারণও ছিল। লোকসভার আসন ঠিক হয় জনসংখ্যার নিরিখে। দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে অনেক এগিয়ে। কিন্তু গোটা উত্তর ভারত ও পূর্ব ভারতের কিছু রাজ্য জনসংখ্য়া নিয়ন্ত্রণে অনেক পিছিয়ে। ফলে দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে লোকসভার আসন খুব বেশি বাড়বে না। উত্তরপ্রদেশের মতো উত্তর ভারতের রাজ্য ও বিহারের মতো পূর্ব ভারতের রাজ্যে লোকসভার আসন অনেক বেড়ে যাবে। ফলে লোকসভায় ওই রাজ্যগুলির প্রভাব বেড়ে যাবে। তাই তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিনের নেতৃত্বে দক্ষিণের রাজ্যগুলি একজোট হয়ে দাবি করেছে, লোকসভার আসন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখতে হবে।

ফলে আরেকটা অনিশ্চয়তা রয়েছে। লোকসভা আসনের সংখ্যা বাড়বে নাকি বাড়বে না? যদি না বাড়ে তাহলে কি পরবর্তী জনগণনার ভিত্তিতে বর্তমান আসনের সীমা নির্ধারণের পর এক তৃতীয়াংশ আসন মেয়েদের জন্য সংরক্ষিত হবে? সেই সংরক্ষণ কি ২০২৯ সালে চালু হবে, নাকি সংরক্ষণ চালু করতে ২০৩৪ লেগে যাবে? আবার মনে পড়ে গেলো প্রয়াত নেতা ও মন্ত্রী প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির কথা। সংসদ ভবনে নারীদের আসন সংরক্ষণের দাবিতে বিল পাস করার নারী সাংসদরা আওাজ তুলেছেন। সেখানে সোনিয়া গান্ধী, সুষমা স্বরাজ থেকে শুরু করে সব দলের নারী সাংসদরা আছেন। তাদের বিক্ষোভ দেখছি। হঠাৎ পিঠে টোকা। ঘুরতেই দেখি প্রিয়রঞ্জন দেশমুন্সি। বললেন, ''কী রে, আমাদের মৃত্যুবান হবে কিনা দেখছিস? লিখে রেখে দে হবে না।'' সেই বিল তো আইনে পরিণত হয়েছে। তখন আশা করব, ২০২৯ সালেই নারীদের জন্য় ৩৩ শতাংশ আসন সংরক্ষণ চালু হবে।

ভারতে পুরসভা ও পঞ্চায়েতে ৫০ শতাংশ আসন মেয়েদের জন্য সংরক্ষিত। এর ফলে বিপুল সংখ্যক নারী পঞ্চায়েত ও পুরসভার সদস্য হয়েছেন, প্রধান হয়েছেন।

এটা বলার পরেই পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের একটা ছোট শহরে পুরসভার কথা মনে পড়লো। সেখানে জনপ্রিয় এক চিকিৎসক আগে পুরসভার মেয়র ছিলেন। পরে তার আসন মেয়েদের জন্য সংরক্ষিত হওয়ায় স্ত্রীকে দাঁড় করান। তিনি জেতেন এবং মেয়র হন। তারপর আসলে সব সিদ্ধান্ত নেন ওই চিকিৎসকই। স্ত্রীও তার স্বামীর কথার অন্যথা করেন না। 

পুরুষদের চরিত্র তো চট করে বদলায় না। তারা তাদের স্ত্রীদের পিছন থেকে নিয়ন্ত্রণ করার, সিদ্ধান্ত নেয়ার চেষ্টা করবেই। আশার কথা একটাই, অন্তত ঘরের বাইরে গিয়ে মেয়েরাও সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। আজ হোক বা কাল, তারা তাদের ন্যায্য অধিকার প্রয়োগ করবেনই। সেটাই আশার কথা।

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ