দেখলে মনে হবে পুরানো আমলের ভিন্টেজ গাড়ি, কিন্তু আকারে ছোট৷ গ্র্যাভিটি রেসার নামের এই নকলের সঙ্গে আসলের মিল চোখে পড়ার মতো৷ জার্মানিতে এক ব্যক্তি সৃষ্টির এই কাজে বেশ নাম করেছেন৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানির গ্র্যাভিটি রেসার
03:51
দেখতে সযত্নে সাজিয়ে রাখা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের ভিন্টেজ গাড়ির মতো হলেও আসলে ২০১৭ সালে এই গ্র্যাভিটি রেসার তৈরি করা হয়েছে৷ ইয়ুলিয়া ও কারলটা হাস নামের দুই বোন এই গাড়ির মালিক৷ তাদের মতে, ‘‘শিশু বয়সেই গাড়ির মালিক হতে আমাদের দারুণ লাগে, হোক না সে ছোট গাড়ি৷ তবে গাড়ি চালানোর অনুমতি পেয়ে খুব ভালো লাগে৷ প্রতিবারই মনে হয় নতুন অভিজ্ঞতা৷''
ইঞ্জিন থাকায় গাড়িটির আকর্ষণই আলাদা৷ দুই বোনের এই দুই সিটের গাড়িটি হাতে তৈরি করা হয়েছে, তাই একেবারে অনবদ্য৷ যুদ্ধের আগে ব্রিটেনের ‘লাগন্ডা রেপিয়ে' নামের মডেলের সঙ্গে এর মিল রয়েছে৷ তাদের বাবা ক্রিস্টিয়ান হাস ভিন্টেজ গাড়ির অনুরাগী৷ তিনি চান, ইয়ুলিয়া ও কার্লটা তাঁর এই গাড়ির নেশা চালিয়ে যাক৷ তিনি বলেন, ‘‘আমার অনেক আশা৷ আমি দুই মেয়েকে নিয়ে ভিন্টেজ কার ব়্যালি দেখতে প্রায়ই ন্যুরবুর্গরিং-এ চলে যাই৷ বউয়ের সঙ্গে এমন প্রতিযোগিতায় অংশও নিই৷ মেয়েরাও ভবিষ্যতে বাবার এই হবি চালিয়ে যাবে বলে আমি আশা করি৷''
জার্মানরা আজও যে সব গাড়ি নিয়ে পাগল...
এই সব মডেলের গাড়ি দেখে গাড়ি প্রেমিকদের চোখে আজও জল আসে৷ ফল্কসভাগেন থেকে বিএমডাব্লিউ, ওপেল থেকে মার্সিডিজ বেঞ্জ অবধি জার্মান গাড়ি নির্মাতারা নানা ‘কাল্ট মডেল’ তৈরি করেছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Kneffel
ফল্কসভাগেন বিটল (১৯৩৮)
এক কথায় ‘ওল্ড ফেইথফুল’৷ সর্বসাকুল্যে দু’কোটি দশ লাখের বেশি বিটল তৈরি হয়েছে৷ ফল্কসভাগেন বিটল সম্ভবত বিশ্বের প্রখ্যাততম মোটরগাড়ি৷ ১৯৩৮ থেকে ২০০৩ সাল অবধি বিটল-এর ডিজাইন বিশেষ বদলায়নি৷ ‘হার্বি’ ফিল্মটার কথা মনে করুন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ফল্কসভাগেন টি-ওয়ান (১৯৫০)
...বলতে বোঝায় ফল্কসভাগেন ক্যাম্পার ভ্যান, যা হিপি আন্দোলনের সময় খুব জনপ্রিয় হয়েছিল৷ জার্মানরা এর নাম দিয়েছিলেন ‘বুলি’৷ সে-যাবৎ এক কোটির বেশি ফল্কসভাগেন বাস বিক্রি হয়েছে, যার মধ্যে টি-ওয়ান মডেলের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৮ লাখ৷
ছবি: DW/M. Reitz
মেসারস্মিট কেবিন স্কুটার (১৯৫৩)
মেসারস্মিট যে আদতে এয়ারোপ্লেন তৈরি করত, তিন চাকার এই এয়ায়োডাইনামিক গাড়িটির চেহারা দেখলেই তা বোঝা যায়৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিমান তৈরি বন্ধ হয়ে যায়, কাজেই মেসারস্মিট কিছুদিন ইঞ্জিনিয়ার ফ্রিটৎস ফেন্ড-এর সঙ্গে ‘ফ্লিটৎসার’ গাড়ির মডেলটি নিয়ে কাজ করে৷ তবে ১৯৫৬ সালের মধ্যেই মেসারস্মিট আবার বিমান উৎপাদনে ফেরে৷
ছবি: picture alliance/dpa/H. Galuschka
মার্সিডিজ ৩০০ এসএল (১৯৫৪)
গাড়িটার ডাকনাম হয়েছিল ‘গালউইং’ বা ‘গাঙচিলের পাখা’, কারণ দরজাগুলো ঠিক সেভাবেই ওপরের দিকে খুলত৷ ৩০০ এসএল সিলভার অ্যারো রেসিং কার-গুলো থেকেই মার্সিডিজ বেঞ্জ আবার মোটর রেসিং-এ ফেরে৷ লে মান্সের ২৪ ঘণ্টার মোটর দৌড় আর ক্যারেরা প্যানঅ্যামেরিকানা রেসিং ইভেন্টে জেতার পর ৩০০ এসএল গাড়ির একটি রাস্তায় চলা ও চালানোর মতো মডেল বার করা হয়৷
ছবি: Daimler AG
বিএমডাব্লিউ ইসেটা (১৯৫৫)
১৯৫৫ থেকে ১৯৬২ সাল অবধি ভালোই রোজগার করেছে বিএমডাব্লিউ এই ‘বাবল কার’ বা ‘বুদবুদ গাড়ি’-টি তৈরি করে৷ সস্তার কিন্তু কাজের এই মিনিগাড়িটিতে একটি মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন লাগানো ছিল৷ খুলতে হতো সামনে, ঠিক একটা ফ্রিজিডেয়ারের মতো৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Kneffel
পোর্শে নাইন-ইলেভেন (১৯৬৩)
ভাবলেই আশ্চর্য লাগে, পোর্শে ৯১১ স্পোর্টিং মডেলটি চলে আসছে ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে! মোটরগাড়ির ইতিহাসে খুব কম মডেলই এতদিন ধরে চলে৷ তার উঁচু করা হেডলাইট আর পিছনদিকে নীচু বুট দেখলেই নাইন ইলেভেনকে চেনা যায়৷
ছবি: picture-alliance//HIP
মার্সিডিজ বেঞ্জ ৬০০ (১৯৬৪)
টেলিফোন, এয়ার কন্ডিশনিং আর ফ্রিজ লাগানো এই জার্মান লাক্সারি সেডানটি সত্তর আর আশির দশকে পোপ থেকে শুরু করে জন লেনন অবধি সেলিব্রিটিদের খুব প্রিয় ছিল৷ এমনকি ১৯৫৫ সালে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ যখন রাষ্ট্রীয় সফরে জার্মানিতে আসেন, তখন জার্মান সরকার মাননীয় অতিথির জন্য একটি মার্সিডিজ বেঞ্জ ৬০০ ভাড়া করেছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ট্রাবান্ট ৬০১ (১৯৬৪)
ফল্কসভাগেন বিটল পশ্চিম জার্মানিতে যা ছিল, পূর্ব জার্মানিতে ট্রাবান্ট ৬০১ ছিল ঠিক তাই৷ প্লাস্টিকের বডি আর টু-স্ট্রোক ইঞ্জিন সংযুক্ত এই ‘ট্রাবি’ ছিল এক হিসেবে পূর্ব জার্মানির প্রতীক৷ আজও প্রায় ৩৩,০০০ ‘ট্রাবি’ জার্মানির পথেঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷
ছবি: Imago/Sven Simon
ভার্টবুর্গ ৩৫৩ (১৯৬৬)
আইসেনাখ শহরের কাছে ভার্টবুর্গ দুর্গ, তারই নামে নাম রাখা হয়েছিল পূর্ব জার্মানির এই দ্বিতীয় আইকনিক গাড়িটির৷ তৈরি হতো প্রধানত রপ্তানির জন্য, যেমন হাঙ্গেরি অথবা ব্রিটেনে৷ তবে পশ্চিম জার্মানিতে ভার্টবুর্গ গাড়ির বিশেষ চাহিদা ছিল না৷
ছবি: picture-alliance/ZB/J. Wolf
ওপেল মান্টা (১৯৭০)
সৃষ্টি হয়েছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য একটি স্পোর্টস মডেল হিসেবে – পরে সেটাই জার্মানির ‘ইয়ং ম্যান’-দের কাছে অভীপ্স বস্তু হয়ে দাঁড়ায়৷ মান্টা চালকদের নিয়ে জার্মানিতে অসংখ্য রসিকতা আছে: বিশেষ করে মান্টা চালকদের বুদ্ধি – অথবা তার অভাব নিয়ে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ফল্কসভাগেন গল্ফ (১৯৭৪)
১৯৭৪ সালে ফল্কসভাগেন কোম্পানি তাদের প্রথম গল্ফ মডেল বার করে – সুবিখ্যাত বিটল গাড়ির উত্তরসূরি হিসেবে৷ কমপ্যাক্ট হলেও, গল্ফ ছিল বেশ ‘স্পোর্টি’ আর তেলও খেতো কম – যা সত্তরের দশকের ‘অয়েল ক্রাইসিসে’ খুবই কাজে লেগেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
11 ছবি1 | 11
স্পোর্টস কারের ইতিহাসে বুগাটি ২৪ মডেলের তুলনা কম৷ সেটির প্রতি সম্মান জানাতে বাবা যে গ্র্যাভিটি রেসার আনিয়েছিলেন, দুই মেয়ে সেটি নিয়ে ঝগড়া শুরু করে দেয়৷ তাই বাবা দ্বিতীয় একটি গ্র্যাভিটি রেসার অর্ডার করেছিলেন৷ ১৯৩৮ সালের বেন্টলি মডেলের অবিকল নকল সেটি৷ ক্রিস্টিয়ান হাস বলেন, ‘‘সে কালের আসল গাড়ির মতো করেই এগুলি তৈরি করা হয়েছে৷ কাঠের খাঁচার উপর অ্যালুমিনিয়ামের বডি৷ সব খুঁটিনাটি বিষয়ের প্রতি নজর রেখে যে যত্ন নিয়ে এই গাড়িগুলি তৈরি করা হয়েছে, তা সত্যি অবাক করার মতো৷''
জার্মানির বিবুর্গ শহরের ফ্রাংক বানকোনিন এই সব দামি ভিন্টেজ গাড়ির নকল তৈরি করেন৷ এমন সৃষ্টি সত্ত্বেও তিনি অবশ্য ধনী হতে পারেননি৷ কিন্তু তাঁর কাছে সেটা জরুরিও নয়৷ শিশুদের খুশিভরা দৃষ্টি দেখলেই তিনি সন্তুষ্ট হন৷ ফ্রাংক বলেন, ‘‘এমনটা দেখলেই আমি সত্যি খুশি হই৷ সেই লক্ষ্যেই তো গাড়িগুলি তৈরি করা হয়েছে৷ আমি নিজেও সেগুলি চালাতে ভালবাসি৷ কিন্তু শিশুরাও এমন গাড়ি চালাতে পারলে এবং তাতে মজা পেলে সেটাই আমার সবচেয়ে বড় আনন্দের কারণ৷''
২০১২ সালে ফ্রাংক বানকোনিন-এর গ্রামে গ্র্যাভিটি রেসার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছিল৷ মাত্র ১৬ বছর বয়স থেকেই গাড়ি মেরামতি শুরু করার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ফ্রাংক একটি গাড়ি তৈরি করেন৷ তবে জায়গার অভাবে সেটিকে বিক্রি করে দিতে হয়৷ অনেকেই আগ্রহ দেখানোর ফলে গ্র্যাভিটি রেসার তৈরি তাঁর বড় শখ হয়ে দাঁড়ায়৷ ফ্রাংক বলেন, ‘‘যুদ্ধের আগের যুগের গাড়ি আমার খুব প্রিয়৷ সব মডেলই বড় সুন্দর৷ কোনো বাছবিছার নেই, সবই ভালো লাগে৷''
ভিন্টেজ গাড়ির আদলে গ্র্যাভিটি রেসার তৈরি করে ফ্রাংক বেশ নাম করেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘মাথায় এক মৌলিক আইডিয়া থাকে৷ তারপর গাড়ি তৈরির কাজ শুরু করে দিই৷ তৈরির সময়ই গাড়িটি একটা রূপ পেতে থাকে৷ কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকে না৷ শেষ পর্যন্ত কেমন দেখতে হবে, সেই ছবিটা মাথায় থাকে৷ তারপর ঠিক সেইমতো এগোতে হয়৷''
তাঁর তৈরি প্রতিটি গ্র্যাভিটি রেসার অনবদ্য৷ কাঠের পাতের উপর কাঠের খাঁচা বসিয়ে কাজ শুরু হয়৷ তিনি আসল ভিন্টেজ গাড়ির হুবহু নকল তৈরি করে তাক লাগিয়ে দেন৷
রেগিনা নিডেনৎসু/এসবি
প্রতিবেদনটি নিয়ে আপনার কোনো মন্তব্য থাকলে লিখুন নীচের ঘরে৷