রাশিয়া, ইরান ও তুরস্ক আসাদ প্রশাসন ও সিরীয় বিদ্রোহীদের মধ্যে শান্তি আলাপ-আলোচনার উদ্যোগ নিতে চায়৷ মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ মেইসাম বেহরাভেশ-এর মতে এটি একটি অভূতপূর্ব, অনন্য প্রচেষ্টা৷
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলে: গত মঙ্গলবার ইরান, তুরস্ক ও রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা মস্কোয় মিলিত হয়ে সিরিয়ার সর্বাধুনিক পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেছেন৷ দৃশ্যত তাঁরা আসাদ প্রশাসনকে বজায় রাখার ব্যাপারে একমত হয়েছেন৷ এ বিষয়ে আপনার কী মূল্যায়ন?
মেইসাম বেহরাভেশ: এই ত্রিপাক্ষিক বৈঠক অদ্বিতীয় এবং অনন্য, কেননা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব, সিরিয়া সংকটের এই দুই গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারকে বাদ দিয়ে সিরিয়ার ভাগ্য সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে৷ তিনটি দেশেরই বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক সমস্যাকর৷ কাজেই তারা এই সংঘাতে তাদের অবস্থান আরো জোরদার করতে চাইছে, সাধারণভাবে গোটা অঞ্চলেই তাদের অবস্থান আরো জোরদার করতে চাইছে; আলেপ্পো জয়ের ফলে যে গতিবেগ সৃষ্টি হয়েছে, তার সুযোগ নিতে চাইছে৷
মেয়ের ক্যানভাসে যুদ্ধের বিভীষিকা
প্রতিদিন সিরিয়া ছাড়ছে অসখ্য মানুষ৷ আশ্রয় খোঁজা মানুষদের মধ্যে আছে শিশুরা, যারা যুদ্ধের বিভীষিকা নিজের চোখে দেখেছে৷ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে যাত্রা করা তেমনই এক মেয়ে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছে যুদ্ধের ভয়াবহতা৷
ছবি: DW/M.Karakoulaki
বাড়িটা যেমন ছিল
সিরিয়ার এক শরণার্থী মেয়ে কলম আর কাগজ বেছে নিয়েছে তার জীবনের গল্প বলতে৷ এই ছবির ক্যাপশনে সে লিখেছে, ‘‘এটা সিরিয়া, মৃত্যু দূত৷ সিরিয়ার রক্ত ঝড়ছে৷’’ মেয়েটির আঁকা ছবিতে দেখা যাচ্ছে ট্যাঙ্ক থেকে একটি শহরের দিকে গোলা ছোড়া হচ্ছে৷ একইসঙ্গে আকাশ পথে চলছে হামলা৷ ফলে বাড়িগুলো আগুনে পুড়ে যাচ্ছে আর একটি কবরের পাশে দাঁড়িয়ে একজন তা দেখছে৷
ছবি: DW/M.Karakoulaki
মৃত্যু এবং হতাশা
‘‘এটা আমার বাবা, মা এবং পরিবারের - এবং সিরিয়ার সকল পরিবারের কবর,’’ মেয়েটা লিখেছে৷ তার কথায়, ‘‘সিরিয়ার শিশুদের অবস্থা এমন৷’’ তার হাতে থাকা ছবিটিতে তিনটি কবর এবং শুয়ে থাকা কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: DW/M.Karakoulaki
শিশুরা মারা যাচ্ছে
এখানে এজিয়ান সাগরে ডুবে প্রাণ হারানো আয়লান কুর্দির মরদেহ আঁকার চেষ্টা করেছে মেয়েটি৷ তার মৃত্যু গোটা ইউরোপকে নাড়িয়ে দিয়েছিল৷ সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের কারণে শিশুদের চরম দুর্দশা ফুটে উঠেছিল কুর্দির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে৷
ছবি: DW/M.Karakoulaki
‘এটা সিরিয়ার মানুষের আসল ট্রাজেডি’
যুদ্ধ থেকে বাঁচতে গিয়ে হাজার হাজার মানুষ সমুদ্রে ডুবে মারা গেছে৷ অনেক শিশু হারিয়েছে তাদের অভিভাবক৷ অবৈধ পথে সিরিয়া থেকে ইউরোপের উদ্দেশ্যে যাত্রা খুবই বিপজ্জনক৷
ছবি: DW/M.Karakoulaki
থমকে যাওয়া জীবন
গ্রিসের ইডোমেনি শরণার্থী শিবিরে কিছু শিশু ছিল যারা তাদের অভিভাবকের সঙ্গে পুনরায় মিলিত হওয়ার আশায় ছিল৷ তাদের বাবা-মা সীমান্ত বন্ধ হওয়ার আগেই ইউরোপে প্রবেশে সক্ষম হয়েছিল৷ কিন্তু বাকিদের আশা ধীরে ধীরে ক্ষীন থেকে ক্ষীনতর হচ্ছে৷ ছবির ক্যাপশন, ‘‘শিশুদের সব আশা, স্বপ্ন এখন ময়লার বাক্সের মধ্যে আছে৷’’
ছবি: DW/M.Karakoulaki
হারানো স্বপ্ন
‘‘শিশুদের ইউরোপে যাওয়ার স্বপ্ন হারিয়ে গেছে-’’ লিখেছে মেয়েটি৷ তার কথায়, শরণার্থী শিবিরে থাকা অনেক শিশু ইউরোপে শান্তিতে থাকার স্বপ্ন দেখেছিল৷ কিন্তু তারা বুঝতে পেরেছে, সেই স্বপ্ন শীঘ্রই বাস্তব হওয়ার আশা নেই৷
ছবি: DW/M.Karakoulaki
‘তাদের বুঝতে হবে যে তারা শিশু’
দশ বছর বয়সি এই শিশুটির মতো আরো অনেক শিশু ইডোমেনি ক্যাম্পে রয়েছে৷ মানবাধিকার সংগঠনগুলো মনে করে, শরণার্থী শিবিরে শিশুদের দিকে আলাদাভাবে খেয়াল রাখা হচ্ছে না৷
ছবি: DW/M.Karakoulaki
7 ছবি1 | 7
আসাদ প্রশাসনের আলেপ্পো জয়ের ফলে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে সৌদি আরব ও কাতারের মতো ‘খেলোয়াড়রা’ তাদের গুরুত্ব হারিয়েছে৷ অপরদিকে হোয়াইট হাউসে নতুন নেতৃত্ব গদি নেবার আগে সিরিয়া সংঘাতের সাধারণ রূপরেখাটা নির্দ্দিষ্ট করে দেওয়ার প্রচেষ্টা বাকি সব ‘খেলোয়াড়ের’৷ এক্ষেত্রে ইরান আর রাশিয়ার পছন্দসই সিনারিও হলো, আসাদ ক্ষমতায় বজায় থাকবেন ও সিরিয়ার রাজ্যাঞ্চলমূলক অখণ্ডতা ক্ষুণ্ণ হবে না৷
তুরস্ক এযাবৎ সিরিয়ায় ইসলামি বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলিকে সমর্থন করে এসেছে, ইরান ও রাশিয়া যে গোষ্ঠীগুলির বিরুদ্ধে রণাঙ্গণে সক্রিয়৷ তিনটি দেশের মধ্যে কি একটি যৌথ কৌশল সৃষ্টি হতে চলেছে?
মস্কো বৈঠকে তুরস্ক বাস্তবিক বিদ্রোহীদের হয়ে অংশগ্রহণ করে৷ আলেপ্পোর পতনের পর মানবিক সাহায্য সংক্রান্ত কার্যকলাপের ব্যাপারে আপোশ সৃষ্টিতে তুরস্ক সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে: বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত ইদলিব প্রদেশে একাধিক শিয়া গ্রামের উপর অবরোধ তুলে নেওয়ার পিছনেও ছিল তুরস্কের প্রচেষ্টা৷ সব মিলিয়ে সিরিয়া সংঘাতে তুরস্ক এক নতুন নমনীয়তা প্রদর্শন করছে ও আসাদের অপসারণের দাবি জানানো বন্ধ করেছে৷ তুরস্কের কাছে উত্তর সিরিয়ায় কুর্দ রাষ্ট্র গঠন রোধ করাটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ৷ সেই কারণেই তুরস্ক সিরিয়ার রাজ্যাঞ্চলীয় অখণ্ডতা বজায় রাখতে আগ্রহী৷
অন্যদিকে তুরস্ক নির্ভরযোগ্য মিত্র ও সহযোগী হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর আস্থা হারিয়েছে৷ প্রথমত গত জুলাই মাসের সামরিক অভ্যুত্থানের প্রতি ওয়াশিংটনের সাবধানী প্রতিক্রিয়া; দ্বিতীয়ত, সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অনুৎসাহী ভূমিকা; তৃতীয়ত, তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে সংগ্রামে কুর্দদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ্য সমর্থন৷ এর ফলে এর্দোয়ান সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে দূরে সরে গিয়ে রাশিয়া ও ইরানের ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ছে৷
সিরিয়ার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?
আসাদ যুদ্ধে জিতলেও, শান্তি হারাবেন৷ তাঁকে নিত্যনতুন বিদ্রোহ ও প্রতিরোধের মোকাবিলা করতে হবে, অর্থাৎ সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ বহু বছর ধরে চলতে পারে৷ কিন্তু বাস্তব হল এই যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে আসাদকে বাদ দিয়ে সিরিয়ার কল্পনা করা বাস্তব- বা যুক্তিসম্মত নয়৷
মেইসাম বেহরাভেশ তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশুনার পর সুইডেনের লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে ডক্টরেট করছেন৷ তিনি লুন্ড ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর মিডল ইস্টার্ন স্টাডিজ বা সিএমইএস-এর রিসার্চ ফেলো৷
শবনম ফন হাইন/এসি
প্রিয় পাঠক, সাক্ষাৎকার নিয়ে কিছু বলতে চাইলে নীচে মন্তব্যের ঘরে লিখুন৷
যুদ্ধে নারী, নারী যোদ্ধা
২০১৪ সালের গ্রীষ্মে ইসলামিক স্টেট উত্তর ইরাকের ইয়াজিদি এলাকাগুলি দখল করে৷ হাজার হাজার ইয়াজিদি মহিলা ও কিশোরীকে ধরে নিয়ে গিয়ে দাসী হিসেবে রাখা হয় ও ধর্ষণ করা হয়৷ আজ সেই ইয়াজিদি নারীরাই সন্ত্রাসবাদিদের বিরুদ্ধে লড়ছেন৷
ছবি: Reuters/A. Jadallah
শত্রুর খোঁজ
শত্রু বাইরে কোথাও - কুর্দি নারী যোদ্ধা হাসেবা নৌজাদ ইরাকের মোসুল শহরের কাছে চোখে দুরবিন লাগিয়ে ‘ফ্রন্ট লাইন’ পরখ করে দেখছেন৷ কুর্দ এলাকা ও আইএস নিয়ন্ত্রিত এলাকার মধ্যে সীমারেখা হলো এই ফ্রন্ট৷ কুর্দিরা ইরাকি সামরিক বাহিনীর সহযোগিতায় ক্রমেই আরো এগিয়ে যাচ্ছে, পিছু হটছে ইসলামিক স্টেট৷
ছবি: Reuters/A. Jadallah
গুপ্তপ্রতিরোধের ভ্যানগার্ড
শত্রু নজরে পড়েছে, এবার তাদের দিকে গুলি চালানো হবে৷ হাসেবা নৌজাদ দেখাচ্ছেন কোনদিকে; আসেমা দাহির (ডান দিক থেকে তৃতীয়) ও অন্যান্য ইয়াজিদি নারী যোদ্ধারা নিশানা ঠিক করছেন৷ শুধুমাত্র বিমান থেকে আইএস সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে লাভ নেই৷ তাই ইয়াজিদি আর কুর্দ মহিলাদের নিয়ে রণক্ষেত্রে এই ভ্যানগার্ড তৈরি করা হয়েছে৷
ছবি: Reuters/A. Jadallah
সুন্দর দেখানোর জন্য নয়
বন্দুক নিয়ে ঠিকমতো নিশানা করার জন্য মাথার চুল কপালে বা চোখে পড়লে চলবে না৷ তাই চুল টান টান করে বেঁধে নেন হাসেবা নৌজাদ, ‘মিলিটারি লুক’ ফ্যাশনের জন্য নয়৷
ছবি: Reuters/A. Jadallah
লাকি চার্ম
যুদ্ধের ফাঁকে আসেমা দাহির৷ হাতে যে লাল রঙের টেডি বেয়ারটি রয়েছে, সেটা হয়তো অতীতের সেই সুন্দর, শান্তিপূর্ণ দিনগুলির প্রতীক, যখন আইএস ইয়াজিদিদের স্বদেশকে দখল করেনি৷ ২০১৪ সালের গ্রীষ্মে সেই শান্তি শেষ হয়ে যায়, শুরু হয় আইএস-এর সন্ত্রাস৷
ছবি: Reuters/A. Jadallah
পালানো ছাড়া পথ ছিল না
শিশু, মহিলা, বৃদ্ধ, আইএস কাউকে ক্ষমা করেনি৷ ২০১৪ সালের গ্রীষ্মে লক্ষ লক্ষ ইয়াজিদি বাস্তু ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করেন, তাদের পিছনে আইএস৷ এক বৃদ্ধ ও দুই তরুণীর এই ছবিটি যেন বিশ্বের সামনে ইয়াজিদিদের যন্ত্রণাকে তুলে ধরে৷
ছবি: Reuters
বিভীষিকা
এই ইয়াজিদি কিশোরী ক্যামেরার সামনে তার মুখ দেখাতে চায় না৷ ২০১৪ সালে এই ১৫ বছর বয়সের মেয়েটিকে ধরে নিয়ে গিয়ে একজন আইএস যোদ্ধার সঙ্গে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল৷ তার দু’মাস পরে মেয়েটি পালাতে সমর্থ হয়৷ আজ সে আবার নিজের পরিবারের সঙ্গেই বাস করছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/D. Bennett
ধ্বংসস্তূপ
উত্তর সিরিয়ার কোবানি শহরটি তুর্কি সীমান্তের অদূরে৷ আইএস যোদ্ধারা মাসের পর মাস শহরটি অবরুদ্ধ করে রেখেছিল৷ কুর্দিরা সব কিছুর পরও প্রতিরোধ চালিয়ে যায় ও শেষমেশ মার্কিন বিমানবাহিনীর সাহায্যে সন্ত্রাসবাদীদের পরাজিত করতে সমর্থ হয়৷ পড়ে থাকে একটি শহর নয়, যেন শহরের ধ্বংসস্তূপ৷
ছবি: Getty Images/AFP/Y. Akgul
সবে মিলে করি কাজ
যারা আইএস-এর আদর্শে বিশ্বাস করে না, আইএস-এর দৃষ্টিতে তারা সবাই শত্রু৷ বিভিন্ন ধর্ম, সম্প্রদায় ও জাতির মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করাই হলো আইএস-এর উদ্দেশ্য৷ সে উদ্দেশ্য সর্বক্ষেত্রে সফল হয় না৷ কুর্দি আর ইয়াজিদি মেয়েদের মধ্যে যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে, এক অর্থে তা আইএস-এর প্রতীকী পরাজয়৷
ছবি: Reuters/A. Jadallah
স্বাধীনতার সড়ক
শুধু অস্ত্র দিয়ে আইএস-কে হারানো যাবে না৷ সিরিয়া আর ইরাকের অনেক এলাকা এখনও আইএস-এর নিয়ন্ত্রণে৷ কুর্দি আর ইয়াজিদি মেয়েরাও তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাবে৷ তাদের প্রতিরোধের আর একটি শিক্ষা হলো, মেয়েরা পুরুষের দাস নয় - সন্ত্রাসবাদিদের যা কাজে লাগার কথা!