২০১৫ সালে বাংলা নববর্ষের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলকায় যৌন নিপীড়নের ঘটনায় জড়িতদের খুঁজে পায়নি পুলিশ৷ এমনকি সংবাদমাধ্যমে আটজনের ছবি প্রকাশের পরও নয়৷ তাই আটক একজনকেই আসামি করেছে তারা৷
বিজ্ঞাপন
গত সপ্তাহে একজনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দেয়ার যুক্তি হিসেবে মামলার সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন বা পিবিআই-এর ইন্সপেক্টর আব্দুর রাজ্জাক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কেউ তথ্য না দিলে কী করা যাবে? এত বড় আলোচিত ঘটনা চার্জশিট তো একটা দিতেই হবে৷ তাই একজনকে আসামি করেই চার্জশিট দিয়ে দিয়েছি৷''
চার্জশিটে যাকে আসামি করা হয়েছে তার নাম কামাল৷ সে পুরনো ঢাকার একজন ফল বিক্রেতা৷ ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকার কথা সে স্বীকার করেছে পুলিশের কাছে৷ তবে তার দাবি, সে যৌন নিপীড়নের ঘটনায় জড়িত নয়৷ তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘‘বাকি যাদের সিসিটিভি ফুটেজ ধরে চিহ্নত করা হয়েছে, তাদের কামাল চেনে না৷ তবে আমাদের মনে হয়েছে যে কামাল সুযোগ নিয়েছে৷''
২০১৫ সালের পহেলা বৈশাখে (১৪ এপ্রিল) টিএসসির উল্টো দিকে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের গেটে এই যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটে৷ ঐ এলকায় সিসিটিভি ছিল, ছিল টহল পুলিশ৷ এরপরও প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে ঐ ঘটনা ঘটার সময় নারীদের উদ্ধারে এগিয়ে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সে সময়কার ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি লিটন নন্দীসহ আরো কিছু তরুণ৷ লিটন নন্দী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বেশ কয়েকজন নারী যৌন হয়রানির শিকার হন৷ তাঁদের মধ্যে আমরা ১০ জনকে উদ্ধার করেছি৷ আমার মনে হয়, এটা এক বা দু'জনের কাজ নয়৷ বড় একটি সংঘবদ্ধ গ্রুপের কাজ ছিল এটা৷''
লিটন জানান, ‘‘পুলিশ প্রথমে ঘটনাটা অস্বীকার করেছিল৷ পরে অবশ্য ঘটনা স্বীকার করে পুলিশ নিজেই মামলা করে তদন্ত শুরু করে৷ আমরা সিসিটিভি-র ফুটেজ দেখে আটজনকে চিহ্নিত করতে সহায়তা করি৷ কিন্তু এই আটজনই নয়, এর বাইরেও আরো অনেকে ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল৷''
আব্দুর রাজ্জাক
আটজনকে চিহ্নিত করার পর, গত বছরের ১৭ই মে তাদের ধরিয়ে দিতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগবা ডিবি সংবাদমাধ্যমে তাদের ছবি প্রকাশ করে৷ এরপর একই বছরের ১৩ই ডিসেম্বর আদালতে মামলার ফাইনাল রিপোর্ট দেয় ডিবি৷ তারা জানায় যে, তারা কাউকে এই ঘটনায় জড়িত বলে চিহ্নিত করতে পারেনি৷ কিন্তু চলতি বছরের ২৮শে জানুয়ারি পুলিশ ঢাকার চকবাজার এলাকা থেকে কামাল নামে একজন ফল বিক্রেতাকে আটক করে৷ পুলিশ জানায় চিহ্নিত আটজনের মধ্যে একজন কামাল৷ ঘটনার সময় তার দাড়ি থাকলেও, পরে সে দাড়ি কেটে ফেলে৷
এরপর ডিবি মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার আবেদন জানালে আদালত মামলাটি ২৩শে ফেব্রুয়ারি পুনরুজ্জীবনের আদেশ দিয়ে মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেয় পিবিআই-কে৷
কিন্তু পিবিআই মামলার নতুন কোনো তদন্ত না করে ঐ একজনকেই আসামি করে চার্জশিট দিয়েছে৷ মামলায় ৩৪ জন সাক্ষীর কথা বলা হলেও, ঘটনার শিকার কারুর জবানবন্দি বা বক্তব্য নেই৷ পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘এ ধরনের ঘটনার শিকার যাঁরা হন, তাঁরা সাধারণত নিজেদের নানা কারণে প্রকাশ করতে চান না৷ তাই তাঁদের বক্তব্য পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে৷ তবে পুলিশের কাজ হলো তাঁদের নাম পরিচয় গোপন রেখে তাঁদের বক্তব্য জানা৷ তা না হলে তদন্ত পূর্ণাঙ্গ হয় না৷ কারণ শুধু ছবি বা ফুটেজের মাধ্যমে সব সময় নিশ্চিত হওয়া যায় না যে, কে দুর্বৃত্ত আর কে উদ্ধার বা রক্ষাকারী৷''
লিটন নন্দী
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক দাবি করেন, ‘‘আমরা চেষ্টা করেছি, কিন্তু কেউ আমাদের সহযোগিতা করেনি৷ কেউ আমাদের তথ্য দেয়নি৷ আমরা কী করবো?'' কিন্তু তাই বলে এমন একটা দুর্বল তদন্ত, দুর্বল চার্জশিট? এ প্রশ্নের জবাবে তদন্ত কর্মকর্তা জানান, ‘‘তা হবে কেন! কখনো চিহ্নিতদের ধরতে পারলে, তাদের নাম ঠিকানা জানতে পারলে আমরা আদালতকে জানাবো৷ তখন তারাও আইনের আওয়তায় আসবে৷''
লিটন নন্দী বলেন, ‘‘এটা দুঃখজনক যে চিহ্নিত করার পরও অভিযুক্তদের খুঁজে পায়নি পুলিশ৷ দেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এতগুলো এজেন্সি, তাদের এত ‘সোর্স', তারপরও তারা অপরাধীদের ঠিকানা বের করতে পারে না৷ এটা তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের ব্যাপক আস্থাহীনতা তৈরি করবে৷''
বাকি সাতজন অভিযুক্তকে খুঁজে না পেয়ে একজনকে চার্জশিট দেওয়া কি যুক্তিসঙ্গত? জানান আপনাদের মতামত, লিখুন নীচের ঘরে৷
বাংলাদেশে যৌন শিক্ষা
পাঠ্যপুস্তকে যৌন স্বাস্থ্যের বিষয়টি ইতিমধ্যেই অন্তর্ভুক্ত করেছে সরকার৷ কিন্তু যৌন শিক্ষা পড়ানো নিয়ে সমস্যা হচ্ছে৷ শিক্ষকরা এতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেননি, ছাত্র-ছাত্রীরাও বিষয়টিকে সহজভাবে নিচ্ছে না৷ কী বলছে আজকের তরুণ সমাজ?
ছবি: DW/K. Andrade
ফারজানা খানম
অ্যামেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের মিডিয়া অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশনের তৃতীয় সেমিস্টারের ছাত্রী ফারজানা৷ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষা হচ্ছে যা থেকে যৌনতা সম্পর্কে জানা যায়৷ এ শিক্ষা প্রত্যেকের জীবনে প্রয়োজন৷ বাচ্চাদের পরিবার এবং শিক্ষকরা এটা শিখাতে পারেন৷ এছাড়া যৌনতা সম্পর্কে তাদের জানার উৎস হতে পারে পরিবার অথবা বন্ধু-বান্ধব৷ তাছাড়া ইন্টারনেট থেকেও যৌনতা সম্পর্কে জানা যায়, জানান ফারজানা৷
ছবি: DW
নাফিসা হক অর্পা
অ্যামেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের মিডিয়া অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশনের ষষ্ঠ সেমিস্টারের ছাত্রী নাফিসা হক অর্পা৷ নারী-পুরুষের শারীরিক মিলন সম্পর্কে জ্ঞানকেই যৌন শিক্ষা৷ নাফিসার কথায়, ‘‘আমাদের সময়ে ইন্টারনেট এত সহজলভ্য ছিল না৷ তখন বন্ধু, সহপাঠী, আত্মীয়স্বজনরাই ছিলেন মূল ভরসা৷’’ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষাটাকে ট্যাবু হিসেবে না দেখে একে শিক্ষার অংশ করা উচিত৷ এতে করে যৌন বিষয়ক অপরাধ কমবে৷
ছবি: DW
জান্নাতুল ফেরদৌস কনক
নাফিসার মতোই মাস কমিউনিকেশন নিয়ে পড়াশোনা করছেন জান্নাতুল ফেরদৌস কনক, তবে তিনি পড়ছেন পঞ্চম সেমিস্টারে৷ তাঁর মতে, যৌনতা হচ্ছে বয়সের পরিবর্তনে শারীরিক এক ধরণের চাহিদা৷ আগে এ নিয়ে সীমাবধ্যতা থাকলেও, এখন ছেলে-ছেলে কিংবা মেয়ে-মেয়ের যৌন সম্পর্কও বেশ জনপ্রিয়৷ ‘‘বন্ধুদের আড্ডায় এটাই সবচেয়ে আলোচিত বিষয়’’, জানান কনক৷ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষার দরকার না থাকলেও এ বিষয়ে জ্ঞান থাকা জরুরি৷
ছবি: DW
ইমরান খান
অ্যামেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী ইমরান খান৷ তিনি যৌন শিক্ষা বলতে যৌনতা সম্পর্কে সব ধরণের ধারণাকে বোঝেন৷ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষা সবার জন্য একটি অত্যন্ত জরুরি বিষয়৷ আর এ কথাটা শিশুদের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য৷ তবে ইমরানের কথায়, ‘‘সঠিক যৌন শিক্ষা স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, পরিবার থেকেই গড়ে উঠতে পারে৷’’
ছবি: DW
কেডিএস সাকিব
বেসরকারি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নাফিসা আর কনকের মতো মিডিয়া অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশন নিয়ে পড়ছেন সাকিব, পঞ্চম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী৷ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষা হলো যৌন মিলনের উপর জ্ঞান৷ তবে শিক্ষকদের কাছ থেকে নয়, বয়ঃসন্ধিকাল থেকেই বন্ধুদের কাছ থেকে এ বিষয়ে জেনেছেন তিনি৷ সাকিবের মতে, পর্যাপ্ত যৌন শিক্ষা অবশ্যই দরকার৷ যৌনতা সম্পর্কে তাঁর জানার মূল উৎস বিভিন্ন ওয়েবসাইট, ব্লগ এবং এ সম্বন্ধে লিখা বিভিন্ন বই৷
ছবি: DW
মাহবুব টিপু
নাফিসা, কনক, সাকিব আর ফারজানার মতোই মাস কমিউনিকেশন নিয়ে পড়াশোনা করছেন মাহবুব টিপু৷ অবশ্য তিনি এখনও দ্বিতীয় সেমিস্টারে৷ যৌন শিক্ষা তাঁর কাছে যৌনতা সম্পর্কে সঠিক শিক্ষা৷ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষাটা বয়সের সঙ্গে সঙ্গেই চলে আসে৷ এ বিষয়ে জানার সবচেয়ে বড় জায়গা বন্ধু-বান্ধব৷ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষার মৌলিক বিষয়গুলো সবারই কম-বেশি জানা থাকে৷ তারপরও এ বিষয়ে শেখার সবচেয়ে বড় মাধ্যম বিভিন্ন ওয়েবসাইট৷
ছবি: DW
সামিয়া রহমান
সামিয়া রহমানও মিডিয়া অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশনের দ্বিতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী৷ যৌন শিক্ষা বলতে তিনি বোঝেন নারী ও পুরুষের শারীরিক সম্পর্ক বিষয়ে জ্ঞান৷ তাঁর কথায়, ‘‘যৌন শিক্ষা আমাদের দেশে নিষিদ্ধ একটি বিষয়ের মতো৷ তাই এ বিষয়ে আমি শিক্ষা পায়নি৷’’ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষা খুবই জরুরি৷ এ বিষয়ে সঠিক জ্ঞান না থাকায় অনেকেই ভুল পথে চলে যায়৷ তাই বাবা-মায়েরও এ বিষয়ে সন্তানদের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলা উচিত৷
ছবি: DW
নাফিউল হক শাফিন
টিপু আর সামিয়ার মতো অ্যামেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের মাস কমিউনিকেশন বিভাগের দ্বিতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী নাফিউল৷ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষা জীবনের জৈবিক চাহিদা সম্পর্কে জানা এবং যৌনতার সঠিক প্রয়োগ ও সতর্কতাকে বোঝায়৷ তিনি শিক্ষকদের কাছ থেকে এ বিষয়ে কিছু শেখেননি৷ তবে এই শিক্ষাটা খুবই জরুরি বলে মনে করেন তিনি৷ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষার জন্য বড় কেউ কিংবা সহপাঠীরাই বড় মাধ্যম৷
ছবি: DW
মালিহা রহমান
মালিহা রহমানও ঐ একই বিশ্ববিদ্যালয়ে মিডিয়া অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশনের দ্বিতীয় সেমিস্টারের ছাত্রী৷ তাঁর মতে, যৌন শিক্ষা হলো শারীরিক সম্পর্কের হাতে কলমে শিক্ষা৷ অবশ্য তাঁর কথায়, যৌন শিক্ষা একটা স্বাভাবিক বিষয় যেটা মানুষ থেকে শুরু করে সব প্রাণীই প্রাকৃতিকভাবে জানে৷ তাঁর মতে, এ বিষয়ে আগে থেকে জানার কিছু নেই, নেই ভালো কোনো দিক৷ যখন এ বিষয়ে জানার প্রয়োজন হবে তখন এমনিতেই তা জানা যাবে৷