আসামে ৭০০টি মাদ্রাসা বন্ধ করে দেয়ার জন্য আইন প্রণয়ন করেছে রাজ্য সরকার। শুরু হয়েছে বিতর্ক।
বিজ্ঞাপন
বিজেপি শাসিত আসামে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সমস্ত মাদ্রাসা। সম্প্রতি আসাম বিধানসভায় এই আইন পাস হয়েছে। যা নিয়ে রাজ্য জুড়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বিরোধী শিবিরের দাবি, আরো একটি মুসলিম বিরোধী পদক্ষেপ নিল বিজেপি। অন্য দিকে বিজেপির দাবি, প্রতিটি মাদ্রাসাকেই সরকারি স্কুলে পরিণত করা হবে। এর ফলে মুসলিমরাই উন্নত শিক্ষা পাবেন। ৯৭টি সংস্কৃত টোলকেও বন্ধ করে রিসার্চ সেন্টারের অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
আসামে প্রায় ৭০০টি নথিভুক্ত মাদ্রাসা রয়েছে। প্রতিটি মাদ্রাসাই একটি বোর্ডের অন্তর্গত। বিজেপি আসামে ক্ষমতায় আসার পরেই ঘোষণা করেছিল, মাদ্রাসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারণ, মাদ্রাসায় ধ্রমীয় শিক্ষা দেওয়া হয়। ওই শিক্ষা গ্রহণ করে সাধারণ মুসলিম ছাত্রছাত্রীরা মূলস্রোতে কাজের সুযোগ পায় না। যদিও বিজেপির এই দাবির সঙ্গে সমস্ত রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় শিবির এক মত নয়। তবে বিজেপি নিজের বক্তব্য থেকে সরেনি। তারই প্রতিফলন ঘটেছে নতুন আইনে। আসামে বিজেপির গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, মাদ্রাসায় পড়ে ছাত্ররা মসজিদের ইমাম তৈরি হয়। কিন্তু মূলস্রোতের কাজে সুযোগ পায় না। নতুন আইনে প্রতিটি মাদ্রাসাকে সরকারি স্কুলে পরিণত করা হবে। ছাত্ররা সেখানে পড়াশোনা করে সরকারি কাজে যোগ দেওয়ার সুযোগ পাবে।
মাদ্রাসায় খেলাধুলা ও সংস্কৃতি চর্চা
বাংলাদেশে দু’ ধরনের মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে৷ একটি সরকার অনুমোদিত আলিয়া মাদ্রাসা, অন্যটি কওমি মাদ্রাসা৷ এসব মাদ্রাসায় খেলাধুলা ও সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ কেমন, তা জানা যাবে এই ছবিঘরে৷
ছবি: Sazzad Hossain
মাদ্রাসার সংখ্যা
বাংলাদেশে সরকার অনুমোদিত আলিয়া মাদ্রাসার সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার৷ আর কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের হিসেবে, কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা ১৩,৭১০টি৷ অবশ্য বছর তিনেক আগে কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রিকে সাধারণ শিক্ষার স্নাতকোত্তর সমমান মর্যাদা দেয়া হয়৷ দুই ধারা মিলিয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ৷
দুই মাদ্রাসার দুই চিত্র
সরকার অনুমোদিত আলিয়া মাদ্রাসাগুলোতে খেলাধুলা ও সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ থাকলেও বেশিরভাগ কওমি মাদ্রাসাতেই সেই সুযোগ নেই৷
ছবি: DW/M. Mamun
বছরে দুটো ক্রীড়া প্রতিযোগিতা
আলিয়া মাদ্রাসাগুলো নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড৷ এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক কায়সার আহমেদ ডয়চে ভেলেকে জানান, বোর্ডের অধীনে প্রতিবছর শীত ও গ্রীষ্মকালে দুটি ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়৷ যদিও তিনি মনে করেন, মনিটরিংয়ের অভাব কিংবা শিক্ষকদের উদাসীনতার কারণে জাতীয় পর্যায়ের খেলাধুলায় স্কুল-কলেজের ছেলে-মেয়েদের চেয়ে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে আছে৷
ছবি: Privat
কওমি মাদ্রাসার কথা
বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও ‘আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম’-এর সহকারী অধ্যাপক মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কওমি মাদ্রাসায় শুধু ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হয়৷ জাগতিক বিষয়গুলো সেখানে গৌন৷ শরিয়তের সীমাবদ্ধতার কারণে কিছু বিষয়, যেমন টিভি দেখার মতো বিনোদনমূলক বিষয়গুলো সেখানে নিষিদ্ধ৷ খেলাধুলার ক্ষেত্রেও তারা নিরুৎসাহিত করে থাকে৷’’
ছবি: Privat
আছে ব্যতিক্রম
ঢাকার নূরীয়া হাজারীবাগ মাদ্রাসা একটি কওমি মাদ্রাসা৷ সেখানকার নূরানী বিভাগের প্রধান শিক্ষক হাফেজ মো: মুজিবুল হক মনে করেন, শিক্ষার্থীদের একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য খেলাধুলা ও বিনোদনের প্রয়োজন আছে৷ তিনি জানান, তার মাদ্রাসায় প্রতি বৃহস্পতিবার গজল ও কেরাতের উপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়৷ এছাড়া বছরে তিনবার গজল ও কেরাত প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়৷
ছবি: Sazzad Hossain
সরকারি সহায়তা প্রয়োজন
ফেঞ্চুগঞ্জের মদিনাতুল উলুম শাহ মালুম মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা ফখরুল ইসলাম জানান, তার মাদ্রাসায় শরীরচর্চার শিক্ষক নেই৷ তবে ছেলেরা সময় পেলে মাদ্রাসার সামনের মাঠে খেলাধুলা করে৷ মাদ্রাসা থেকে কোনো সরঞ্জাম দেয়া হয় না৷ শিক্ষার্থীরাই ব্যাট-বল নিয়ে আসে৷ তিনি বলেন, ‘‘খেলাধুলার জন্য সরকারের সহায়তা পেলে ভালো হয়৷’’ ছবিতে ঢাকার হাজারীবাগের আল-জামি’আ মাদীনাতুল উলূম মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Sazzad Hossain
ফুটবল খেলতে ভালো লাগে
ঢাকার নূরীয়া হাজারীবাগ মাদ্রাসার শিক্ষার্থী তানিমের (১২) ফুটবল খেলতে ভালো লাগে৷ তাই বিকেল হলেই সে মাঠে ফুটবল খেলতে যায়৷
ছবি: Sazzad Hossain
খেললে পড়াশোনায় মন বসে
ঢাকার নূরীয়া হাজারীবাগ মাদ্রাসার আরেক শিক্ষার্থী হাছান (১৫) মনে করে, খেলাধুলা করলে মন ভালো থাকে, পড়াশোনায় মন বসে৷
ছবি: Sazzad Hossain
মন ভালো থাকে
নূরীয়া হাজারীবাগ মাদ্রাসার শিক্ষার্থী মোঃ ইমরান হোসাইন ক্রিকেট, ফুটবল ও ব্যাডমিন্টন খেলতে ভালোবাসে৷ খেলাধুলা করলে মন ভালো থাকে বলে মনে করে সে৷
ছবি: Sazzad Hossain
কওমিতে সৃজনশীল চর্চার সুযোগ কম
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক (সম্পাদক, প্রকাশনা বিভাগ) আনোয়ার কবীর ডয়চে ভেলেকে বলেন, কওমি ধারায় সৃজনশীল চর্চার সুযোগ অনেক কম৷ কারণ, তারা নিজেরাই সিলেবাস নিয়ন্ত্রণ করে৷ তাই কওমি-পড়ুয়া শিশুদের গোঁড়ামিমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে তৃণমূল পর্যায়ে সৃজনশীল চর্চা প্রসারিত করতে হবে বলে মনে করেন তিনি৷
ছবি: Privat
উদ্যোগ
কওমি শিক্ষাধারাকে মূলধারার সমান্তরাল করতে সরকারি কিছু উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে৷ কওমি মাদ্রাসা নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান ‘বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ’ বা বেফাক নেতাদের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ আগের তুলনায় বেড়েছে৷ কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসকে বছর তিনেক আগে সাধারণ শিক্ষার স্নাতকোত্তর সমমান মর্যাদা দেয়া হয়৷
ছবি: DW/M. Mamun
11 ছবি1 | 11
যদিও মাদ্রাসাগুলিকে সরকারি স্কুলে পরিণত করা যাবে কি না, তা নিয়ে দ্বন্দ্ব আছে। যে সমস্ত মাদ্রাসা ব্যক্তিগত বা কোনো বোর্ডের মালিকানাধীন, তারা সরকারকে তা দিতে রাজি হবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে।
আসামে কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ওয়াজেদ আলি চৌধুরীর বক্তব্য, সরকারি কাজের টোপ দিয়ে মুসলিম বিরোধী পদক্ষেপ নিয়েছে বিজেপি সরকার। মাদ্রাসা বন্ধ করে মুসলিমদের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করা হচ্ছে।
রাজ্য সরকার অবশ্য জানিয়েছে, ৯৭টি সংস্কৃত টোলকেও বন্ধ করা হবে। ওই টোলগুলিকে সংস্কৃত এবং প্রাচীন ইতিহাস চর্চাকেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত করা হবে। অর্থাৎ, টোলগুলিকে রিসার্চ সেন্টারে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশের ১০০ জন আইএএস এবং আইপিএস অফিসার সরকারকে একটি চিঠি দিয়েছে। যাত বলা হয়েছে, লাভ জিহাদ নিয়ে সরকার যে আইন প্রণয়ন করেছে, তা মুসলিম বিরোধী। আসামের নতুন আইন নিয়েও সেই একই অভিযোগ উঠছে।