1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আসাম সহিংসতা: ৪২ বছর পর প্রকাশিত রিপোর্ট নিয়ে বিতর্ক কেন?

বিশ্বকল্যাণ পুরকায়স্থ আসাম
২৭ নভেম্বর ২০২৫

৪২ বছর পর আসামে নেলি হত্যাকাণ্ডসহ অন্যত্র সহিংসতা নিয়ে দুইটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে সরকার। শুরু বিতর্ক।

মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার নেতৃত্বে আসাম মন্ত্রিসভার বৈঠক। এখানেই রিপোর্ট প্রকাশের সিদ্ধান্ত হয়।
মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা ১৯৮৩ সালের হত্য়াকাণ্ড নিয়ে তিওয়ারি কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ছবি: Government of Assam

১৯৮৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি আসামের মরিগাঁও জেলার নেলিতে প্রায় সাত ঘন্টা ধরে সহিংসতা চলে। সহিংসতা ছড়িয়ে যায় আসামের অন্যত্রও। এতে প্রাণ হারান প্রায় দুই হাজার একশ মানুষ। বেশিরভাগই ছিলেন বাংলাভাষী মুসলমান। সেই ঘটনার তদন্তের  দুইটি রিপোর্ট প্রকাশ্যে এনেছে আসাম সরকার। 

দুইটি রিপোর্টে কী বলা হয়েছে

মঙ্গলবার আসাম বিধানসভার শীতকালীন অধিবেশনের প্রথম দিনেই প্রকাশ্যে আনা হয় নেলি হত্যাকাণ্ডের তদন্তের দুইটি রিপোর্ট। প্রথম রিপোর্টটি অবসরপ্রাপ্ত আইএএস ত্রিভুবন প্রসাদ তিওয়ারির নেতৃত্বে গঠিত হয় তিওয়ারি কমিশনের। সেই সময় সরকার এই কমিশন গঠন করে কিন্তু তাদের রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি। দ্বিতীয়টি বেসরকারিভাবে গঠিত বিচারপতি মেহতা কমিশনের রিপোর্ট। রিপোর্টে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সকাল সাতটায় শুরু হয় আক্রমণ এবং প্রায় মাত্র সাত ঘণ্টা ধরে চলে হত্যাকাণ্ড। এতে দুই হাজার একশোর বেশি মানুষ নিহত হন এবং অধিকাংশই ছিলেন মরিগাঁও জেলার নেলি ও আশপাশের ১৪টি গ্রামের বাংলা ভাষাভাষী মুসলমান। ব্যাপক সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ এবং তিন লক্ষ মানুষের বাস্তুচ্যুত হওয়া, সব মিলিয়ে এটি স্বাধীনোত্তর ভারতের অন্যতম ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড হিসেবেই পরিচিত। 

তিওয়ারি কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছে, সহিংসতা স্বতঃস্ফূর্ত ছিল না, বরং কয়েক দশক ধরে জমে থাকা জনসংখ্যাগত চাপ, অনুপ্রবেশ বিতর্ক, ভূ-সম্পত্তি নিয়ে সংঘাত, প্রশাসনিক উদাসীনতা এবং আসাম আন্দোলনকালীন রাজনৈতিক মেরুকরণের সমষ্টিগত কারণ মিলিয়ে এই অবস্থা হয়েছিল। কমিশনের অনুসন্ধান বলছে, নেলি অঞ্চলে আদি তিওয়া/লালুং, বোড়ো এবং অসমিয়া গ্রামগুলির পাশেই ছিল ঘনবসতিপূর্ণ বাঙালি মুসলমানদের বসতি। ভূমি দখল, নদীভাঙনজনিত চাপ এবং রাজনৈতিক উত্তাপের মধ্যে ১৯৮৩-র নির্বাচন ঘিরে অতি-সংবেদনশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। আসু–এএজিএসপি নির্বাচনের বিরোধিতার কথা ঘোষণা করলেও প্রশাসন নির্বাচনে অটল থাকায় সংঘাত চরমে পৌঁছায়। কমিশনের ভাষায়, “হিংসা প্রতিরোধে প্রশাসনিক প্রস্তুতি ছিল চরমভাবে ব্যর্থ।”

মেহতা কমিশন পুলিশের ভূমিকা নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেছে। দুই কমিশনের রিপোর্টে অনেকটাই ফারাক আছে৷ আসাম রাজ্যিক ফ্রিডম ফাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক গঠিত টিইউ মেহতা কমিশন পুরোপুরিই নির্বাচনকে দায়ী করেছে৷ সে জন্য চাঁছাছোলা ভাষায়  আক্রমণ করেছে নির্বাচন কমিশনকে৷ পাশাপাশি দোষারোপ করে তৎকালীন কংগ্রেস সরকার ও শাসকদলের নেতাদের৷ তাদের ক্ষমতালিপ্সাই এতগুলি প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, এত সম্পত্তি ধ্বংস করেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে মেহতা কমিশনের রিপোর্টে৷ তিওয়ারি কমিশন আন্দোলনকারী সংগঠন আসু-এএজিএসপিকে দায়ী করলেও পুলিশের ভূমিকা নিয়ে তেমন চর্চায় যাননি৷

'চাই না রাজনীতি হোক'

কৃষিজীবী সুলেমান আহমেদ কাসিমি ডিডাব্লিউকে ফোনে বলেন, ৪২ তার বয়স আগে তার বয়স ছিল ছিল ১২ বছর এবং তিনি এক মাদ্রাসায় পড়াশোনা করতেন। ১৯৮৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি একসঙ্গে তার মা-বাবা ও বোনসহ পরিবারের ১২ জন লোককে হত্যা করা হয়। ঘটনার তিনদিন পর তিনি মাদ্রাসা থেকে পালিয়ে একটি ক্যাম্পে গিয়ে তার পরিবারের বেঁচে থাকা সদস্যদের খুঁজে পান।

তিনি বলেন, "বাড়ি থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে একটা মাদ্রাসায় থাকতাম আমি। সেখানে সন্ধ্যায় রেডিওতে বিবিসির খবর শুনতাম এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি খবরের মাধ্যমে জানতে পারি নেলিতে আগুন জ্বলছে। আমি অস্থির হই। তবে তখন সরাসরি বাড়ির লোকেদের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল না। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ আমাদের বেরিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেননি, এমনকি সেখানে পুলিশ বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তিন দিনের মাথায় আমি গোপনে সেখান থেকে পালাই এবং একটি ট্রাকে চড়ে নেলি পৌঁছাই।"

এলাকায় গিয়ে তিনি দেখেন সবকিছুই ধ্বংস হয়ে গেছে, বাড়িঘর সব পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। তিনি পুলিশের সাহায্যে কিছুটা দূরে একটা ক্যাম্প এগিয়ে আশ্রয় নেন এবং অনেক খোঁজাখুঁজির পর তার তিন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়। তারা জানায় তাদের মা-বাবাকে হত্যা করা হয়েছে এবং বাড়ি ফিরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই। এমনকি পরিবারের লোকেদের জানাজায় অংশ নিতে পারেননি তারা। 

সুলেমান বলেন, "মা-বাবার দেহ আমরা দেখতেও পাইনি। প্রায় পাঁচ মাস ক্যাম্পে থাকার পর নিজেদের ভিটেতে ফিরে যাই।"

সুলেমান এখন ধান চাষ করেন এবং তার পাঁচটি সন্তান রয়েছে। তারা ১৯৮৩ সালের ঘটনাকে ভুলে অনেকটাই এগিয়ে গেছেন। তবে ৪২ বছর পর হঠাৎ এনিয়ে চর্চা শুরু হওয়ায় তারা আবার চিন্তিত। তিনি বলেছেন, "ওই ঘটনার পর আসামে বিভিন্ন দলের সরকার এসেছে তবে কেউ এনিয়ে কথা বলেনি। আমাদের ভালো লাগছে হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বিষয়টি সামনে এনেছেন তবে আমরা চাই না কিছুতেই ওই ঘটনা নিয়ে রাজনীতি হোক। এত বড় হত্যাকাণ্ডের পর কারো শাস্তি হয়নি, পুলিশ আমাদের মামলাগুলো কী করেছে জানি না। যদি মুখ্যমন্ত্রীর সদিচ্ছা থাকে তাহলে তিনি হয়তো দোষীদের শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। তবে তিনি নিজেই বাঙালি মুসলমানদের মিঞা সম্বোধন করে যেসব মন্তব্য করেন, তাকে বিশ্বাস করতে আমাদের ভয় হয়।"

মুখ্যমন্ত্রীর যুক্তি

তবে এই দুটো রিপোর্ট প্রকাশ্যে আনার ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার যুক্তি, ইতিহাস চাপা দেওয়াটা অপরাধ। রবিবার এক সাংবাদিক বৈঠকে তিনি বলেছেন, "১৯৮৩ সালের এই ঘটনা আসামের ইতিহাসের অংশ। আগের মুখ্যমন্ত্রীরা হয়তো সাহস দেখাতে পারেননি, কিন্তু আমরা ইতিবাচক উদ্দেশ্যে এই নথি সকলের সামনে আনছি।”

বিরোধীদের বক্তব্য

বিরোধীরা অবশ্য সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ সুস্মিতা দেব ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''নির্বাচনের ঠিক আগে পুরনো ক্ষত খোঁচাচ্ছে বিজেপি, অবশ্যই এর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। অসম আন্দোলনের ভিত্তি, নেলির গণহত্যা এবং এসবের পেছনে কারা ছিল এবং তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল, সবটাই জানেন আসামের বাংলাভাষীরা। তারা সবকিছু মেনে নিয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছেন। এই রাজ্যের বাঙালিরা যখন এগিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন, বিজেপি সেই পুরনো ক্ষত মনে করিয়ে দিতে চাইছে। অবশ্যই ভোটে প্রচারের জন্য সরকারের কাছে মত ভাল কাজের উদাহরণ নেই এবং বিজেপি বরাবরই রাজনীতির ক্ষেত্রে ধর্মীয় মেরুকরণ করে।"

এআইইউডিএফ দলের বিধায়ক রফিকুল ইসলাম বলেন, "শুধুমাত্র হত্যার কথা বললে হবে না তারা হত্যা করেছে তাদের কি শাস্তি দেওয়া হয়েছিল বা হতে পারে এনিয়েও আলোচনা দরকার।" তিনি প্রয়োজনে সিআইডি তদন্তের দাবিও তুলেছেন। 

অল আসাম মাইনোরিটি স্টুডেন্ট ইউনিয়ন (আমসু)-র সদস্যরা মনে করেন ঠিক নির্বাচনের আগে এই রিপোর্ট প্রকাশে আনা শুধুমাত্র অন্যান্য জ্বলন্ত সমস্যা- কে আড়াল করার একটি বাহানা। তারা বলেন, "শিল্পী জুবিন গর্গের মৃত্যুর পর সরকার অনেকটাই বিপাকে পড়েছে এবং ধর্মীয় মেরুকরণের মাধ্যমে জনগণকে বিভাজিত করতেই এই ৪২ বছর পুরনো রিপোর্ট প্রকাশ করে একটা নতুন চর্চা শুরু করতে চাইছে। যদি সরকারের সদিচ্ছা থাকতো তাহলে ১৯৮৩ সালে নিহত হওয়া পরিবারের লোকেদের জন্য সাহায্যের আশ্বাস দিতেন মুখ্যমন্ত্রী, ঠিক যেমনটা আসাম আন্দোলনের তথাকথিত শহিদদের দেওয়া হয়েছে।"

বিরোধী নেতা দেবব্রত শইকিয়া বার্তাসংস্থা এএনআইকে বলেছেন, ''তিওয়ারি কমিশনের রিপোর্ট আগে বিধানসভায় পেশ করা হয়েছিল ও সার্কুলেট করা হয়েছিল। তাই দ্বিতীয়বার পেশ করার দরকার ছিল না। আসাম এখন শান্তিপূর্ণ। মেহতা কমিশনের রিপোর্ট হলো বেসরকারি  রিপোর্ট। তা বিধানসভায় পেশ করা হলে অন্য বেসরকারি রিপোর্টও পেশ করতে হবে।''

'জমি রাজনীতির বিষয়'

লেখক, বিশ্লেষক এবং অর্থনীতির অধ্যাপক জয়দীপ বিশ্বাস ডিডাব্লিউকে বলেছেন, "আমি তখন পত্রিকায় ওই ঘটনার কথা পড়েছিলাম। আসামে এর আগে থেকেই বাঙালি-বিরোধী আন্দোলন চলছে এবং আমরা বরাবর আতঙ্কের মধ্যেই বড় হয়েছি। ৪২ বছর পর সরকার বিধানসভায় দুটো রিপোর্ট বিতরণ করেছে, এ নিয়ে আলোচনা হয়নি। আমার মনে হয় তিওয়ারি কমিশনের রিপোর্ট কম তদন্তমূলক এবং একটা নির্দিষ্ট বয়ান তুলে ধরার চেষ্টা করছে। তবে সেখানে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা উঠে এসেছে।"

জয়দীপ জানান, ''ঘটনার পর ৭০০ থেকে ৮০০ মামলা হয়েছিল তবে ১৯৮৫ সালের আসাম চুক্তির পর বেশিরভাগ বাতিল করা হয়। হত্যাকারীদের আইনের আওতায় আনা হয়নি এবং সরকারি হিসেবে যে সংখ্যা দেওয়া হয়েছে তার থেকে অনেক বেশি মৃত্যু হয়েছিল। জাপানের গবেষক মাকিকো কিমুরা একসময় এই ঘটনা নিয়ে গবেষণা করেন এবং পরবর্তীতে"দ্যা নেলি মেসাকার অব ১৯৮৩ অ্যাজেন্সি অব রায়োটার্স" নামের একটি বই প্রকাশ করেন। সেখানে নেলির অনেক অজানা তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।''

জয়দীপ বলেন, "বিষয়টি মুলত জমি রাজনীতি ছিল, আগেও এটাই বলা হয়েছে আর এখনও উচ্ছেদের ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা জমি দখল করে নিয়েছে। অথচ এই মানুষগুলো বহু বছর ধরে আসামে আছে, এটা অস্বীকার করা যাবে না।"

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ