নিলয় নীল হত্যাকাণ্ডে আরো দু'জনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ৷ ফলে এ ঘটনার সঙ্গে আনসারুল্লাহ বাংল টিমের সংশ্লিষ্টতা আরো স্পষ্ট হলো৷ পুলিশের দাবি, আসিফ মহিউদ্দীনকে যারা হত্যার চেষ্টা করেছিল, তারাই নিলয়ের হত্যাকারী৷
বিজ্ঞাপন
বৃহস্পতিবার রাতে কাউছার হোসেন খান ও কামাল হোসেন সরদার নামে দু'জনকে ঢাকার মিরপুর ও ধোলাইপাড় এলাকা থেকে আটক করা হয়৷ শুক্রবার তাদের আদালতে হাজির করে ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় ওরফে নিলয় নীল হত্যায় পাঁচদিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে৷
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) উপ-কমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আটক এই দু'জন ব্লগার আসিফ মাহিউদ্দীন হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি এবং আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য৷ তারা দু'জনই এর আগে আরো একবার আটক হয়েছিল৷''
গত ৭ই আগস্ট ঢাকার গোড়ানে নিজের ভাড়া বাসায় খুন হন ব্লগার নিলয় নীল৷ এরপর এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নুর ভাগ্নে সাদ আল-নাহিনকে উত্তরা থেকে এবং মাসুদ রানা নামে অন্য একজনকে মিরপুরের কালশী থেকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ তারাও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য৷
নাহিন ২০১৩ সালে উত্তরায় ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনের উপর হামলার পর গ্রেপ্তার হয় এবং এক বছরের বেশি সময় কারাগারে থাকার পর জামিনে ছাড়া পায়৷ এমনকি, গ্রেপ্তার হওয়ার পর সে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সক্রিয় সদস্য বলে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও দেয়৷
ঢাকা মহানগর পুলিশের অপর এক উপ-কমিশনার মাহবুবুল আলম ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘এখন এটা স্পষ্ট যে ব্লগার নিলয় হত্যার সঙ্গে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যরাই জড়িত৷ যারা ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনকে হত্যার চেষ্টা করেছিল, তারাই ব্লগার নিলয়কে হত্যা করেছে৷ শুধু তাই নয়, এর আগে যে দু'জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের মধ্যে সাদ আল-নাহিন পুলিশ রিমান্ডে আসিফ মহিউদ্দীনকে হত্যা করতে না পারার ব্যর্থতার জন্য আফসোস করেছে৷''
তিনি জানান, ‘‘দু'দফায় যে চারজন আটক হলো তারা সাবই আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য৷ বৃহস্পতিবার আটক হওয়া কাউছার ও কামাল এবং এর আগে আটক হওয়া নাহিন ও মাসুদ রানা একসঙ্গে কাজ করতো৷ তারা চারজনই ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনকেও হত্যার চেষ্টা করেছিল৷''
ব্লগার নিলয় হত্যার পরপরই হত্যার দায় স্বীকার করে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দেয় আল-কায়েদার ভারতীয় উপ-মহাদেশের (একিউআইএস) বাংলাদেশ শাখা আনসার-আল-ইসলাম নামে একটি সংগঠন৷ পরে তারা এই দায় অস্বীকার করলেও, হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে সমর্থন করে বলে খবর৷
নিলয় হত্যারহস্যও একই পথে?
আবারও ব্লগার হত্যার ঘটনা ঘটল বাংলাদেশে৷ এবার বাড়িতে ঢুকে জবাই করা হলো ব্লগার নীলয় নীলকে৷ বরাবরের মতো হত্যাকাণ্ডের পরই পুলিশ অপরাধীদের গ্রেপ্তারের আশ্বাস দিলেও, নিহতের পরিবার এ আশ্বাসে আস্থা রাখতে পারছে না৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
ঘরে ঢুকে জবাই
গত ৭ আগস্ট ঢাকার উত্তর গোড়ান এলাকার বাসায় ঢুকে নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়, ওরফে নিলয় নীলকে দুর্বৃত্তরা হত্যা করে৷ ব্লগার ও গণজাগরণ মঞ্চের সক্রিয় কর্মী নিলয়ের বয়স হয়েছিল ৪০ বছর৷ ভাড়া নেয়ার জন্য বাসা দেখতে চেয়ে ঢুকে পড়া চার দুর্বৃত্ত প্রথমে নিলয়ের স্ত্রী ও তাঁর ছোট বোনকে বারান্দায় বের করে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়, তারপর জবাই করে নিলয়কে৷
ছবি: Twitter
পুলিশকে পাশে পাননি নিলয়
কিছুদিন ধরেই তাঁর ওপর হামলার আশঙ্কা করছিলেন নিলয়৷ তিন মাস আগে তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, অচেনা কয়েকজন লোক তাঁকে অনুসরণ করছে৷ বিষয়টি জানিয়ে সাধারণ ডায়েরি করার জন্য থানায় গিয়েছিলেন৷ পুলিশ বিষয়টিকে আমলে না নিয়ে তাঁকে বরং দেশ ছাড়ার পরামর্শ দেয়৷ তাঁকে অনুসরণ করা এবং পুলিশের দেশ ছাড়ার পরামর্শের কথা ফেসবুকে নিলয় নিজেই লিখেছিলেন নিলয়৷
ছবি: Twitter
নিন্দার ঝড়, গ্রেপ্তার ও শাস্তি দাবি
নিলয় নীল নৃশংসভাবে নিহত হওয়ার পর দেশ-বিদেশে নিন্দার ঝড় ওঠে৷ জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুন এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে হত্যাকারীদের শাস্তি দাবি করেছে৷ নিলয়ের স্ত্রী আশামনি (ওপরের ছবিতে, বাঁ দিক থেকে দ্বিতীয়) এখনো কেউ গ্রেপ্তার না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
প্রতিবাদ
নিলয় হত্যার পর রাজধানী ঢাকাসহ কয়েকটি শহরে প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে৷ নিলয়সহ সব ব্লগার হত্যার দ্রুত বিচার দাবি করার পাশাপাশি পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা এবং ব্যর্থতায় ক্ষোভ প্রকাশ করে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার বলেছেন, ‘‘এতদিন ব্লগারদের রাস্তায় হত্যা করা হতো, এখন বাসায় ঢুকে জবাই করা শুরু হলো৷ এই সরকার ব্লগার হত্যায় পৃষ্ঠপোষকতা করছে৷’’
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
সরকারের নিষ্ক্রিয়তা ও বিচারহীনতার জন্যই হত্যাকাণ্ড চলছে
গত ২৬শে ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ব্লগার ও বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়৷ ৩০শে মার্চ তেজগাঁও এলাকায় প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করা হয় ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে৷ মৌলবাদীদের প্রাণনাশের হুমকির মুখে দেশ ছাড়া লেখিকা তসলিমা নাসরীন ধারবাহিকভাবে ব্লগার হত্যার জন্য শেখ হাসিনার সরকার এবং পুলিশ প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তাকে দায়ী করেছেন৷
ছবি: AFP/Getty Images
আল-কায়েদার দায়িত্ব স্বীকার
শুক্রবারই নিলয় হত্যার দায় স্বীকার করে আল-কায়েদা৷ আল-কায়েদার ভারতীয় উপ-মহাদেশের (একিউআইএস) বাংলাদেশ শাখা, আনসার আল-ইসলামের নামে সংবাদমাধ্যমে ই-মেল পাঠিয়ে ইসলামি জঙ্গি সংগঠনটি এ হত্যার দায়িত্ব স্বীকার করে৷
ছবি: Fotolia/Oleg Zabielin
‘ধর্মের নামে সন্ত্রাস চলতে দেবো না’
এদিকে ঢাকার এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধর্মরক্ষার কথা বলে মানুষ হত্যাকে ‘ধর্মের নামে সন্ত্রাস’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশে এটা চলতে দেওয়া যাবে না৷’’ তিনি আরো বলেন, ‘‘ইসলাম ধর্ম শান্তির ধর্ম৷ যারা ধর্মকেও কলুষিত করে যাচ্ছে, তারা কখনোই ধর্মে বিশ্বাস করে বলে মনে হয় না৷ তারা নিজেদের মুসলমান হিসেবে কীভাবে ঘোষণা দেবে?’’
ছবি: Oli Scarff/Getty Images
‘সীমা লঙ্ঘন করবেন না’
পুলিশের আইজি একেএম শহিদুল হক বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া দণ্ডনীয় অপরাধ জানিয়ে ব্লগারদের প্রতি সীমা লঙ্ঘন না করার অনুরোধ জানিয়েছেন৷ এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরো বলেন, ‘‘কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া উচিত নয়৷ কেউ তা করলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে৷’’ ব্লগার হত্যাকারীদের ‘মানসিক বিকারগ্রস্ত’ হিসেবে অভিহিত করে তাদের গ্রেপ্তারের আশ্বাসও দিয়েছেন তিনি৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
জামায়াতের ‘ভুল’
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সোচ্চার ছিলেন নিলয় নীল৷ বিচারাধীন, সাজাপ্রাপ্ত এবং অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের অধিকাংশই জামায়াতে ইসলামীর নেতা৷ নিলয় নিহত হওয়ার পর হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেয় জামায়াত৷ তবে দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য হামিদুর রহমান আযাদের পাঠানো বিবৃতিতে নিলয় নীল নামে পরিচিতি নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়ের নাম লেখা হয় নীলয় হোসেন ওরফে নীল৷