আসিয়ান দেশগুলির সম্মেলনে দক্ষিণ চীন সমুদ্র ইস্যুতে মোদী সরকারের অবস্থান তুলে ধরেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ৷ অন্যান্য আসিয়ান দেশগুলির সঙ্গে গলা মিলিয়ে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের একাধিপত্যের দাবির বিরুদ্ধে সরব হয় দিল্লি৷
বিজ্ঞাপন
মিয়ানমারে সদ্য সমাপ্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির জোট, ‘আসিয়ান'-এর ৪৭তম সম্মেলনে, ছায়া পড়ে দক্ষিণ চীন সমুদ্রে চীনের একাধিপত্যের ইস্যুটি৷ আলোচনা কার্যত ঘিরে থাকে সমুদ্রপথের নিরাপত্তা নিয়ে যে আঞ্চলিক তথা আন্তর্জাতিক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে, তার সম্ভাব্য সমাধান সূত্র চীন সরাসরি খারিজ করে দেয়াতে৷ চীনের অনমনীয় অবস্থানে শঙ্কিত আসিয়ান দেশগুলি৷ চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলপ্রয়োগের কথা অস্বীকার করে বলেন, চীনের সার্বভৌমত্ব এবং সমুদ্রপথ রক্ষায় আপোষ করার প্রশ্নই ওঠে না৷ তাঁর মতে পুরো বিষয়টিকে স্বার্থান্বেষী মহল বাড়িয়ে চড়িয়ে দেখাতে চাইছে৷ কোনো দেশের কিছু বলার থাকলে দ্বিপাক্ষিক স্তরে আলোচনা হতে পারে৷ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দক্ষিণ চীন সাগরের ৯০ শতাংশ নিজের বলে দাবি করে যাচ্ছে বেজিং৷ কারণটা স্পষ্ট, এই সাগরের নীচে লুকিয়ে আছে তেল ও গ্যাসের বিশাল ভাণ্ডার৷ চীন ছাড়া আশিয়ান দেশগুলিও দিল্লি বক্তব্য সমর্থন করে শান্তিপূর্ণ সমাধানের কথা বলে৷
একজন নরেন্দ্র মোদী
উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং বিভাজনের রাজনীতির কারণে ভারতের বহু মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজেকে নতুন মোড়কে সামনে এনে সেই নরেন্দ্র মোদীই শোনাচ্ছেন ভারতকে বদলে দেয়ার মন্ত্র৷
ছবি: dapd
চা ওয়ালা
১৯৫০ সালে গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন্দ্র মোদী কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সে যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, যদিও বেশিদিন সংসার করা হয়নি৷ ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও মোদী বিতর্কে ছিলেন ওস্তাদ৷ ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতির দরজায় পা রাখেন মোদী৷
ছবি: UNI
গুজরাটের গদিধারী
১৯৮৫ সালে আরএসএস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মাথায় দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে গুজরাটের নির্বাচনে চমক দেখানো মোদী৷ ১৯৯৮ সালে নেন দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দলের মনোনয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী, যে দায়িত্ব তিনি এখনো পালন করে চলেছেন৷
ছবি: Reuters
দাঙ্গার কালিমা
মোদীকে নিয়ে আলোচনায় ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে অবধারিতভাবে৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন৷ মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি এ অভিযোগ স্বীকার করেননি, আদালতও তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, হিন্দুত্ববাদের গান শুনিয়েই তিন দফা নির্বাচনে জয় পান মোদী৷
ছবি: AP
রূপান্তর
দাঙ্গার পর নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন নরেন্দ্র মোদী৷ একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু হয় ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রচার৷ ২০০৭ সালের পর নিজেকে একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে নতুন প্রচার শুরু করেন এই বিজেপি নেতা, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী’৷গুজরাটের উন্নয়নের চিত্র দেখিয়ে কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে তিনি পরিণত করেন ভারতের ত্রাতার চেহারায়৷
ছবি: UNI
ভারতের পথে পথে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: AP
নতুন ইতিহাস
ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই যে এবার ভারতে সরকারগঠন করতে যাচ্ছে, বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি৷ ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১ কোটি ৪০ লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শেষ হাসি
নির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি ভারতকে বদলে দেবেন৷ অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ‘কলঙ্কিত ভাবমূর্তি’ ঢাকতে এসব মোদীর ফাঁপা বুলি৷ তাঁর স্বৈরাচারী মেজাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ভোটাররা টানা তৃতীয়বার কংগ্রেসকে চায়নি বলেই বিজেপি জয় পেয়েছে৷ যদিও শেষ হাসি দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর মুখেই৷
ছবি: dapd
7 ছবি1 | 7
এ বিষয়ে ভারতের অবস্থান
দক্ষিণ চীন সমুদ্রে যেহেতু ভারতের অর্থনৈতিক তথা কৌশলগত স্বার্থ জড়িত তাই মোদী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ দক্ষিণ চীন সমুদ্র সীমা সম্পর্কে দিল্লির অবস্থান তুলে ধরে বলেন ভারত বলপ্রয়োগের বিরোধী এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে সমুদ্রপথ এবং সমুদ্র সম্পদ ব্যবহারের স্বাধীনতার সমর্থক৷ ১৯৮২ সালের জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী জাহাজ চলাচল ও সমুদ্র সম্পদ আহরণের অধিকারে ভারত বিশ্বাসী৷ ২০০২ সালের দক্ষিণ চীন সমুদ্র সংক্রান্ত আচরণ বিধি আসিয়ান এবং চীনের মেনে চলা জরুরি৷
উল্লেখ্য, দক্ষিণ চীন সমুদ্র ইস্যু নিয়ে ভারত ও চীনের টানাপোড়েল চলছে বেশ কিছুদিন ধরে৷ দক্ষিণ চীন সাগরে নিয়ে চীনের গা জোয়ারি অবস্থানে দিল্লি স্বভাবতই ক্ষুব্ধ এবং চিন্তিত৷ কেননা চীনের একাধিপত্য ক্রমশই হয়ে উঠছে সর্বগ্রাসী৷ পরিস্থিতি এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছায় যে, দক্ষিম চীন সাগরের ভিয়েতনাম জলসীমার একটি ব্লকে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত অয়েল অ্যান্ড গ্যাস কমিশন তেল উত্তোলনের কাজ শুরু করলে বেজিংয়ের রক্তচক্ষুর জেরে শেষপর্যন্ত পিছু হটতে হয়৷ সম্প্রতি ভিয়েতনামের সমুদ্র সীমায় পারাসেল দ্বীপপুঞ্জের কাছে গভীর সমুদ্রে ভারি ‘অয়েল রিগ' বসায় চীন৷ পাঁচটি ‘লাইট হাউস' তৈরি করে৷ তা সত্ত্বেও সংঘর্ষের পথে গিয়ে পরিস্থিতি আরো ঘোরালো করতে চায় না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আসিয়ান-এর কোনো দেশই৷ আসিয়ান-এর কিছু দেশ আবার অর্থনৈতিক দিক থেকে চীনের ওপর নির্ভরশীল৷ তাই সম্মেলন শেষে যৌথ বিবৃতিতে দক্ষিণ চীন সাগর প্রসঙ্গটিকে লঘু করে দেখাবার চেষ্টা করা হয়৷
সম্মেলনের পার্শ্ব বৈঠকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে যোগদানকারী দেশগুলির সঙ্গে পৃথক পৃথক দ্বিপাক্ষিক স্তরে দক্ষিণ চীন সমুদ্রসহ অর্থনৈতিক, এনার্জি নিরাপত্তা সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়৷ চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনাতেও ওঠে দক্ষিণ চীন সাগর প্রসঙ্গ৷ উভয় দেশ নিজ নিজ দেশের অবস্থান তুলে ধরেন৷ চীনের প্রেসিডেন্টের আসন্ন ভারত সফর যাতে সর্বাংশে ফলপ্রসূ হয় তার জন্য উভয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আগ্রহ প্রকাশ করে৷ আলোচনা হয় জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের সঙ্গে৷ বেসামরিক পরমাণু চুক্তি দ্রুত চূড়ান্ত করার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হয় সর্বাধিক৷
বলা বাহুল্য, অস্ট্রেলিয়া থেকে ইউরেনিয়াম আমদানি করতে চায় ভারত৷ ইউরেনিয়ামের বড় জোগানদার দেশ অস্ট্রেলিয়া৷ বছরে সাত হাজার টন ইউরেনিয়াম রপ্তানি করে থাকে৷