পাকিস্তানে ব্লাসফেমির অভিযোগে প্রায় দশ বছর মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি থাকা আসিয়া বিবি অবশেষে ঠাঁই পাচ্ছেন ফ্রান্সে৷ দেশটির প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ শুক্রবার আসিয়া ও তাঁর পরিবারকে স্বাগত জানাবেন৷
বিজ্ঞাপন
প্রাথমিকভাবে মাক্রোঁর সূচিতে বিষয়টি ছিল না৷ কিন্তু সোমবার আসিয়া বিবি ফ্রান্সে আশ্রয় নেবার ইচ্ছা প্রকাশ করার পর সেদিন সন্ধ্যায়ই প্রেসিডেন্টের অফিস তাঁকে গ্রহণ করার ঘোষণা দেয়৷
সোমবার জার্মান রেডিও নেটওয়ার্ক আরটিএলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে আসিয়া ফ্রান্সে রাজনৈতিক আশ্রয় নেবার আগ্রহের কথা জানান৷
‘‘ফ্রান্সে থেকে যাওয়ার খুব ইচ্ছা আমার,'' আরটিএলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন আসিয়া৷ সম্প্রতি ফ্রেঞ্চ ভাষায় ‘অঁ ফাঁ লিবা' (অবশেষে মুক্ত) নামে তাঁকে নিয়ে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে৷ এর ইংরেজি ভার্সনটি প্রকাশিত হবে সেপ্টেম্বরে৷ আসিয়ার অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করে যাওয়া ফ্রেঞ্চ সাংবাদিক অ্যান-ইজাবেল তোলে এই বইয়ের একজন লেখক৷
‘‘ফ্রান্স আমাকে নতুন জীবন দিয়েছে...অ্যানে-ইজাবেল আমার কাছে ফেরেশতার মতো,'' আসিয়া বলেন৷
২০১৪ সালেই আসিয়াকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেয় ফ্রান্স৷ তখন তিনি কারাগারে ছিলেন৷ মঙ্গলবার সেই প্রত্যয়নপত্রটি আসিয়ার হাতে তুলে দেয়ার কথা প্যারিসের মেয়র অ্যান হিদালগোর৷
২০১৮ সালে তিনি ও তাঁর পরিবার ক্যানাডায় পালিয়ে যাবার পর এটিই আসিয়ার প্রথম ফ্রান্স সফর৷ সাক্ষাৎকারে ক্যানাডাকেও ধন্যবাদ জানান তিনি৷ আসিয়া বলেন, পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইনে আটক অন্যদের মুক্ত করতে তিনি সাংবাদিক তোলের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে চান৷
২০০৯ সালে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী আসিয়া বিবি মুসলিম ধর্মাবলম্বী অন্য মজুরদের সঙ্গে ক্ষেতে কাজ করছিলেন৷ এ সময় পানি নিয়ে বিতণ্ডা দেখা দিলে এক পর্যায়ে একজন মুসলিম নারী স্থানীয় এক ইমামের কাছে গিয়ে অভিযোগ করেন যে, আসিয়া নবী মোহাম্মদকে অবমাননা করেছেন৷
এরপর বিষয়টি পাঞ্জাবের আদালতে গড়ালে তাঁকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেয়া হয়৷ আসিয়া আপীল করলে ২০১৮ সালে সুপ্রিমকোর্ট তাঁকে মুক্তি দেন৷ কিন্তু কট্টরবাদীদের প্রতিবাদের কারণে তাঁর জীবনের নিরাপত্তা শঙ্কা দেখা দেয়ায় তিনি জেল থেকে ছাড়া পাচ্ছিলেন না৷ পরে ২০১৯ সালের মে মাসে তিনি ক্যানাডায় পাড়ি জমান৷
জেডএ/কেএম (ডিপিএ, এএফপি)
২০১৮ সালে সুপ্রিমকোর্টের রায়ের আগে করা ছবিঘরটি দেখুন:
পাকিস্তানের ব্লাসফেমি আইন ও একজন আসিয়া বিবি
আসিয়া বিবি পাকিস্তানের এক খ্রিষ্টান নারী৷৷ ২০১০ সালে তাঁকে পাকিস্তানের এক আদালত ব্লাসফেমির দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়৷ কে এই আসিয়া, কেনই বা তাঁর এই মামলা কেড়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর?
ছবি: picture alliance/dpa
পানি নিয়ে বিরোধ
২০০৯ সালে পাঞ্জাবের শেখুপুরা জেলায় এক মাঠে কাজ করার সময় মহানবি হযরত মোহাম্মদকে অপমান করার অভিযোগ ওঠে আসিয়া বিবির বিরুদ্ধে৷ মাঠে মুসলিম ধর্মাবলম্বী কিছু নারী কাজ করছিলেন৷ আসিয়া বিবি পানি নিতে গেলে ‘অমুসলিম’ বলে তাঁকে পানির পাত্র ধরতে দেননি তাঁরা৷ তারপর তাঁরা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে আসিয়া বেগমের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
স্পর্শকাতর বিষয়
মাঠের বাকবিতণ্ডার পর আসিয়ার বাসায় কিছু ‘ক্ষুব্ধ জনতা’ হামলা চালায় বলে জানায় স্থানীয় সংবাদমাধ্যম৷ পরে পুলিশ আসিয়াকে তাদের হেফাজতে নিয়ে যায় এবং তাঁর বিরুদ্ধে আনা ব্লাসফেমির অভিযোগের তদন্ত শুরু করে৷ ৯৭ শতাংশ মুসলিমের দেশ পাকিস্তানে ধর্ম অবমাননাকে বেশ স্পর্শকাতর বিবেচনা করা হয়৷
ছবি: Arif Ali/AFP/Getty Images
বিতর্কিত আইন
১৯৮০ সালে সেনা শাসক জেনারেল জিয়াউল হক ব্লাসফেমি আইন চালু করেন৷ অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, অনেকক্ষেত্রেই এই আইনকে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা মেটানোর কাজে ব্যবহার করা হয়৷ খ্রিস্টান, হিন্দু, এমনকি ইসলামের সংখ্যালঘু গোত্র আহমাদিয়াদের বিরুদ্ধেও এই আইনের অপপ্রয়োগ করা হয়৷
ছবি: Noman Michael
রাষ্ট্র বনাম আসিয়া
২০১০ সালে এক আদালত আসিয়াকে ধর্ম অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে৷ বাদীর আইনজীবী অভিযোগ করেন, ব্যক্তিগত বিরোধ থেকে তাঁর বিরুদ্ধে ব্লাসফেমির অভিযোগ আনা হয়েছে৷ কিন্তু আদালত আসিয়ার ফাঁসির রায় দেন৷ ২০১০ সাল থেকেই আসিয়ার পরিবার ভয়ের মধ্যে বাস করছে৷ তখন থেকে আসিয়ার মুক্তির জন্য তাঁর স্বামী আশিক মাসিহ আইনি-যুদ্ধ করে চলেছেন৷
ছবি: picture alliance/dpa
গুপ্তহত্যার শিকার সমালোচকরা
২০১০ সালে পাঞ্জাবের তৎকালীন গভর্নর সালমান তাসির আসিয়ার পক্ষে দাঁড়ান৷ ব্লাসফেমি আইনের সংস্কারেরও দাবি তুলে তিনি৷ তাঁর এই অবস্থানে ক্ষুব্ধ হয় চরমপন্থিরা৷ ২০১১ সালে ইসলামাবাদে নিজের দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হন তাসির৷ একই বছর ব্লাসফেমি আইনের আরেক সমালোচক তৎকালীন সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী শাহবাজ ভাট্টিও বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হন৷
ছবি: AP
হত্যাকারীকে সংবর্ধনা
তাসিরের হত্যার পর চরমপন্থি নেতা কাদরি রীতিমতো নায়কে পরিণত হন৷ তাকে কারাগারে নেয়ার সময় লাল গোলাপ ছিটিয়ে সংবর্ধনা দেয়া হয়৷ ২০১৬ সালে কাদরিকে ফাঁসি দেয়া হয়৷ কাদরির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় হাজার হাজার ইসলামপন্থি জড়ো হয়েছিলেন৷ এমনকি কাদরির নামে তার স্মরণে একটি মাজারও প্রতিষ্ঠা করে তার সমর্থকরা৷
ছবি: AP
বিচার বিভাগে ভীতি
ব্লাসফেমি আইনের সমালোচকদের হত্যাকাণ্ডে ভয় ঢুকেছে আইনজীবীদের মধ্যেও৷ আসিয়ার পক্ষে হাই কোর্টে লড়তে কোনো আইনজীবীই সম্মতি জানাননি৷ ২০১৪ সালে লাহোর হাই কোর্ট আসিয়ার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে৷ ২০১৬ সালে এই মামলা সুপ্রিম কোর্টে গেলেও এক বিচারক ‘ব্যক্তিগত’ কারণ দেখিয়ে তাতে অংশ নিতে রাজি হননি৷
ছবি: Reuters/F. Mahmood
আইনের খাড়া
অ্যামেরিকান সেন্টার ফর ল অ্যান্ড জাস্টিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে পাকিস্তানে অন্তত ৪০ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও সেক্যুলার মুসলিমদের এই আইনের লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়৷ এখনো এই আইনের আওতায় কারো বিরুদ্ধে রায় কার্যকর করা না হলেও ক্ষুব্ধ জনতার হাতে মৃত্যুর উদাহরণ রয়েছে অনেক৷
ছবি: APMA
ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ওপর নিপীড়ন
পাকিস্তানে খ্রিষ্টান ও অন্যান্য অমুসলিম ধর্মাবলম্বীরা প্রায়ই আইনি ও সামাজিক বৈষম্যের অভিযোগ করেন৷ গত কয়েক বছরে প্রমাণ ছাড়াই শুধুমাত্র সন্দেহের বশে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে অনেক খ্রিষ্টান ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে৷
ছবি: RIZWAN TABASSUM/AFP/Getty Images
ইসলামপন্থিদের হুমকি
আসিয়ার মৃত্যুদণ্ডের রায় পালটে গেলে ‘ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টির’ হুমকি দিয়ে রেখেছে পাকিস্তানে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা, বিশেষ করে তেহরিক-ই-লাবাইক পাকিস্তান- টিএলপি৷ দেশটির খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের আশংকা, বিচারকরা রায় পালটানোর সিদ্ধান্ত জানালে পুরো দেশজুড়ে তাঁদের ওপর নৃশংসতা শুরু হতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/B. K. Bangash
আন্তর্জাতিক সমর্থন
বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের সরকার ও মানবাধিকার সংগঠন আসিয়ার মামলার সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানিয়েছে৷ আসিয়ার মেয়ে ভ্যাটিকান সিটিতে গিয়ে পোপ ফ্রান্সিসের সাথে দেখা করে এসেছেন৷২০১৪ সালে লাহোর হাই কোর্টের রায়কে ‘ভয়াবহ অবিচার’ আখ্যা দেয় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল৷ অ্যামেরিকান সেন্টার ফর ল অ্যান্ড জাস্টিস আসিয়ার মৃত্যুদণ্ডের রায়ের নিন্দা জানিয়েছে৷