সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীর আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে সবাই হতাশার কথা বললেন৷ বলেছেন রাষ্ট্র, সরকার ও পেশাজীবী ব্যর্থতার কথা৷ তারা বলেন, হত্যাকারীরা ২ বছরেও গ্রেফতার না হওয়া সবার জন্য গ্লানির, অপমানের৷
বিজ্ঞাপন
ঢাকার দৃক গ্যালারীতে সোমবার থেকে শুরু হওয়া ‘ক্রাইম সিন, ডু নট ক্রস' শীর্ষক আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে শুধুই আলোকচিত্র নয়, সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনির ব্যবহৃত স্মৃতিময় জিনিসপত্র স্থান পেয়েছে৷ আছে তাঁদের ব্যবহার করা ল্যাপটপ, প্রেস আইডি কার্ড, কলম, লেখার প্যাডসহ আরো অনেক কিছু৷ আছে পত্রিকার কাটিং৷ সাদা দেয়ালে লেখা আছে, ‘‘আসুন আমরা সাগর-রুনিকে ভুলে যাই''৷ আর এই লেখা ধরে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বললেন, ‘‘কতটা দুঃখ আর হতাশা থেকে এই লেখা তা আমাদেরও বুঝতে হবে৷''
তিনি বলেন, যদি চেষ্টা করেও সাগর-রুনির হত্যাকারীদের চিহ্নিত করা না যেত, তাহলে আপশোস থাকতো না৷ কিন্তু এখানে অবহেলা করা হয়েছে৷ ইচ্ছাকৃতভাবে তদন্তকে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে৷ তিনি আরও বলেন, সাগর-রুনি হত্যার বিচার না হওয়া মানে হল পেশাজীবীদের হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া৷
সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, শুধু রাষ্ট্র বা সরকার নয়, সাংবাদিকদেরও ব্যর্থতা আছে৷ সাংবাদিকরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করলেও সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই৷ তিনি বলেন, সাংবাদিকরা আবারো ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন শুরু করবে৷
নারী নেত্রী খুশী কবির বলেন, আমরা গ্লানি থেকে মুক্তি চাই৷ সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত এখনো শেষ হয়নি৷ বরং এটা নিয়ে নানা ধরনের নাটক করা হচ্ছে৷ আর নাটকের আড়ালে চাপা পড়ছে তদন্ত৷ এটা আমাদেও গ্লানি৷
দৃক-এর ড. শহীদুল আলম বলেন, রাষ্ট্রের দায়িত্ব তার নাগরিকদের নিরাপত্তা দেয়া৷ সরকার নাগরিকদের অধিকার রক্ষার জন্যই ক্ষমতায় আসে৷ আর সরকার যদি সেটা না করে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তাহলে সেই সরকারের দায়িত্বে থাকার কোনো অধিকার নেই৷
আলোকচিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শিল্পী-সাহিত্যিকরাও বক্তব্য রাখেন৷ তাঁরা বলেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি দেশের সাধারণ মানুষকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়৷ সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচার না হলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি আরো প্রকট হবে৷ তাঁরা বলেন, সাগর-রুনির সন্তান মেঘ-এর দায়িত্ব নেয়ার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী থেকে অনেকেই৷ কিন্তু বাস্তবে কেউই দায়িত্ব নেননি৷
কেন খুন হয়েছেন সাগর, রুনি?
সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার এবং মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের তিন বছর পূর্ণ হয়েছে৷ কিন্তু আজও নিহতের পরিবার, শুভানুধ্যায়ী আর সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের মানুষ জানতে পারলো না, কেন এই হত্যাকাণ্ড? এই বিষয়ে ছবিঘর দেখুন এখানে:
ছবি: DW
সেই কালোরাত
২০১২ সালের এগারোই ফেব্রুয়ারি৷ সেদিন খুব ভোরবেলা জানা গিয়েছিল, ঢাকায় নিজের ভাড়া বাসায় খুন হয়েছেন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার এবং মেহেরুন রুনি৷ একই ফ্ল্যাটে থাকলেও প্রাণে বেঁচে যান তাদের একমাত্র শিশুপুত্র মেঘ৷
ছবি: dapd
সাগর সরওয়ার
দেশি-বিদেশি একাধিক গণমাধ্যমে কাজ করার পর ২০১১ সালে মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন সাগর সরওয়ার (ডানে)৷ সর্বশেষ সেই টেলিভিশন চ্যানেলেই কাজ করেছেন তিনি৷ ২০১২ সালের দশই ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে কাজ থেকে বাসায় ফেরার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই খুন হন সাগর৷
ছবি: DW
মেহেরুন রুনি
একাধিক দৈনিকে কাজ করার পর কয়েক বছর আগে টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলায় কাজ শুরু করেন মেহেরুন রুনি (বামে)৷ মাঝে স্বামীর সঙ্গে বছর দেড়েক জার্মানিতে কাটিয়েছেন তিনি৷ এরপর ২০১১ সালে আবারো ফিরে যান নিজের কর্মস্থলে৷
ছবি: DW
৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার!
১১ ফেব্রুয়ারি ভোররাতে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তারের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন৷ বলাবাহুল্য, সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি৷
ছবি: DW
সাংবাদিকদের আন্দোলন
বাংলাদেশের বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের মধ্যে মতের অমিল থাকলেও সাগর-রুনি ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের ঘোষণা প্রদান করে সব সংগঠন৷ খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে গত এক বছরে বেশ কয়েকটি প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে বিভিন্ন সংগঠন৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ
সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে এবং খুনিদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবিতে গর্জে ওঠে বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাঙালিরা৷ জার্মানিসহ কয়েকটি দেশে খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়৷ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনও খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে বিবৃতি প্রকাশ করেছে৷
ছবি: DW
ব্লগারদের প্রতিরোধ
সাংবাদিক সংগঠনগুলোর আন্দোলনের পাশাপাশি ব্লগাররা এই দম্পতি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবিতে রাজপথে নামে৷ গত বছর এই ইস্যুতে ব্লগ ‘ব্ল্যাক আউট’ পালন করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ব্লগ৷ সামহয়্যার ইন ব্লগে এখনো রয়েছে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ব্যানার৷
ছবি: DW
রিপোটার্স উইদাআউট বর্ডার্স
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে রাজপথে ব্লগারদের সক্রিয় আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকাসহ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ইত্যাদি ইস্যুতে ব্লগ লিখে ডয়চে ভেলের দ্য বব্স প্রতিযোগিতার রিপোটার্স উইদাআউট বর্ডার্স অ্যাওয়ার্ড জয় করে আবু সুফিয়ানের বাংলা ব্লগ৷ ছবিতে আন্দোলনরত আবু সুফিয়ান৷
ছবি: DW
নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নাটকীয় ঘোষণা
গত অক্টোবর মাসে নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে ‘জড়িত’ আটজনকে চিহ্নিত করে সাতজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানান৷ বাকি একজনকে গ্রেপ্তার করা হয় গত সপ্তাহে৷ ব়্যাব গ্রেপ্তারকৃতদের বলছে ‘সন্দেহভাজন’৷ আর পরিবার মনে করছে, এদেরকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে কার্যত ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজানো হচ্ছে৷
আন্তর্জাতিক তদন্ত চান পরিবার
সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের এক বছর হলেও তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই৷ ধরা পড়েনি মূল অপরাধীরা৷ তাই তাদের পরিবার এখন আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি করেছেন৷ রুনির ভাই নওশের রোমান জানিয়েছেন, তারা (ব়্যাব) তদন্তের চেয়ে হয়রানি করতে বেশি উৎসাহী৷ সাগর রুনির একমাত্র সন্তান মেঘের নিরাপত্তাও প্রত্যাহার করা হয়েছে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
জজ মিয়া নাটক চান না সাগরের মা
সাগরের মা সালেহা মনির এখনও কাঁদেন৷ তাঁর দাবি হচ্ছে, প্রকৃত অপরাধীদের ধরতে হবে৷ এক বছর পর দারোয়ান এনামুলকে গ্রেফতার তাঁর কাছে জজ মিয়া নাটক ছাড়া কিছুই নয়৷ তাঁর মতে, এক বছরে নানা টালবাহানা করে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা চলছে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
11 ছবি1 | 11
রুনির ভাই নওশের রোমান বলেন, তদন্তের কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় তাঁরা হতাশ হয়ে পড়েছেন৷ তদন্তকারীরা এখন আর তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন না৷ আর তাঁরা উদ্যোগী হয়ে যোগাযোগ করলে বিরক্তি প্রকাশ করেন৷
সাগর-রুনির দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে ‘ক্রাইম সিন ডু নট ক্রস' শিরোনামে সোমবার থেকে শুরু হওয়া ৩ দিনের এই আলোকচিত্র প্রদর্শনী শেষ হবে বুধবার৷ প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত প্রদর্শনী সবার জন্য উন্মুক্ত৷
২০১২ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি ভোররাতে ঢাকার রাজাবাজারের বাসায় সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনিকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়৷