নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীর পাড়ের বাসিন্দাদের কাছে এক আতঙ্কের নাম ভাঙন৷ অনেকের জীবন দুর্বিষহ হয়েছে এই ভাঙনে৷ কেউ হারিয়েছেন পরিবার, কেউ জীবিকা৷ প্রশ্ন হচ্ছে, নদী ভাঙন রোধের কি কোনো উপায় নেই?
বিজ্ঞাপন
নদীর ভাঙনের কারণগুলোর দিকে তাকালে কিন্তু মনে হয়, অনেককিছুই আমাদের হাতে রয়েছে৷ অনেকক্ষেত্রেই আমাদের কারণেই নদী ভাঙন ঘটছে৷ চলুন জেনে নিই নদী ভাঙনের কয়েকটি মানবসৃষ্ট কারণ৷
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নদীর গতি রোখার চেষ্টার কারণে নদীভাঙন ঘটতে পারে৷ অনেক সময় নদীর মাঝখান দিয়ে আড়াআড়িভাবে বাঁধ দেয়ার চেষ্টা করা হয়, যা ভাঙন সৃষ্টি করতে পারে৷ অবশ্য এই কাজ যদি একান্ত করতেই হয় তাহলে আগে নদীর পাড় যথেষ্ট মজবুত করে নিতে হবে৷ অপরিকল্পিতভাবে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের চেষ্টাও নদী ভাঙনের এক বড় কারণ৷
বাংলাদেশে নদী দূষণ
‘এশিয়ান ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট আউটলুক-২০১৬’-র তথ্য অনুযায়ী, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের ৪৮টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূষিত বাংলাদেশের নদীর পানি৷ দূষণের ভয়াবহ শিকার শহরের পার্শ্ববর্তী নদীগুলো৷
ছবি: DW/M. Mamun
দূষণকালো বুড়িগঙ্গা
ভয়াবহ দূষণে বুড়িগঙ্গা নদীর পানি কুচকুচে কালো৷ ঢাকার প্রাণ বলা হয় এই বুড়িগঙ্গাকে৷ কিন্তু দূষণে জর্জরিত নদীটি দিনে দিনে যেন মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
বর্জ্যের নদী
ঢাকার বাবুবাজার এলাকা দিয়ে সরাসরি বর্জ্য মিশ্রিত পানি ফেলা হচ্ছে বুড়িগঙ্গায়৷ ঢাকার বিভিন্ন এলাকার এরকম বেশ কিছু জায়গা থেকে সরাসরি বুড়িগঙ্গায় ফেলা হয় বর্জ্য৷ বুড়িগঙ্গার পানি দূষণের এটি একটি অন্যতম কারণ৷
ছবি: DW/M. Mamun
রাসায়নিকের ব্যাগ থেকে...
বুড়িগঙ্গার পানিতে রাসায়নিক বহন করার ব্যাগ পরিস্কার করছেন শ্রমিকরা৷ পুরনো ঢাকার বেশ কয়েকটি স্থানে নিয়মিত রাসায়নিক বহনের ব্যাগ, কন্টেইনার পরিস্কার করার কারণে এ নদীর পানি দূষিত হচ্ছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
নদীতে রাসায়নিক
পুরনো ঢাকার ইসলামবাগ, শোয়ারিঘাট, কামরাঙ্গিরচরসহ বিভিন্ন এলাকায় বুড়িগঙ্গার তীরজুড়ে চলে প্লাস্টিক পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণের কাজ৷ বিভিন্ন রাসায়নিব দ্রব্য মিশ্রিত এসব প্লাস্টিকের সামগ্রী পরিস্কারের কাজটি সরাসরি করা হয় বুড়িগঙ্গার পানিতে৷
ছবি: DW/M. Mamun
ফল ব্যবসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া!
বুড়িগঙ্গার পানি দূষণের আরেকটি কারণ ফলে ব্যবহৃত প্লাস্টিক জাতীয় মোড়ক, ফোম ইত্যাদি৷ পুরনো ঢাকার বাদামতলী এলাকায় ঢাকার সবচেয়ে বড় ফলের পাইকারী বাজার থেকে এসব অপচনশীল দ্রব্যাদি সরাসরি ফেলা হয় বুড়িগঙ্গায়৷
ছবি: DW/M. Mamun
নদীর আরেক শত্রু ডকইয়ার্ড
বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষেই গড়ে উঠেছে বেশ কিছু ডকইয়ার্ড৷ এসব ডকইয়ার্ডের কারণেও দূষিত হচ্ছে বুড়িগঙ্গা৷ ডকইয়ার্ডের জাহাজের তেল আর পোড়া মবিল এ দূষণে ভূমিকা রাখে৷
ছবি: DW/M. Mamun
পলি ঢাকে পলিথিন
পলিথিনের ব্যাগও বুড়িগঙ্গা দূষণের অন্যতম কারণ৷ বাংলাদেশে পলিথিন ব্যবহারে কিছুটা বিধিনিষেধ থাকলেও বাস্তবে সে আইন কোথাও মানা হয় না৷ ফলে ঢাকা শহরের সর্বত্র অবাধে পলিথিন ব্যবহার করা হয় এবং বিভিন্ন ড্রেন হয়ে ব্যবহৃত সব পলিথিন চলে আসে বুড়িগঙ্গায়৷
ছবি: DW/M. Mamun
নদী যেন ডাস্টবিন
বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী অনেক এলাকার মানুষই সরাসরি বুড়িগঙ্গায় ময়লা-আবর্জনা ফেলেন৷ এসব ময়লা-আবর্জনা বুড়িগঙ্গার পানিতে মিশে যায়৷
ছবি: DW/M. Mamun
নৌ চলাচলও ব্যাহত যখন
বর্ষা মৌসুমে ভাটি থেকে প্রচুর কচুরিপনা এসে বুড়িগঙ্গার পানি ঢেকে ফেলে৷ এ সময়ে এ নদীতে নৌকা ও জাহাজ চলাচল মারাত্মকভাবে ব্যহত হয়৷
ছবি: DW/M. Mamun
তীরে ইটভাটা
বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে বিভিন্ন এলাকায় আছে বেশ কিছু ইটভাটা৷
ছবি: DW/M. Mamun
তুরাগ দখল
এ ছবি ঢাকার আমিনবাজারের কাছের তুরাগ নদের৷ দখলে জর্জরিত এ নদের দুই পাড়৷ দখলকারীরা মূলত প্রভাবশালী বালু আর পাথর ব্যবসায়ী৷
ছবি: DW/M. Mamun
গোসল যখন দূষণের কারণ
ঢাকার মিরপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় তুরাগ নদে গবাদি পশু আর মানুষের গোসল চলছে একই সঙ্গে৷
ছবি: DW/M. Mamun
শীতলক্ষ্যায় শিল্পের অভিশাপ
নারায়ণগঞ্জের শীতালক্ষ্যা নদীও ভয়াবাহ দূষণের শিকার৷ এ নদীর পানি শীত মৌসুমে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে৷ এ নদী দূষণের অন্যতম কারণ এর দুই তীরের অসংখ্য শিল্প কারখানা৷
ছবি: DW/M. Mamun
শীতলক্ষ্যার দুরবস্থা
নরসিংদীর পলাশ এলাকায় একটি শিল্প কারাখানা থেকে রাসায়নিক মিশ্রিত বর্জ্য শীতালক্ষায় ফেলা হচ্ছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
মৃতপ্রায় চাক্তাই
চট্টগ্রামের চাক্তাই এখন প্রায় মৃত৷ অথচ এক সময় এই চাক্তাই খাল ছিল চট্টগ্রামের প্রাণ৷
ছবি: DW/M. Mamun
দূষণের কবলে সুরমা
সিলেট শহরের পাশে কীন ব্রিজের নিচে দূষণে জর্জরিত সুরমা নদী৷ সিলেট শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে এ নদীতে বর্জ্য ফেলার কারণে মারাত্মক দূষিত এ নদীর পানিও এখন ব্যবহারের অনুপযোগী৷
শহরাঞ্চলে পানি নিষ্কাশনের জন্য প্রয়োজনীয় খাল বা নালা দখল করে ফেলায় কিংবা অন্য কোনো কারণে সেগুলো বন্ধ করে ফেলায় বর্ষা মৌসুমে নদীর উপর পানির চাপ অনেক বেড়ে যায়৷ পানির অতিরিক্ত প্রভাবের চাপ তখন পড়ে পাড়ে৷ ফলে সৃষ্টি হয় ভাঙন৷
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে আমি দেখেছি যে, নদীর পাড়ে বেশ খানিকটা জায়গা ছেড়ে দিয়ে ভেতরের দিকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করা হয়৷ ফলে যে অংশ বাঁধের বাইরে থাকে সেই অংশ অরক্ষিত থাকে এবং অনেক সময় ভেঙে যায়৷
নদীর পাড়ের ঘাস, কাশবনসহ অন্যান্য বন উজাড় করে ফেললে মাটি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং পানির তোড়ে ভাঙন সৃষ্টি হয়৷ এছাড়া অপরিকল্পিতভাবে নদী খনন বা ড্রেজিংয়ের কারণে ক্ষতির শিকার হয় নদী৷
আরেকটি বিষয় হচ্ছে দুর্নীতি৷ নদী ভাঙন রোধে নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে৷ দেখা যাচ্ছে, যে প্রক্রিয়ায় এবং যে ধরণের দ্রব্য ব্যবহার করে নদীর পাড় মজবুত করতে বলা হয়, দুর্নীতি করতে গিয়ে তা করা সম্ভব হয় না৷ ফলে সরকারি উদ্যোগ থাকলেও বাস্তবে তা তেমন সহায়ক হয় না৷
উপরেউল্লেখিত মনুষ্যসৃষ্ট এসব কারণ ছাড়াও প্রাকৃতিক কারণেও নদী ভাঙে৷ বাংলাদেশ একটি পলি গঠিত বদ্বীপ৷ এই দ্বীপে ভাঙা-গড়ার খেলা চলছে হাজার হাজার বছর ধরে৷ সেই প্রাকৃতিক খেলা আমাদের পক্ষে বন্ধ করা কঠিন৷ কিন্তু আমরা, মানুষরা, যেসব কারণ সৃষ্টি করেছি, সেগুলো যদি রোধ করা যায়, তাহলে নিঃসন্দেহে নদী ভাঙনের ক্ষতি রোধ সম্ভব হবে৷ প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি এই ব্যাপারে সচেষ্ট হবো?
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷