1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
ব্যবসা-বাণিজ্যবাংলাদেশ

আস্থার সংকটে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার

শহীদুল ইসলাম ঢাকা
২৯ মে ২০২৫

ঢাকার পুঁজিবাজারে প্রতিনিয়তই কমছে সূচক। বাজারে ভালো শেয়ার থাকলেও সেগুলোর দামও কমছে। পাশাপাশি আছে আরো কিছু বড় সংকট, যেসবের কারণে পুঁজিবাজারে ছড়িয়ে পড়ছে আস্থার সংকট৷

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের চিত্র দেখা যাচ্ছে৷
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে ঢাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মোতালেব হোসেন বলেন, আগের সরকার শেয়ারবাজারে লুটপাট করেছে। কিন্তু এই সরকারের যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এলেও তারা শেয়ারবাজার ঠিক করেনি। ছবি: Shahidul Islam Khan

২০১৬ সালের ২০ জুন পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ৩২ লাখ ৭৬৬ জন থাকলেও গত ২৫ মে এই সংখ্যা ১৬ লাখ ৯০ হাজার ২২৭ জনে দাঁড়িয়েছে। গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের দিন পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারী ছিল ১৬ লাখ ৬৮ হাজার ৮৯৫ জন।

গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর তিন দিন দেশে কোনো সরকার ছিল না। নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হতে যাচ্ছে-এমন খবরে পুঁজিবাজারের সূচক বেড়েছিল। কিন্তু সরকার গঠনের পর থেকে আবার তা কমতে থাকে।

পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর দাবি, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন নিজে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। তারা বাজার বিশ্লেষণ করে ঠিক পদক্ষেপও নেয়নি। আস্থার সংকটে ভালো শেয়ারেরও তাই দাম কমছে। সরকার পতন, নতুন সরকার গঠন এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় পুঁজিবাজারে বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। এ ছাড়া পুঁজিবাজারে কারসাজির সঙ্গে জড়িত অনেকের বিরুদ্ধে বর্তমান কমিশন ব্যবস্থা নেওয়ায় নতুন করে বড় বিনিয়োগ হচ্ছে না। আগের বিনিয়োগকারীরাও ভয়ে সরে যাচ্ছেন।

কতটা কমেছে শেয়ারের দাম

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে সোমবার সকালে বিষণ্ন মনে দাঁড়িয়ে ছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী মোবারক হোসেন। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে সব হারিয়েছেন তিনি। তার কাছে এখন সবকিছুই অন্ধকার মনে হচ্ছে।

ডয়চে ভেলেকে মোবারক বলেন, দেড় বছর আগে রহিম আফরোজের শেয়ার ৩৪৪ টাকায় কিনেছিলাম। ফ্লোর প্রাইজ তোলার আগেও দাম ছিল ২৩৭ টাকা। এখন এই শেয়ারের দাম নেমে এসেছে ৬৭ টাকায়। জিপিএস ইস্পাতের ফ্লোর প্রাইজ ৩৪ টাকা থাকলে এর দাম এখন ১৭ টাকা ৬০ পয়সায় নেমেছে। আমার কেনা সব শেয়ারের দাম তলানিতে নেমেছে। আমরা পরিচিত একজনের এক কোটি টাকার শেয়ার আছে, তিনি এখন ২০ লাখও পাবেন না। সবই লুটপাট হয়ে গেছে।

শরিফুল ইসলাম নামে আরেক বিনিয়োগকারী বলেন, সাইফ পাওয়ারের ৩০ টাকার শেয়ারের দাম এখন ৭ টাকা। ভালো-মন্দ সব শেয়ারের দামই কমেছে। আমার যতগুলো শেয়ার আছে সবগুলোর দাম কমেছে, আমি এখন অনেকটা নিঃস্ব। সামনে কি আছে তা কেউ বলতে পারবে না।

‘ইউনুস সরকার গঠনের পর মানুষ আশা করেছিল পুঁজিবাজার ভালো হবে’

This browser does not support the audio element.

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে ঢাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মোতালেব হোসেন বলেন, আগের সরকার শেয়ারবাজারে লুটপাট করেছে। কিন্তু এই সরকারের যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এলেও তারা শেয়ারবাজার ঠিক করেনি। কে ক্ষমতায় থাকবে আর কে ক্ষমতায় থাকবে না সেটি দেখে বড় বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করবে না, এটাই স্বাভাবিক। এই সরকার আর কতদিন ক্ষমতায় থাকবে তা কেউ বলতে পারছে না।

কোম্পানি তালিকাভুক্তিতে কারসাজি

অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পুঁজিবাজারে নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্তিতে কারসাজি হলেও তখনকার নিয়ন্ত্রণ কমিশন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এখন এসব কোম্পানির প্রকৃত অবস্থা সামনে আসার পর সেগুলোর শেয়ারের দাম পড়ে গেছে। অন্যদিকে ভালো কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দামও প্রতিনিয়ত কমছে। 

কমিশন সূত্র জানায়, কোম্পানি তালিকাভুক্তি থেকে শুরু করে পুঁজিবাজারে বিভিন্ন কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিগত কমিশনের সময় অভিযোগ দাখিল করা হয়। কিন্তু ওই কমিশন তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের একজন কর্মকর্তা বলেন, বর্তমান কমিশন আগের অভিযোগের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ায় বাজারে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। নতুন করে বড় বিনিয়োগকারীরা আর আসছে না। আগে যারা বিনিয়োগ করেছিলেন তারাও সরে যাচ্ছেন। বিনিয়োগকারীদের মনে ভয় ধরেছে। বাজারে তার প্রভাব পড়েছে। আগে বাজার চাঙা করে নিয়ন্ত্রণ কমিশন এসবে হাত দিলে ভালো হতো।

উদ্যোগ নেই সরকারে, দায় নিয়ন্ত্রণ কমিশনের

পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় পুঁজিবাজারকে না রাখা, নিয়ন্ত্রণ সংস্থা হিসেবে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের অদক্ষতা এবং বেসরকারি বিনিয়োগ আনতে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়াকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এস এম ইকবাল হোসেন বলেন, ‘‘পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীরা ভাষাহীন হয়ে গেছে। গত ১৫ বছরের পুঁজিবাজারকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়েছে। মুহাম্মদ ইউনুস সরকার গঠনের পর মানুষ আশা করেছিল পুঁজিবাজার ভালো হবে। গত ৫ আগস্টের পর যখন কমিশনে চেয়ারম্যান ছিলেন না তখন ইনডেক্স ভালো বেড়েছিল। আমরা ধারণা করেছিলাম পুঁজিবাজার এভাবেই চলবে এবং বিনিয়োগকারীরা তাদের পুঁজি ফিরে পাবেন।''

বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের সমালোচনা করে ইকবাল হোসেন বলেন, ‘‘মার্কেটের ধারাবাহিক পতন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে পুঁজিবাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনার পরিবর্তে তিনি আজরাইল রূপে আবির্ভূত হয়েছেন। তিনি দায়িত্বে নেওয়ার পর পুঁজিবাজারের ইনডেস্ক ১২০০ পড়ে গেছে। পুঁজিবাজার থেকে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার মতো ক্যাপিটাল লস হয়েছে।''

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ব্রোকারেজদের সংগঠন ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডিবিএ)-র সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘‘কনফিডেন্সের অভাবে বিনিয়োগকারীদের ধরে রাখা যাচ্ছে না। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০ শতাংশ ইনডেক্স হারিয়েছি।''

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল আমিন মনে বলেন, ‘‘পুঁজিবাজারে কোম্পানি তালিকাভুক্তি নিয়ে কারসাজি হলেও আগের নিয়ন্ত্রক সংস্থা তা দেখভাল করেনি। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ওপর সেসব শেয়ার চাপিয়ে দেওয়া হয়। এখন বিনিয়োগকারীরা তার খেসারত দিচ্ছেন।''

আল আমিন বলেন, ‘‘গত ১৬ বছরে পুঁজিবাজারে যেসব কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে অডিটরেরা সঠিকভাবে ফাইন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্ট অডিট করেননি। যেসব অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি এগুলোকে নিয়ে এসেছে তারাও ঠিকমতো তদারকি করেনি। ফলে নাম সর্বস্ব কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে। কোম্পানির গ্রোথ না করে তারা একটি কাগজ বিক্রি করেছে। তাদের উদ্দেশ্যে ছিল শেয়ার বিক্রি করে মানুষের কাছ থেকে টাকা নেওয়া, এ জন্য বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’’

ঘুড়ে দাঁড়ানোর প্রত্যাশা

সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘‘গত ১৫ বছর ধরে পুঁজিবাজারে সুষ্ঠুভাবে কিছুই চলেনি। এখানে লিস্টিং থেকে শুরু করে করপোরেট গভর্নেন্স, অ্যাকাউন্টেবিলিটি, ট্রেডিং সবকিছুই নন কমপ্লায়েন্ট ছিল। ...গত ১০ বছরে ৭০ শতাংশ কোম্পানি জাঙ্ক স্টক হয়েছে, তারা ডিভিডেন্ট দেয়নি, তাদের ফাইন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্ট স্বাস্থ্যবান নয়। ফ্লোর প্রাইজের নামে শেয়ারের একটি কৃত্রিম দাম ধরে রাখা হয়েছে। ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হয়েছে। এখন প্রধান উপদেষ্টা পাঁচটি বিষয় বাস্তবায়নের নির্দেশনা দিয়েছেন। সরকারে একটি পজিটিভ টোন দেখা যাচ্ছে, এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নতুন আশা জাগাবে। কারণ পুঁজিবাজারে পারসেপশনটা ম্যাটার করে। বিনিয়োগকারীরা রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে চায়। কিন্তু যদি রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়, সেখানে বিনিয়োগকারীরা কনসার্ন হয় এবং কনশাস হয়।''

‘কনফিডেন্সের অভাবে বিনিয়োগকারীদের ধরে রাখা যাচ্ছে না’

This browser does not support the audio element.

এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের দিকে মনযোগ দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন আল আমিন৷ তিনি বলেন, ‘‘ভালো শেয়ার তো এখনো আছে। সবাই বাজর থেকে বেরিয়ে গেলে হবে না। ১৫ বছরের ক্ষত খুব অল্প সময়ে ঠিক করা সম্ভব না। যে শেয়ারের দাম ২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল হয়তো সেটিই ছিল অতিরিক্ত দাম, ওই শেয়ার দেড় শ টাকায় বিক্রি হয়েছে।’’

অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় শেয়ার বাজার ছিল না দাবি করে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, ‘‘তারা অন্য কাজ, দাবি-দাওয়া মেটাতেই ব্যস্ত রয়েছে। বাজার আগেই পড়ে ছিল এবং এই বাজার ধ্বংসের জন্য যে আগের সরকার দায়ী সেটি কম-বেশি সবাই বিশ্বাস করেন। পুঁজিবাজারের পতনের সঙ্গে সরকার নিজের পতনের সম্পর্ক খুঁজে পায়নি। ফলে পুঁজিবাজার সরকার স্থিতিশীল রাখতে চাইলেও তাদের অগ্রাধিকারে নেই। দেশের অর্থনীতি, ভাবমূর্তি ও সরকারের প্রতি জনগণের মনোভাবে ক্ষতি হয়েছে। দেরিতে হলেও সরকার অনুধাবন করছে কিন্তু খুব বেশি দেরি হয়ে গেছে।''

পুঁজিবাজারে আস্থার সংকটতৈরি হওয়ার জন্য আগের সরকােরের পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কার নিয়ন্ত্রণ সংস্থার পদক্ষেপেরও সমালোচনা করেন মিনহাজ মান্নান৷ তিনি বলেন, ‘‘নতুন কমিশন বেশি ক্ষতি করেছে। তারা বাজারের মূল সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পারেননি। তারা দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিয়েছেন। এখানে জরুরি ভিত্তিতে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার ছিল, তা নেওয়া হয়নি। স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কমিশনের দূরত্ব রয়েছে। ফলে কমিশনের ওপর তারা আস্থা হারিয়েছে। কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কমিশনকে উৎখাত করতে আন্দোলন করেছে। যে কমিশনকে বাজারের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সেই কমিশন নিজের শৃঙ্খলাই ফিরিয়ে আনতে পারেনি। বিনিয়োগকারীদের আস্থা কীভাবে পাবে? একটি তদন্ত কমিশনের মাধ্যমে রাতারাতি ব্যাপক পরিমাণ জরিমানা করায় বড় বিনিয়োগকারীদের মনে ভয় ধরেছে। ''

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ