আহমদিয়াদের ওপর হামলা, লুটপাট ও হত্যা মামলায় ৭ হাজার আসামি
৬ মার্চ ২০২৩
পঞ্চগড়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা-অগ্নিসংযোগ-লুটপাট, হত্যা এবং গুজব ছড়িয়ে আইন-শঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর ঘটনায় পুলিশ এরই মধ্যে মোট ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে৷
বিজ্ঞাপন
এসব অভিযোগে ইতিমধ্যে তিনটি মামলা করা হয়েছে৷ মামলায় সাড়ে ছয় থেকে সাত হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে বলে ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান পঞ্চগড় সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) দুলাল হোসেন৷
রাতে তিনি বলেন, এর মধ্যে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের জাহিদ হাসান হত্যা মামলার বাদী হয়েছেন ওসমান গনী৷ বাকি দুটি মামলার বাদী পুলিশ৷
শুক্র থেকে রোববার তিন দিনব্যাপী আহমদিয়া সম্প্রদায়সালানা জলসার আয়োজন করে৷ এই জলসা বন্ধ ও আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণার দাবিতে বৃহস্পতিবার থেকে পঞ্চগড় শহরে মিছিল ও সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে বিক্ষুব্ধরা ৷
এরই ধারাবাহিকতায় শুক্রবার জুমার নামাজের পর শহরে বড় মিছিল হয়৷ এ সময় মিছিলকারীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে৷ ট্রাফিক পুলিশের স্টেশন, পঞ্চগড় বাজার মার্কেটে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনের দোকানপাট ভাঙচুর এবং বিকালে আহমদিয়াদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে৷
এ সময় শহরের মসজিদ পাড়া মহল্লার ফরমান আলীর ছেলে আরিফুর রহমান এবং আহমদিয়া সম্প্রদায়ের জাহিদ হাসান নিহত হন বলে পুলিশ জানায় ৷
এরই ধারাবাহিকতায় শনিবার রাতে দুজনকে আহমদিয়ারা গলা কেটে হত্যা করেছে দুষ্কৃতকারীরা এমন গুজব ছড়ায়৷দুষ্কৃতকারীরা বিভিন্ন স্থানে গিয়ে নিজেরা লাশ দেখে এসেছেন জানিয়ে লোকজনকে উত্তেজিত করে তোলে৷ এ নিয়ে ফের পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় স্থানীয় বিক্ষুদ্ধ জনতা৷ এ সময় দুটি দোকান ভাঙচুর করে মালামাল লুটপাট এবং একটি মাইক্রোবাসে আগুন দেওয়া হয়৷
এ ঘটনায় গ্রেপ্তার পঞ্চগড় শহরের রাজনগর মহল্লার নুর আজাদের ছেলে ইসমাইল হোসেন ঝানু (২৫) এবং তুলারডাঙ্গা মহল্লার মো. আফছারের ছেলে মো. রাসেলকে (২৮) সরাসরি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে বলে পঞ্চগড় সদর থানার ওসি আব্দুল লতিফ মিঞা জানিয়ে আরও বলেন, এ ছাড়া গুজব ছড়ানোর মামলায় শহরের রাজনগর মহল্লার সোলায়মান আলীর ছেলে পৌর যুবদলের যুগ্ম-আহ্বায়ক ফজলে রাব্বী (৩০) এবং তেঁতুলিয়ার সাতমোড়া এলাকার নজরুল ইসলামের ছেলে রাব্বী ইমনকে (২৬) গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷
ধর্মীয় সম্প্রীতি বাড়াতে কতিপয় উদ্যোগ
বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে সম্প্রীতি বাড়ানোর লক্ষ্যে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়ে থাকে৷ ছবিঘরে থাকছে বিস্তারিত৷
ছবি: Reuters/M. Rossi
জাতিসংঘের উদ্যোগ
প্রতিবছর ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ‘বিশ্ব আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি সপ্তাহ’ উদযাপন করে জাতিসংঘ৷ ধর্ম যা-ই হোক, সব মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখা এর উদ্দেশ্য৷ এই সময় রাষ্ট্রগুলোকে গির্জা, মসজিদ, সিনাগগ, মন্দির ও অন্যান্য উপাসনালয়ে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি ও শুভেচ্ছার বার্তা প্রচারে উৎসাহিত করে জাতিসংঘ৷ জর্ডানের রাজা দ্বিতীয় আব্দুল্লাহ ২০১০ সালে এমন সপ্তাহ পালনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন৷
ছবি: Eduardo Munoz/AP/picture alliance
পোপ ও আল-আজহারের ইমামের উদ্যোগ
মিশরের আল-আজহারের গ্র্যান্ড ইমাম শেখ আহমেদ আল-তায়েব ও পোপ ফ্রান্সিস ২০১৯ সালে ‘বিশ্ব শান্তি ও একসাথে বসবাসের জন্য মানব ভ্রাতৃত্বের নথি’তে সই করেন৷ এই নথির উপর ভিত্তি করে ২০২০ সালে জাতিসংঘ ৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মানব ভ্রাতৃত্ব দিবস’ ঘোষণা করে৷ এদিন মানব ভ্রাতৃত্ব স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বিশ্বের যে কোনো ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে ‘জায়েদ অ্যাওয়ার্ড ফর হিউম্যান ফ্র্যাটার্নিটি’ দেয়া হয়৷
ছবি: Reuters/M. Rossi
সৌদি বাদশাহর উদ্যোগ
২০০৮ সালে সৌদি বাদশাহ আব্দুল্লাহর উদ্যোগে স্পেনের মাদ্রিদে একটি আন্তঃধর্মীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল৷ মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সম্প্রীতি বাড়ানোর লক্ষ্যে এই সম্মেলন আয়োজন করা হয়েছিল৷ বৌদ্ধ, হিন্দু ও শিখদেরও সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সৌদি বাদশাহ৷
ছবি: Victor R. Caivano/AP Photo/picture alliance
পোপ ও সৌদি বাদশাহর উদ্যোগ
২০১২ সালে ভিয়েনায় ‘কিং আব্দুল্লাহ বিন আব্দুলআজিজ ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইন্টাররিলিজিয়াস অ্যান্ড ইন্টারকালচারাল ডায়ালগ’ বা কেএআইসিআইআইডি প্রতিষ্ঠিত হয়৷ এটি একটি আন্তঃসরকারি সংস্থা, যা সংঘাত প্রতিরোধ ও সমাধানের জন্য আন্তঃধর্মীয় ও আন্তঃসাংস্কৃতিক সংলাপকে উৎসাহিত করে৷ ২০০৭ সালে পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট ও সৌদি বাদশাহ আব্দুল্লাহর বৈঠকের পর এই সংগঠন তৈরি করা হয়৷
ছবি: CHROMORANGE/IMAGO
বাংলাদেশের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ
‘ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সচেতনতা বৃদ্ধিকরণ’ নামে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প আছে৷ এর আওতায় বিভিন্ন জেলায় আন্তঃধর্মীয় সংলাপের আয়োজন করা হয়৷ এছাড়া গতবছর জুলাইতে বছরব্যাপী একটি কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়৷ এর আওতায় ওয়েব ড্রামা সিরিজ, টিভি কমার্শিয়াল, নাটক, টক শো, মিউজিক ভিডিও ও ডকুমেন্টারি তৈরির পরিকল্পনা করা হয়৷ এছাড়া সম্প্রীতি ও সচেতনতামূলক বার্তা-সমৃদ্ধ লিফলেট, পোস্টার, বিজ্ঞাপন তৈরিরও পরিকল্পনা করা হয়৷
ছবি: Privat
বাংলাদেশের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ
‘ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সচেতনতা বৃদ্ধিকরণ’ নামে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প আছে৷ এর আওতায় বিভিন্ন জেলায় আন্তঃধর্মীয় সংলাপের আয়োজন করা হয়৷ এছাড়া গতবছর জুলাইতে বছরব্যাপী একটি কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়৷ এর আওতায় ওয়েব ড্রামা সিরিজ, টিভি কমার্শিয়াল, নাটক, টক শো, মিউজিক ভিডিও ও ডকুমেন্টারি তৈরির পরিকল্পনা করা হয়৷ এছাড়া সম্প্রীতি ও সচেতনতামূলক বার্তা-সমৃদ্ধ লিফলেট, পোস্টার, বিজ্ঞাপন তৈরিরও পরিকল্পনা করা হয়৷
ছবি: Joy Saha/Zumapress/picture alliance
আন্তর্জাতিক সংস্থার আয়োজন
বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে শান্তি ছড়িয়ে দিতে ১৯৭০ সালে ‘রিলিজিয়নস ফর পিস’ আরএফপি সংগঠন যাত্রা শুরু করে৷ এর সদরদপ্তর নিউইয়র্কে৷ সংগঠনটি নিজেদের বিশ্বের সবচেয়ে বড় আন্তঃধর্মীয় বেসরকারি সংস্থা মনে করে৷ জার্মান সরকারের আর্থিক সহায়তায় ২০১৯ সাল থেকে জার্মানির লিন্ডাও শহরে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করছে আরএফপি৷
ছবি: Christoph Strack/DW
জার্মানিতে আন্তঃধর্মীয় সম্মেলন
প্রতি দুই বছরে একবার জার্মানির লাইপসিশে বিভিন্ন ধর্মের শীর্ষ নেতৃবৃন্দদের নিয়ে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়৷ এতে প্রোটেস্ট্যান্ট, ক্যাথলিক, রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চ, ইহুদি, মুসলিম, বৌদ্ধ ইত্যাদি ধর্মের প্রতিনিধিরা অংশ নেন৷
ছবি: DW
বিভিন্ন ধর্মের শিক্ষার্থীদের মধ্যে কথার আদান-প্রদান
২০০২ সালে ইহুদি বন্ধু ও খ্রিস্টান এক কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে ‘ইন্টারফেইথ ইয়ুথ কোর’ গঠন করেছিলেন এবু প্যাটেল নামের এক মুসলিম যুবক৷ লক্ষ্য ছিল, বিভিন্ন ধর্মের শিক্ষার্থীর মধ্যে কথা আদান-প্রদান করা৷ এছাড়া ক্ষুধার্তদের খাওয়ানো ও শিশুদের পড়াশোনা করানোর কাজগুলোও একসঙ্গে করতেন তারা৷ সংগঠনটি ‘ইন্টারফেইথ অ্যামেরিকা’ নাম ধারণ করে এখনও সক্রিয় আছে৷ তাদের লক্ষ্য, আন্তঃধর্মীয় সহযোগিতাকে স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত করা৷
ছবি: Stephen Shugerman/Getty Images
9 ছবি1 | 9
এদিকে এ ঘটনায় আরও মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে জানান জেলা পুলিশ সুপার এস এম সিরাজুল হুদা৷
রাতে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "এখন পর্যন্ত তিনটি মামলা
হয়েছে৷ এতে মোট ২৪ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে৷ আরও মামলার প্রস্তুতি চলছে৷ যেহেতু অনেকগুলো ঘটনাস্থল, তাই যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে৷”
"গুজব ছাড়ানো মামলা যুবদল নেতা ফজলে রাব্বি এবং আরেকজনকে প্রযুক্তির সহায়তায় তেঁতুলিয়া থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ পুলিশ এ ঘটনায় জড়িত নূর ইসলাম নামে আরেকজনকে খুঁজছে৷ তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে৷ ফজলে রাব্বি এবং নূর ইসলাম মোটরসাইকেলে করে দুজনকে গলা কেটে হত্যা করেছে-এমন গুজব ছড়িয়েছেন৷ ”
"হত্যা মামলায় যে দুজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, তারা ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন৷”
জেলা পুলিশের প্রধান আরও বলেন, শহরে পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি ও র্যাবের টহল রয়েছে৷ গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত আছে৷ পুলিশ এ ঘটনায় কাউকে ছাড় দেবে না৷”