1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আহা, যদি ‘কুম্ভকর্ণ' হতাম...

১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

আজ যখন ঢাকায় যাই বা ভারতের কোনো মহানগরীতে, মনে হয় কেন কুম্ভকর্ণ হয়ে জন্মাইনি? তেমনটা হলে কী ভালোই না হতো! দেশে গিয়ে আজও কেমন আয়েশ করে ঘুমাতে পারতাম৷ কোনো শব্দই আমার ঘুম ভাঙাতে পারতো না!

ছবি: DW/M. M. Rahman

খুব ছোট্টবেলার কথা৷ তখনও ঘুম ভাঙতো মোরগের ডাকে, পায়রার বকবকুমে অথবা প্রতিবেশীর গলা সাধার আওয়াজে৷ মা-ও টেনে উঠেয়ে দিতেন৷ বলতেন, পড়তে বসো অথবা পাশের বাড়ি রিংকুর মতো সা-রে-গা-মা করে গলাটা একটু ঝালিয়ে নাও৷ কে কার কথা শোনে? চাদরটা আবারো মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতাম দু'চোখ বন্ধ করে৷ তারপর কানে আসতো পিছনের শীতলা মন্দিরের ঘণ্টার ধ্বনি অথবা মসজিদের আজান৷ কাগজওয়ালা কাগজ দিয়ে যেত, ভারি জল৷ রিকশার টুং টাং, ফেরিওয়াল হাঁকাহাঁকি, বাঁশিওয়ালার সুর, রান্নাঘরে ছ্যাৎ করে কড়াইতে মশলা ছাড়া অথবা মাছ ভাজার শব্দ – এভাবেই শুরু হতো সকালটা৷

না, আমি কোনো অজপাড়াগাঁয়ে বড় হইনি৷ ছোটবেলার বেশিরভাগ সময়ই আমার কেটেছে কলকাতা অথবা ঢাকায়৷ বিশ্বাস হচ্ছে না? আসলে আজকাল আমারই তো বিশ্বাস হয় না৷ আজকাল দেশে গেলে বেশিরভাগ সময়ই কানে তুলো দিয়ে রাখি৷ ভাই ব্যাঙ্গ করে বলে, ‘‘দিদিটা বিদেশি হয়ে গেছে৷''

কথাটা ঠিক কিনা জানি না৷ তবে ঢাকা-কলকাতা-দিল্লি-মুম্বই – এ সব শহরে জানলা খুললেই গোটা পৃথিবীটা যেন ঝমঝম করে ওঠে৷ বাড়িতে বাড়িতে তারস্বরে চলছে টেলিভিশন আর রাস্তায় ক্রিকেট বা ফুটবলের ধারা বর্ণনা অথবা মাইকে মাইকে হিন্দি গান – তা সে পুজো হোক বা ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্প৷ বারো মাসে তেরো পাবন কিনা! আর এদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মসজিদগুলোও দিচ্ছে মাইকগুলোর ‘ভলিউম' বাড়িয়ে৷

ফলে শুধু শব্দদূষণই নয়, হচ্ছে রাজনীতিও৷ এই তো গত জুলাই মাসেই ভারতের কোনো একটি রাজ্যে নতুন পাঠ্য বইগুলোতে লিখে দেওয়া হয়েছিল – ‘শব্দদূষণ ছড়ায় মসজিদ৷' তাহলেই বুঝুন!

আসলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি পরিবেশ দূষণ যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে উন্নত জীবনশৈলীর প্রতি মানুষের আগ্রহ৷ উন্নত জীবন মানেই নাকি টপ-মডেলের গাড়ি, বিরাট স্ক্রিনের টেলিভিশন, ডলবি সাউন্ড-সিস্টেম সমৃদ্ধ মিউজিক সিস্টেম, আরো কত কী!

মনে পড়ে, ছোটবেলায় একবার শান্তিনিকেতনে যাচ্ছিলাম৷ পথে বেশ যানজট ছিল৷ আমাদের গাড়িটা কিছুতেই এগোতে পারছিল না৷ সামনে যে ছিল একটা অতিকায় ট্রাক৷ তার পিছনে লেখা – ‘জোরে জোরে হর্ন দিন'৷ হায় রে ভারতবর্ষ! সেই ‘হর্ন' দেওয়াই যে আজ কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে....৷ রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে হর্ন দেওয়ার মাত্রাও৷ কারুর যে আজ আর সময় নেই৷ তথাকথিত জীবনযুদ্ধে বেরিয়ে পড়েছে মানুষ৷ আপনি একটু ধীর গতিতে পা ফেলেছেন কি আপনাকে ঠেলে-গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য নিমিষের মধ্যে এগিয়ে আসবে অসংখ্য হাত, হয়তবা পা-ও৷ তাই তো বলছি – অভিধানে লিখে নিন, এরই নাম ‘উন্নয়ন'৷

ভারতের রাজ্যে রাজ্যে আজ পানীয় জল নেই, লক্ষ লক্ষ মানুষের নেই দু'বেলা পেট ভরে খাওয়ার খাবার, নেই সবার জন্য শিক্ষার ব্যবস্থাও৷ কিন্তু তাতে কী? আমাদের যে স্যাটেলাইট আছে, পারমাণবিক অস্ত্র আছে, বিদেশি গাড়ি, দিল্লির অদূরে গুরগাঁও বা মুম্বইয়ের কাছে থানের মতো ‘হাই-টেক মেগা-সিটি' আছে৷ আছে আগাছার মতো গড়ে ওঠে কলকারখানা৷ আর তার সঙ্গে আছে শব্দদূষণ৷ জোর যার, মুলুক তার – আপামর ভারতবাসী শুধু নয়, দক্ষিণ এশিয়ার সমস্ত মানুষই যেন এই মন্ত্রেই দিক্ষীত৷ তাই শ্রুতিসীমা অতিক্রমকারী শব্দ সৃষ্টি তারা করছে নিজেদের ইচ্ছেতেই৷ এতে করে পাশের মানুষ, পাশের গাড়ি, প্রতিবেশী বা নিজের শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলো কিনা, তা নিয়ে চিন্তা করার সময় আছে নাকি কারুর? এই উপমহাদেশে তো পরিবেশ দূষণের জন্য রাস্তায় রাস্তায় আতশবাজি বন্ধ করলে, মানুষ বাড়ির ছাদে গিয়ে বাজি পোড়ায়৷ ফায়ারব্রিগেড বা অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ এলে রাস্তা ছেড়ে দেওয়ার বদলে মহামূল্যবান কাজে দেরি হয়ে যাওয়ার ভয়ে সেই গাড়ি আগে অথবা ফাঁকা রাস্তার আশায় তার পিছনে গিয়ে লাইন লাগায়...৷

অথচ ক'দিন আগে বাজার করে ট্যাক্সি থেকে নামার সময় কিছুতেই টাকার ব্যাগটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না৷ ছোট্ট গলি, তার ওপর রাতও হয়েছে৷ আমারও তাড়া আছে৷ কিন্তু কোন ব্যাগের মধ্যে মানিব্যাগটা রাখলাম? পিছনে ততক্ষণে অন্য একটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে৷ আমার অস্বস্তি হতে শুরু করলো৷ কিন্তু ট্যাক্সি-ড্রাইভার বললেন, অসুবিধা নেই৷ আপনি ধীরে-সুস্থে খুঁজুন৷ এটা ‘ওয়ানওয়ে'৷ যতক্ষণ না আপনার টাকা দেওয়া শেষ হবে পিছনের গাড়ির কিছু করার নেই৷ ওকে দাঁড়াতেই হবে৷ হর্নও দিতে পারবে না৷

দেবারতি গুহ, ডয়চে ভেলে

ভাবছেন, এমন আবার হয় নাকি? হয়, কারণ দেশটা জার্মানি৷ এ ঘটনা যদি ভারত বা বাংলাদেশে ঘটতো, তবে, আমি তো বটেই, ট্যাক্সি-ড্রাইভারও নিশ্চয় মার খেয়ে যেতেন৷ আর হর্নে হর্নে কানের পর্দাটাই হয়ত যেতো ফেটে৷ জার্মানি বলেই তেমনটা হয়নি৷ বরং পিছনের গাড়িটি প্রায় মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে আমি টাকা দিয়ে নেমে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল৷

বিজ্ঞান বলে, মানুষ সাধারণত ২০ থেকে ২০ হাজার ডেসিবেলের কম বা বেশি শব্দ শুনতে পায় না৷ ভারতবর্ষের যা অবস্থা, তাতে এমনটা চললে সেই দিন আর দূরে নেই, যেদিন আমরা সবাই বধির হয়ে যাবো৷

তাই তো আজকাল দেশে গেলে কখনও ছেলেবেলার সেই বাঁশিওয়ালাদের খুঁজি৷ আবার কখনও মনে হয়, আহা, আমিও যদি কুম্ভকর্ণের মতো অঘোরে ঘুমাতে পারতাম!

ব্লগটি কেমন লাগলো, লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ