এক বছর আগে তুরস্কের তটভূমিতে ভেসে উঠেছিল তিন বছর বয়সের সিরীয় শিশু আয়লান কুর্দির লাশ৷ দুনিয়ার বিবেকের ভিত নড়িয়ে দিয়েছিল সেই ছবি৷ জার্মানির ‘বিল্ড' পত্রিকার সঙ্গে এবার কথা বলেছেন আয়লানের বাবা আবদুল্লাহ কুর্দি৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানির সবচেয়ে জনপ্রিয় ট্যাবলয়েড ‘বিল্ড' পত্রিকায় বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হয়েছে সেই সাক্ষাৎকার৷ আবদুল্লাহ কুর্দির সবচেয়ে বড় দুঃখ হলো, সিরিয়ায় যুদ্ধ ও সহিংসতা এখনও বন্ধ হয়নি, যেমন সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে উদ্বাস্তুদের মৃত্যুও সমানে চলেছে৷
৪১-বছর-বয়সি আবদু্ল্লাহ ইজিয়ান সাগরে হারিয়েছেন তাঁর স্ত্রী ও আয়লানসহ দুই সন্তানকে৷ ‘‘আমার পরিবারের মানুষদের মৃত্যুর পর রাজনীতিকরা বলেছিলেন, ‘আর কখনো নয়!''' - বিল্ড পত্রিকাকে বলেন আবদুল্লাহ কুর্দি৷ ‘‘সকলেই কিছু করতে চেয়েছিলেন, ছবিটা এমনভাবে তাদের নাড়া দিয়েছিল৷ কিন্তু এখন কী হচ্ছে? এখনও মানুষ মরছে, অথচ কেউ কিছু করছে না৷
‘বিভীষিকার অন্ত চাই'
আয়লান ছাড়াও, আবদুল্লাহ কুর্দি তাঁর সেই অভিশপ্ত সমুদ্রযাত্রায় হারান বড় ছেলে গালিব ও স্ত্রী রেহাবকে৷ সকলকে সমাধি দেওয়া হয়েছে কোবানি শহরে৷ আবদুল্লাহ এখন থাকেন ইরবিল শহরে৷ ইরাকের কুর্দি সরকারের আমন্ত্রণে সেখানে গিয়েছেন তিনি৷
তাঁর মৃত শিশুসন্তানের ছবি যে সিরিয়া থেকে পলায়নপর মানুষদের ট্র্যাজেডির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে, আবদুল্লাহ তাতে বিচলিত নন৷ ‘‘ও রকম একটা ঘটনা মানুষকে দেখাতে হবে, যাতে তারা বুঝতে পারে, কী ঘটছে৷ কিন্তু ছবির কারণে বিশেষ কিছু বদলায়নি৷ সিরিয়ার বিভীষিকা - সেই সঙ্গে যারা পালাচ্ছে তাদের বিপর্যয় বন্ধ করতে হবে৷''
আই ওয়ে ওয়ে-র প্রতীকী পদক্ষেপ
চীনা শিল্পী আই ওয়ে ওয়ে যে ঠিক আয়লানের মতো সৈকতে শুয়ে পড়ে তাঁর প্রতিবাদ ও সহানুভূতি জানান, আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে তা বিপুলভাবে সমালোচিত হয়েছিল৷ আবদুল্লাহও চমকে দেয় আই ওয়ে ওয়ে'র সেই ছবি, কেননা, ‘‘আমাকে আগে জিজ্ঞেস করা হয়নি, কাজেই আমি ভীষণ চমকে গিয়েছিলাম৷ আমি জানি যে আই ওয়ে ওয়ে উদ্বাস্তুদের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলেন, সেটা ভালো কথা৷ কিন্তু আমার কথা ভাবা উচিৎ ছিল৷ আমি (আয়লানের) বাবা, আমাকে সেই স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে৷''
ব্লাড পয়জনিং নিয়ে এক মাস হাসপাতালে ছিলেন আবদুল্লাহ৷ তাই ডাক্তারদের পরামর্শে স্ত্রী ও দুই সন্তানের কবরে যাননি৷ ‘‘আমি সর্বক্ষণ আয়লান, গালিব আর রেহাবের কথা ভাবি,'' বললেন আবদুল্লাহ কুর্দি৷ জানালেন, তিনি যখন ইটালির উপকূলে বিপন্ন উদ্বাস্তুদের ছবি দেখেন, তখন ‘‘সেই নৌকার বিভীষিকার কথা মনে পড়ে; আমি আর দেখতে পারি না৷''
আয়লান এবং আয়লানকে নিয়ে ছবি...
আয়লান কুর্দি৷ সিরিয়ার সেই শিশু, যার মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা নিথর দেহ ‘মানবাধিকার’, ‘মানবতা’-কে এখনো কটাক্ষ করে৷ এখনো তাকে স্মারণ করে সবাই৷ তার ছবি আঁকা হয়৷ অধিকার আদায়ের লড়াইয়েও ফিরে ফিরে আসে আয়লান কুর্দি৷
ছবি: Reuters/Y. Herman
মা ও সন্তান
রেহান কুর্দির কোলে তাঁর ছোট ছেলে আয়লান৷ কোবানির একটি বাড়িতে এখনো আছে এই ছবি, তবে ছবির দু’জন মানুষ আর নেই৷ সিরিয়া থেকে তুরস্ক হয়ে গ্রিসে যাওয়ার পথেই ফুরিয়েছে তাদের জীবন চলার পথ৷ এ খবর সারা বিশ্বকে জানিয়েছিল অন্য একটি ছবি৷
ছবি: Getty Images/Courtesy of Kurdi family
এ ছবি এখনো কাঁদায়
একটি ছবি হঠাৎ বদলে দিলো ইউরোপে অভিবাসী হতে আগ্রহীদের ভাগ্য৷ আয়লান কুর্দির এই ছবি৷ তুরস্কের উপকুলে এভাবেই পড়ে ছিল ৩ বছরের শিশুটির নিথর দেহ৷ মা-বাবা আর ভাইয়ের সঙ্গে আয়লানও কোবানির বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল নিরাপদ জীবনের খোঁজে৷ এভাবে চিরবিদায় নিতে হয় তাকে!
ছবি: picture-alliance/AP Photo/DHA
আয়লান জাগিয়ে গেল
আয়লানের ওই ছবি নাড়িয়ে দেয় বিশ্ববিবেক৷ ইউরোপে আসার পথে যেখানে হাজারো মানুষ শত বাধার মুখে এক সময় হার মানতো, প্রাণ দিতো, সেখানে ধীরে ধীরে অনেকটাই খুলে গেল ইউরোপের দ্বার৷ অভিবাসন প্রত্যাশীরা অবাধে আসতে শুরু করল মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকা থেকে৷
ছবি: Reuters/H. P. Bader
যেভাবে বিদায় জানালো জন্মভূমি
দুই সন্তান আর স্ত্রী-কে হারিয়ে নিরাপদ জীবনের প্রতি আগ্রহহারিয়ে ফেলেন আয়লানের বাবা আব্দুল্লাহ কুর্দি৷ তাই গ্রিস হয়ে ইউরোপের উন্নত কোনো দেশে নতুন করে জীবন শুরু করার ইচ্ছে জলাঞ্জলি দিয়ে ফিরে যান সিরিয়ায়৷ তাঁর কোবানির বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় স্ত্রী ও দুই সন্তানের মৃতদেহ৷ জানাযা শেষে ওই শহরেই সমাধিস্থ করা হয় তাদের৷
ছবি: Getty Images/AFP/Stringer
কান্না আর আহাজারি
আব্দুল্লাহ কুর্দি তাঁর পরিবারের সদস্যদের মরদেহ নিয়ে বাড়ি ফিরলে কান্নার রোল উঠেছিল কোবানিতে৷ আয়লানদের জন্য কোবানি এখনো কাঁদে৷
ছবি: Reuters/R. Said
আয়লান এখন প্রতিবাদের প্রতীক...
অভিবাসনপ্রত্যাশীদের কাছে আয়লান এখন প্রতিবাদের প্রতীক৷ ইউরোপে যেখানেই অভিবাসন প্রত্যাশীদের প্রতিবাদ, সেখানেই থাকে আয়লানের ছবি৷ অভিবাসন প্রত্যাশীদের প্রতিবাদ-বিক্ষোভের এই ছবিটি প্যারিসের৷
ছবি: Reuters/P. Wojazer
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদর দপ্তরেও আয়লান
ছবির এই নারী আয়লানের আত্মীয়া, নাম ফাতিমা কুর্দি৷ সোমবার ব্রাসেলসে জাতিসংঘের সদর দপ্তরের বাইরে এক প্রতিবাদ সমাবেশে ছিলেন তিনি৷ ইউরোপের দেশগুলোতে অভিবাসন আইনের সমন্বয়ের দাবিতে আয়োজিত সেই সমাবেশেও ছিল আয়লানের ছবি৷ তবে সেই ছবি নয়, সেই ছবির আদলে হাতে আঁকা একটি ছবি দেখা যায় দেয়ালে৷ সেই ছবির পাশেই দাঁড়িয়ে ফাতিমা কুর্দি৷