আয়াতোল্লাহ খামেনি এবং মধ্যপ্রাচ্যে ‘চূড়ান্ত সমাধান’
২৬ মে ২০২০
নানা সংকটে দেশ যখন বিপর্যস্ত তখন জনগণকে বিভ্রান্ত করতে পরীক্ষিত অস্ত্রই ব্যবহার করেছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ আলি খামেনি৷
বিজ্ঞাপন
খামেনির সেই পরীক্ষিত অস্ত্র হলো পুরাতন শত্রু ইসরায়েলের বিষোদগার করা ৷ শুক্রবার ‘কুদুস ডে' তে ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন জানাতে এবং ইসরায়েলের বিষোদগার করতে গিয়ে তিনি এমনকি ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর টার্ম ব্যবহার করতেও পিছপা হননি৷
১৯৭৯ সালে ইরানে ‘ইসলামিক রেভ্যুলেশন-র পরপরই প্রথম ইরানে ‘কুদস ডে' পালন শুরু হয়৷ ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন জানাতে ইরান রমজান মাসের শেষ শুক্রবার এ দিবস পালন করে৷
এ উপলক্ষ্যে গত ২২ মে টেলিভিশনে ৩০ মিনিটের ভাষণ দেন খামেনি৷ ওই ভাষণে তিনি প্রথমবারের মত কৌশলে ফিলিস্তিনকে অস্ত্রের যোগান দেওয়ার বিষয়টিও স্বীকার করেন৷
ভাষণে খামেনি ইসরায়েলকে ‘ক্যান্সারাস টিউমার’ বলেন, যেটিকে ‘নিশ্চিতভাবেই উপড়ে ফেলে ধ্বংস করা হবে’৷
ভাষণে তিনি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘দ্য ফাইনাল সল্যুশন’ কথাটিও ব্যবহার করেন৷ ইউরোপজুড়ে ইহুদি নিধনের সময় নাৎসি বাহিনী এ বাক্যটি ব্যবহার করতো৷
জার্মানিতে নাৎসি শাসনামলে ‘চূড়ান্ত সমাধান’ নামে নাৎসি বাহিনী ইউরোপ জুড়ে ৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যা করেছিল৷
আলি খামেনির জন্য সময়টা এখন মোটেও সহজ না৷ অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে দেশটির অবস্থায় ভীষণ নাজুক৷ অথচ গত ৩০ বছর ধরে খামেনি দেশটির সুপ্রিম লিডার বা সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার আসনে৷
বর্তমানে আন্তর্জাতিক বিশ্ব থেকে ইরান প্রায় বিচ্ছিন্ন৷ অন্যদিকে, দেশের অভ্যন্তরে বিক্ষোভ দানা বাঁধছে৷ জনগণ নানা অভিযোগ নিয়ে আওয়াজ তুলছে৷ দেশের এ অবস্থায় চাপাবাজি করে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে খামেনির হাতে ইসরায়েল ছাড়া বিকল্প তেমন কিছু নেইও৷
এছাড়া, তিনি এবং তার সরকার সাম্প্রতিক সময়ে অন্য দেশের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেগুলো দেশে বা দেশের বাইরে তেমন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি৷
ফলে এই সময়ে খামেনি তার দীর্ঘদিনের কৌশলই অবলম্বন করেছেন৷ আর সেটা হলো নিজেকে জাহির করতে পুরাতন শত্রুর কথা বলা এবং জনগণের নজর সেদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া৷ আর এই কৌশলে ইসরায়েল সবচেয়ে সুবিধাজনক শত্রু৷
‘গণতন্ত্রে ভয়’
গত ২১ মে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ এক টুইটে লেখেন, ‘‘কেন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমারা গণতন্ত্রকে এত ভয় পাচ্ছে?’’
জারিফ গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলছেন৷ অথচ তিনি যে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করেন সেটি রিপোর্টাস উইদাউট বর্ডাস-র ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৭৩ নম্বরে অবস্থান করছে৷
মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে ইরানের গণতন্ত্র চর্চা নিয়ে খুব বেশি নম্বর দেওয়া হয়নি৷
২০১৯ সালের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী বেআইনিভাবে শক্তি প্রয়োগ করে বিক্ষোভ দমন করেছে, শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে এবং হাজার হাজার বিক্ষোভকারীকে যথেচ্ছা ধরে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে আটকে রাখা হয়েছে৷’’
অর্থনৈতিক দুর্দশা এবং ব্যাপক দুর্নীতি
ইরানের অর্থনৈতিক অবস্থাও অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়েছে৷ দেশটিতে এ বছর মুদ্রাস্ফ্রীতি ৩১ শতাংশে গিয়ে পৌঁছেছে৷ সরকারি হিসাবে বেকারত্বের হার ১৭ শতাংশ৷ দেশের সর্বস্তরে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে৷ দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইও এখন সংশয়াপন্ন৷ তাই ইরান সরকারের হাতে জাহির করার মত তেমন কিছুই এখন আর নেই৷
ক্যার্সটেন কিনিপ/এসএনএল/কেএম
ইরানের শত্রু-মিত্র
১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পর থেকে ইরানের সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর সর্ম্পকের অবনতি ঘটে৷ প্রভাব পড়ে বাকি দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগেও৷ ছবিঘরে দেখুন ইরানের আজকের শত্রু-মিত্র কারা, কার সঙ্গে তার কেমন সম্পর্ক৷
ছবি: picture-alliance/epa/A. Taherkenareh
যুক্তরাষ্ট্র: বন্ধু থেকে শত্রু
১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় মোসাদ্দেক সরকার উৎখাত হওয়ার পর ইরানের ক্ষমতায় আসেন রেজা শাহ পাহলভি৷ পরর্বতী ২৬ বছর ইরান-যুক্তরাষ্ট্র ছিল একে অপরের বন্ধু৷ ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবে শাহ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এই সম্পর্ক শত্রুতায় রূপ নেয়৷ ১৯৮০ সাল থেকে দুই দেশের মধ্যে কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই৷ একে অপরকে তারা সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবেও অ্যাখ্যায়িত করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/C. Barria
ইসরায়েল: আন্তরিকতা থেকে অবিশ্বাস
তুরস্কের পর ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়া ২য় মুসলিম দেশ ইরান (১৯৫০ সাল)৷ রেজা শাহের শাসনকালে দুই দেশের মধ্যে আন্তরিক সম্পর্ক ছিল৷ ১৯৭৯ সালে খোমেনি ক্ষমতায় এসে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইসরায়েলকেও শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেন৷ তেহরান পরমানু অস্ত্র বানাচ্ছে বলে ১৯৯০ সালের পর থেকে অভিযোগ করছে ইসরায়েল৷ দেশটির বিরুদ্ধে হামাস ও হেজবোল্লাহকে মদদ দেয় ইরান৷ অন্যদিকে ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রেকে সমর্থন দেয় ইসরায়েল৷
ছবি: AP
সৌদি আরব: ঘাড়ের কাছে শত্রু
মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতা বিস্তারের লড়াইয়ে ইরানের চিরশত্রু সৌদি আরব৷ ১৯৭৯ সালে তেহরানের ক্ষমতায় পরিবর্তন আসার পর থেকেই তা প্রকট আকার ধারণ করেছে৷ দুই দেশ কখনও সরাসরি যুদ্ধে না জড়ালেও চলছে তাদের ছায়াযুদ্ধ৷ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তারা একে অপরের বিরুদ্ধে বিবদমান গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তা দেয়৷ গত বছরের সেপ্টেম্বরে সৌদির দুইটি তেলক্ষেত্রে হামলার পেছনে ইরান রয়েছে বলে দাবি করেছে রিয়াদ৷
ছবি: picture-alliance/AA/E. Yorulmaz
রাশিয়া: দখলদার থেকে মিত্র
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইরানে আস্তানা গাড়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন৷ যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও কয়েকবছর দখলদারি বজায় রাখে তারা৷ শাহের শাসনামলেও সম্পর্ক ভাল ছিল না৷ এমনকি ইরাক-ইরান যুদ্ধে সাদ্দামকে সহায়তা দিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন৷ তবে ১৯৯১ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে ইরান হয়ে ওঠে মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার কৌশলগত অংশীদার৷
ছবি: AP GraphicsBank
ইউরোপ: আলোচনায় সমাধান
ইরানের ইসলামিক বিপ্লবের পর ইউরোপের সঙ্গেও তেহরানের সম্পর্ক শীতল হয়ে ওঠে ৷ তবে প্রেসিডেন্ট আলী আকবর রাফসানজানির সময়ে এই সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হয়৷ পরমাণুসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ইইউ বরাবরই ইরানের সঙ্গে আলোচনার উপর জোর দিয়ে আসছে৷ ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে পরমাণু কার্যক্রম স্থগিতকরণ চুক্তি বাতিল করলেও ইউরোপের দেশগুলো তা এখনও বজায় রেখেছে৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/N. Economou
চীন: অস্ত্র আর বাণিজ্যের সম্পর্ক
১৯৮০ সালে ইরান-ইরাক যুদ্ধে তেহরানকে অস্ত্র সরবরাহ করেছিল চীন৷ বেইজিংয়ের শীর্ষ তিনটি অস্ত্র ক্রেতা দেশের একটি ইরান৷ অন্যদিকে ইরানের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার চীন৷ যদিও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর সেখান থেকে তেল আমদানি ব্যাপকভাবে কমিয়ে দিতে হয়েছে চীনকে৷ কাসেম সোলেইমানিকে হত্যাকাণ্ডের পর চীন জানিয়েছে তেহরানের সঙ্গে বেইজিংয়ে সম্পর্ক অটুট থাকবে৷
ছবি: AP / DW-Fotomontage
ইরাক: সর্ম্পকে নতুন মোড়
সাদ্দাম হোসেনের চালানো হামলা থেকে শুরু হওয়া ইরাক-ইরান যুদ্ধ অব্যাহত ছিল আট বছর৷ তবে বর্তমানে বাগদাদের শিয়া নেতৃত্বাধীন সরকারের সাথে সুসম্পর্ক রয়েছে তেহরানের৷ দেশটির একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠীকেও সামরিক সহযোগিতা দিয়ে আসছে ইরান৷ এইসব গোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে ইরাকে অবস্থানরত মার্কিন বাহিনীর উপর হামলা চালানোর অভিযোগ রয়েছে৷
কথিত আছে লেবাননের হেজবোল্লাহ গোষ্ঠীর উত্থান ইরানের মাধ্যমেই৷ তাদের মূল টার্গেট মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের শত্রু ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের আস্তানাগুলো৷ ২০১৮ সালে হেজবোল্লাহ ও তাদের জোট দেশটির নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে৷ যার মধ্য দিয়ে লেবাননের সরকারে ইরানের প্রভাব আরো বেড়েছে৷ এছাড়াও ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহী আর ফিলিস্তিনের হামাস ইরানের মিত্রশক্তি৷
ছবি: Reuters/O. Sanadiki
ভেনেজুয়েলা: শত্রু যখন একই
অবরোধ, অর্থনৈতিক সঙ্কট আর দুই দেশের একই শত্রু, ইরান-ভেনেজুয়েলাকে নিয়ে এসেছে কাছাকাছি৷ ২০০১ সালে ইরানের মোহাম্মদ খাতামি আর ভেনেজুয়েলার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হুগো চাভেজের মাধ্যমে সহযোগিতামূলক এই সম্পর্কের গোড়াপত্তন৷ আহমদিনেজাদ ক্ষমতায় আসার পর তা আরো নিবিড় হয়৷ একক শত্রু যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়তে দুইদেশ বেশি কিছু চুক্তিও করেছে৷
ছবি: picture-alliance/AA/ABACA/Iran Presidency
বাংলাদেশ: পাঁচ দশকের সম্পর্ক
১৯৭১ সালের পর থেকে ইরানের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক৷ বিভিন্ন সময়ে দুই দেশের রাষ্ট্রীয় সফর অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ ১৯৯৫ সালে প্রেসিডেন্ট রাফসানজানি ঢাকা এসেছিলেন৷ গত বছরের সেপ্টেম্বরে আসেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভাদ জারিফ৷ অক্টোবরে বাকুতে ন্যাম সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসার রুহানি ‘সাইডলাইন বৈঠক’ করেন৷ গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ১.৭৭ কোটি ডলারেরর পণ্য রপ্তানি করেছে দেশটিতে৷