ক্যাথলিক নানদের পরিচালিত একটি ‘মা ও শিশু’ নিবাসের কাছে প্রায় ৮০০ শিশুর একট অনামি গণকবর আবিষ্কৃত হবার পর, আইরিশ সরকার এবার অন্যান্য স্থানেও অনুসন্ধান চালানোর অভিপ্রায় ঘোষণা করেছেন৷
বিজ্ঞাপন
৭৯৬টি শিশুর এক গণকবর৷ শিশু বলতে নবজাতক থেকে শুরু করে আট বছর বয়সের শিশু৷ কাউন্টি গলওয়ে-র টুয়াম শহরের কাছে একটি ‘মাদার অ্যান্ড বেবি হোম'৷ সেখানকার সেপটিক ট্যাংকে এই গণকবরের খোঁজ পান ইতিহাসবিদ ক্যাথেরিন করলেস৷ সেই মলমূত্র ফেলার চৌবাচ্চাতে কোনোরকম কফিন অথবা স্মৃতিফলক ছাড়াই কবর দেওয়া হয়েছিল মৃত শিশুদের, ১৯২৫ থেকে ১৯৬১ সালের মধ্যে৷ অবিবাহিত মা ও তাঁদের শিশুদের জন্য সেন্ট মেরি'জ হোম নামধারী এই নিবাসটি চালাতেন বন সেকুর সিস্টার্স নামধারী ক্যাথলিক যাজিকা গোষ্ঠী৷
সুস্থ পরিবেশেই গড়ে ওঠে সুস্থ জীবন
শিশুর প্রথম নিঃশ্বাস থেকে স্কুল জীবন শেষ করা এবং তারও পরে সন্তানের ভালো-মন্দের সাথে থাকেন তার বাবা-মা৷ কিভাবে ছোট্ট শিশুকে একজন সুস্থ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব, তারই গল্প এই ছবিঘরে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মায়ের গর্ভ
মায়ের গর্ভে থাকার সময় থেকেই শিশুর ভালোর জন্য সব কিছু করেন বাবা-মা৷ সত্যিকার অর্থে সুস্থ পরিবেশই শিশুকে সুস্থ, সুন্দর ভবিষ্যৎ দিতে পারে৷ তবে সুস্থ পরিবেশ বলতে কী বোঝায়, সেটা খুব বুঝে-শুনে ঠিক করতে হয় মা-বাবাকে৷ আর এর জন্য সন্তান কী চায়, অর্থাৎ তার মন এবং শরীরকে বোঝা অত্যন্ত জরুরি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মায়ের দুধ দিয়ে শুরু
শিশুকে জন্মের সাথে সাথেই মায়ের দুধ পান করানো উচিত বলে মনে করেন বার্লিনের শিশু ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ডা. ফ্রাংক ইয়োখুম৷ তাঁর কথায়, ‘‘মায়ের দুধে আছে শিশুদের প্রয়োজনীয় সব পুষ্টিগুণ৷ শিশু মায়ের দুধ পানের মাধ্যমে মায়ের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতাটিও পায়৷ এর ফলে শিশুরা নানা রকম রোগের সংক্রমণ থেকে যেমন রেহাই পায়, তেমনই বড় বয়সে ডায়বেটিস বা অতিরিক্ত ওজন সমস্যার মতো অসুখ থেকেও কিছুটা দূরে থাকে৷’’
ছবি: Fotolia/evgenyatamanenko
মায়ের খাবার
মা যতদিন শিশুকে দুধ পান করাবেন, ততদিন অবশ্যই তাঁর খাবার তালিকায় সব ধরনের খাবার থাকতে হবে৷ বিশেষ করে চর্বিযুক্ত মাছ, তাজা ফল ও সবজি৷ কারণ মাছের তেল শিশুদের মস্তিস্ক গঠনে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে৷ মা সব কিছু খেতে পারলেও, লক্ষ্য রাখতে হয় যে শিশুর শরীর সে খাবার কিভাবে গ্রহণ করছে৷ এছাড়া মায়ের দুধ পান করার মাধ্যমেই কিন্তু শিশুরা বিভিন্ন খাবারের স্বাদও পেতে থাকে৷
ছবি: Fotolia/WavebreakmediaMicro
শক্ত খাবার
বাচ্চাদের চার মাস বয়স থেকে প্রথম শক্ত খাবার দেয়া যায়৷ তবে শিশুদের জন্য তৈরি বিশেষ ‘বেবিফুড’ বা ঘরে রান্না করা খাবার অবশ্যই দিতে হয় ছয় মাস বয়স থেকে৷ এর কারণ, তখন আর শুধু মায়ের দুধ যথেষ্ট নয়৷ তবে সে সময় ‘‘লক্ষ্য রাখতে হবে যে শিশুর খাবারে বড়দের তুলনায় যেন মসলা এবং লবণ কম থাকে’’৷ এমনই পরামর্শ দেন ডা. ইয়োখুম৷
ছবি: Fotolia/victoria p
শাক-সবজি
অনেক সময় বাচ্চারা সবুজ-সবজি বা ফলমূল খেতে চায় না৷ তখন অনেক মা-বাবা গল্প করে, আদর করে সেগুলো তাদের খেতে বলেন, অনেকে আবার জোরও করেন৷ অথবা সালাদ বা পাতে দেয়া সবজিটুকু খেয়ে নিলে সে একটা চকলেট বা আইসক্রিম পাবে – এমন লোভও দেখিয়ে থাকেন তাঁরা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বাচ্চারা নকল করে
ডা. ইয়োখুম জানান, ‘‘মা-বাবা নিজেরা যদি নিয়মিত শাক-সবজি এবং ফলমূল খেতে অভ্যস্ত হন অথবা পছন্দ করেন, তবে সেটা খুব ছোট বয়স থেকেই সন্তানদের সামনে করা বা দেখানো যেতে পারে৷ কারণ শিশুরা বাবা-মাকে যা করতে দেখে সেটা নিজেরাও নকল করে, যা পরবর্তীতে অভ্যাসে পরিণত হয়৷’’
ছবি: Fotolia/Tatyana Gladskih
পুষ্টিগুণই যথেষ্ট
শিশুরা কোনো একটা সবজি বা ফল না খেলে জোর করার তেমন কোনো প্রয়োজন নেই, বলেন ডা. ইয়োখুম৷ বরং বাচ্চারা যেসব খাবার পছন্দ করে, সেসব খাবার সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ আছে কিনা – সেদিকে লক্ষ্য রাখলেই যথেষ্ট৷
ছবি: Fotolia/Subbotina Anna
লোভনীয় মিষ্টি খাবার
বাজারে শিশুদের জন্য নানা রকম লোভনীয় মিষ্টি খাবার সাজানো থাকে, যা থেকে দূরে থাকাই ভালো৷ কারণ শিশুকাল থেকে সেসব খাবারে অভ্যস্ত হয়ে গেলে বড় বয়সেও শরীর তা পেতে চায়৷ বলা বাহুল্য, ‘লো ফ্যাট’ দুধেও রয়েছে যথেষ্ট ক্যালসিয়াম এবং ফসফরাস, যা শিশুদের হাড় শক্ত করতে সাহায্য করে৷ তাই বেশি মিষ্টি বা ফ্যাটের কোনো প্রয়োজনই নেই!
ছবি: picture-alliance/dpa
স্বাস্থ্যকর পানীয়
বড়দের শরীরের তুলনায় বাচ্চাদের শরীরে বেশি পানি প্রয়োজন৷ তবে তাদের জন্য সবচেয়ে ভালো ট্যাপ ওয়াটার অথবা মিনারেল ওয়াটার৷ জার্মানিতে ট্যাপের পানি পান করা নিরাপদ৷ তাছাড়া ঘরে করা ফলের জুস, চা ইত্যাদি পান করা যেতে পারে৷ তবে বাজারের কেনা ‘আইস টি’, ফান্টা বা জুস নয়৷ কারণ সে সবে দেয়া থাকে প্রচুর চিনি৷ অবশ্য মাঝে মধ্যে যে এক, আধ গ্লাস পান করা যাবে না – তা কিন্তু নয়!
ছবি: Fotolia/Elenathewise
সাধারণভাবে বড় হওয়া
সারাদিন ঘরে বসে কম্পিউটারে খেলা বা টিভি দেখা নয়৷ যতটা সম্ভব বাইরে খেলাধুলা করার সুযোগ করে দেওয়া প্রয়োজন বাচ্চাদের৷ তার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন হবি বা খেলাধুলার জন্য ক্লাবে ভর্তি করে দিলে শিশুরা অন্য বাচ্চাদের সাথে মিলে-মিশে, হেসে-খেলে স্বাভাবিকভাবে বড় হয়ে উঠতে পারবে৷
ছবি: SerrNovik - Fotolia
বয়ঃসন্ধিকাল
এই বয়সে কেউ যেমন আর বাচ্চা নয়, আবার সবকিছু বোঝার মতো যথেষ্ট বড়ও নয়৷ কিশোর-কিশোরীরা এ বয়সে অন্য রকম কিছু করতে চায়, দেখতে চায় বা নানা কারণে মানসিক সমস্যাও হতে পারে তাদের৷ তাই বাবা-মায়ের উচিত সন্তানদের মনের অবস্থা বুঝে সেভাবে বাধা না দিয়ে শারীরিক ও মানসিক সমস্যাগুলি সুন্দভাবে বুঝিয়ে দেয়া এবং অবশ্যই একজন বন্ধুর মতো আচরণ করা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নার্ভ শক্ত রাখতে হবে
ডা. ইয়োখুমের মতে, বয়ঃসন্ধিকাল অর্থাৎ শিশুর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এই সময়ে নানা ধরণের পরিস্থিতির জন্য বাবা-মাকে নার্ভ শক্ত রাখতে হবে এবং কিছু কিছু ব্যাপারে তাদের ‘সাপোর্ট’-ও করতে হবে৷ একমাত্র তবেই সন্তানরা বয়ঃসন্ধিকাল সহজভাবে পার করে আস্তে আস্তে দায়িত্বশীল হয়ে উঠতে পারবে৷
ছবি: DW/Li Fern Ong
বন্ধুর মতো সহজ সম্পর্ক
সন্তান এবং বাবা-মায়ের ভেতরের সম্পর্ক যদি বন্ধুর মতো হয়, তাহলে অনেককিছুই অনেক সহজ হয়ে যায়৷ এই সম্পর্কে তৈরি করতে অবশ্য বেশ খানিকটা সময় একসাথে কাটানো খুব দরকার৷ আজকের এই যান্ত্রিক জীবনে সময় পাওয়া কঠিন হলেও সময় বের করে নেওয়াটা কিন্তু খুবই জরুরি৷ কারণ শিশুর সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে ‘সময়’ মহা মূল্যবান!
ছবি: picture-alliance/dpa
13 ছবি1 | 13
করলেস-এর আবিষ্কার ক্যাথলিক আয়ারল্যান্ডের ভিত নড়িয়ে দিয়েছে বললে হয়ত বেশি বলা হবে৷ অপরদিকে এ-ও সত্য যে, মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর জরুরি তদন্ত দাবি করেছে এবং আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী এন্ডা কেনি তাঁর কর্মকর্তাদের ‘‘সব সরকারি বিভাগ থেকে উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের নিয়ে'' বিবেচনা করে দেখতে বলেছেন, কেলেঙ্কারির আয়তন কতটা, ঘটনাটাই বা কি, তা একক ঘটনা কিনা এবং দেশের অন্যত্র পরিস্থিতি যাচাই করে দেখার প্রয়োজন আছে কিনা৷''
বিংশ শতাব্দীর সূচনায় আয়ারল্যান্ডে বহু ‘মা ও শিশু নিবাস' ছিল৷ গোঁড়া ক্যাথলিক আয়ারল্যান্ডে অবিবাহিত মায়েদের প্রায়ই এ' ধরনের ‘হোম' ছাড়া কোনো গত্যন্তর ছিল না৷ গতবছর ‘ফিলোমেনা' নামধারী একটি কাহিনিচিত্র অস্কারের জন্য মনোনীত হয়৷ ‘ফিলোমেনা' ছিল ফিলোমেনা লি নামের এক আইরিশ মহিলার কাহিনি৷ পঞ্চাশের দশকে ফিলোমেনা তাঁর অবৈধ সন্তানকে পরিত্যাগ করতে এবং দত্তক হিসেবে দিতে বাধ্য হন৷ ঘটনাটা ঘটে টিপেরারি-র সন রস অ্যাবি বা খ্রিষ্টীয় মঠে৷
মোট কথা হলো, সে আমলে কোনো অবিবাহিত মহিলা সন্তানসম্ভবা হলে, আয়ারল্যান্ডের গোঁড়া রক্ষণশীল সমাজ ‘পতিতা' অপবাদ দিয়ে তাঁকে সমাজচ্যুত করতো৷ অনেক সময় সেই মহিলার পরিবার এবং আত্মীয়স্বজনই তাঁকে পরিত্যাগ করতো৷ এই অবস্থায় সেই অসহায় মহিলার কোনো মাদার অ্যান্ড বেবি হোমে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকতো না৷
হোমগুলির পরিস্থিতিও খুব সুখকর ছিল না৷ ইতিহাসবিদ ক্যাথেরিন করলেস সেন্ট মেরি'জ হোমের ডেথ রেকর্ডগুলি ঘেঁটে দেখেছেন, শিশুরা মারা গেছে অপুষ্টি, নিউমোনিয়া এবং অন্যান্য ছোঁয়াচে রোগে৷ আয়ারল্যান্ডের বর্তমান শিশুমন্ত্রী চার্লি ফ্ল্যানাগান বৃহস্পতিবার আইরিশ সংসদে বলেছেন: ‘‘আয়ারল্যান্ডের মাদার অ্যান্ড বেবি হোমগুলোর ইতিহাসে সমাজের অমানুষিক, নির্মম প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলন ঘটেছে৷''
আর এই সব অভাগা শিশুদের মৃতদেহ সেপটিক ট্যাংকে ফেলার রহস্য হলো: সে আমলের রক্ষণশীল ক্যাথলিক শিক্ষা অনুযায়ী বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরে যে সব শিশুর জন্ম, তাদের ব্যাপটাইজ করা অথবা পবিত্র গোরস্থানে গোর দেওয়া নিষিদ্ধ ছিল৷