বাংলাদেশে নতুন অর্থবছরের বাজেটে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ছে৷ তবে করমুক্ত আয়সীমার নিচে থাকলেও নির্দিষ্ট সরকারি সেবা পেতে নাগরিকদের ন্যূনতম দুই হাজার টাকা কর দিতে হবে৷
বিজ্ঞাপন
আসছে অর্থবছরে বার্ষিক সাড়ে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ক্ষেত্রে কর দিতে হবে না৷ প্রস্তাবিত বাজেটে বিদ্যমান তিন লাখ টাকা থেকে করমুক্ত আয়ের এই সীমা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী৷
নারী ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সের করদাতাদের ক্ষেত্রে সাড়ে তিন লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে করমুক্ত আয়ের সীমা চার লাখ টাকা করা হয়েছে৷ ‘প্রতিবন্ধী' ব্যক্তি করদাতাদের ক্ষেত্রে সাড়ে চার লাখ থেকে বেড়ে হয়েছে চার লাখ ৭৫ হাজার টাকা৷ গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা করদাতারা পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করলে কোনো কর দিতে হবে না, যা আগে ছিল চার লাখ ৭৫ হাজার৷ তৃতীয় লিঙ্গের করদাতাদের ক্ষেত্রে করমুক্ত আয়ের সীমা সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পয়েছে৷ আগে সাড়ে তিন লাখ পর্যন্ত আয়ের ক্ষেত্রে তাদের আয়কর দিতে হতো না৷ এখন তা এক লাখ ২৫ হাজার টাকা বেড়ে চার লাখ ৭৫ হাজার টাকা করা হয়েছে৷
এদিকে ব্যক্তি করদাতাদের করহারের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না৷ অর্থাৎ সাড়ে তিন লাখের পর পরবর্তী এক লাখ টাকার পাঁচ শতাংশ কর দিতে হবে৷ তিন লাখের জন্য ১০ শতাংশ, চার লাখের জন্য ১৫ শতাংশ, পাঁচ লাখের জন্য ২০ শতাংশ আর অবশিষ্ট টাকার উপর ২৫ শতাংশ কর দিতে হবে৷
উল্লেখ্য ২০২০-২১ অর্থবছর থেকেই ব্যক্তিশ্রেণীর করমুক্ত আয়সীমা, করহার অপরিবর্তিত আছে৷ অর্থমন্ত্রী তার লিখিত বাজেট বক্তৃতায় বলেন, ‘‘সম্মানিত করদাতাগণের প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছে এবং অন্যদিকে করমুক্ত আয়সীমা অপরিবর্তিত রয়েছে৷ এ প্রেক্ষাপটে সম্মানিত করদাতাগণের কর প্রদানের স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আমি কোম্পানি ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ব্যতিত অন্যান্য শ্রেণীর করদাতা, বিশেষ করে স্বাভাবিক ব্যক্তিশ্রেণীর করদাতাগণের করমুক্ত আয়সীমা কিছুটা বৃদ্ধি করার প্রস্তাব করছি৷''
বাজেট থেকে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা
আগামী ১ জুন বাজেট ঘোষণা করা হবে৷ ঢাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বাজেট নিয়ে কী ভাবছেন, তাদের প্রত্যাশা কী, জানতে চেয়েছিল ডয়চে ভেলে৷
ছবি: bdnews24.com
আমরা কি ভালো-মন্দ খামু না?
নির্মাণশ্রমিক হিসেবে ঢাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চুক্তিতে কাজ করেন মোঃ আজগর মৃধা৷ আসন্ন বাজেট নিয়ে কথা বলতে গেলে তিনি বলেন, ‘‘বাজেট বাদ দেন, সামনে কুরবানির ঈদের আগে যে গরুর মাংস রান্দার যেসব মেইন জিনিস লাগে, আদা আর পেয়াইজ, এগুলির দাম যে তিন গুন বাইড়া গেল, আমরা কি বছরে একদিনও ভালো-মন্দ খামু না?’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বাজেটের আগেই জিনিসের দাম বাড়সে
ঢাকার শ্যামলীতে কাঠমিস্ত্রি হিসেবে কাজ করা মোঃ জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘‘প্রত্যেক বছর দেখি বাজেটের সময় হওয়ার আগে দিয়া জিনিসের দাম বাড়ে নাইলে জিনিস পাওয়া যায় না, মার্কেট থেকা হাওয়া হয়া যায়৷ এইবারও ব্যতিক্রম হয় নাই, এক মাসের ব্যবধানে অনেক কিছুর দাম ডাবল হয়া গেসে৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
আমরা সব সহ্য করে নিচ্ছি
ঢাকার মিরপুরের এই অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি চাকরিজীবী বলেন, ‘‘আমরা এখন হাত-পা বাঁধা অবস্থায় আছি৷ কারো বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারছি না, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারছি না৷ সব ধরণের জুলুম শোষণ আমরা মুখ বুজে সয়ে নিচ্ছি৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
এখন আমি লাখ টাকা ঋণী
ঢাকার কমলাপুরের পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করেন শিখা রাণী দাস৷ বাজেট নিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘করোনার আগে আমার এক টাকাও ঋণ ছিল না, দিন আনছি দিন খাইসি, কিছু টাকা জমাইসি৷ করোনায় সব জমানো টাকা ভাইঙ্গা খাইসি৷ গত দুই বচ্ছরে আমার এখন লাখ টাকা ঋণ৷ সুদে ঋণ নিসি, এইটা কীভাবে শোধ দিমু, আমি জানি না৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বাজেটের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন চাই
লেখক এবং আলোকচিত্রী শাহরিয়ার খান শিহাব বলেন, ‘‘আমি বাজেট বলতে বুঝি, দেশ থেকে শোষণ বিলুপ্ত হবে, দেশ সিন্ডিকেটমুক্ত হবে৷ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকবে৷ অন্যদিকে, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ করে দেওয়া যাবে না, যা প্রতিবছরই করা হচ্ছে৷’’ তিনি বলেন, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির পাশাপাশি আয়-ব্যয়ের ঘাটতি দূর করতে হবে৷ আর বাজেট শুধু পরিকল্পনায় সীমাবদ্ধ না রেখে এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা জরুরি৷
ছবি: Privat
সংসার চলে না
স্নাতকে পড়াশোনার পাশাপাশি অনলাইনে বিক্রি হওয়া পণ্য ডেলিভারি করেন সাইফুল ইসলাম৷ বাজেট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘সরকার কীভাবে কী বাজেট করে আমরা এতোকিছু বুঝি না৷ আমরা শুধু জানি আমাদের সংসার চলে না, দিনদিন কঠিন থেকে আরো কঠিন হচ্ছে সবকিছু৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বাজেটে জিনিসের দাম কমে না
ঢাকার কেরাণীগঞ্জের পোশাকশিল্প কর্মী সালেহা আক্তার বলেন, ‘‘বাজেটে জিনিসপত্রের দাম বাড়ালে নিশ্চিত ধইরা নেন ঐ জিনিসের দাম বাড়বে৷ কিন্তু বাই চান্স যদি কিছুর দাম কমেও, সেইটার দাম আমগো আর কমে না৷ দেশে একবার দাম বাড়লে আর কমে না, এইটাই নিয়ম হয়া গেসে৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা উচিত
মৌসুমি ফল ব্যবসায়ী মোঃ আকবর মিয়া বলেন, ‘‘আমগো দেশে দাম বাড়তে বাজেট লাগে না, প্রতিমাসেই এখন দাম বাড়তাসে জিনিসের৷ মানুষ যে এখন এক বেলা না খাইয়া আছে, আমাগো প্রধানমন্ত্রী কি এইসব দেখে না? আমার তো মনে হয় সাধারণ মানুষের দুঃখের আসল চিত্র তারে দেখানো উচিত৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
আমরা চলতে পারি কিনা সেইটাই আমাদের বাজেট
ঢাকার পীরেরবাগের একটি এটিএম বুথের নিরাপত্তারক্ষী মোঃ আবদুল জলিল জানান, ‘‘বাজেট মানে আমরা বুঝি, আয় কতো আর ব্যয় কতো৷ প্রত্যেকেই আমরা মাসের শুরুতে সংসার বা নিজেগো খরচ চালাইতে একটা বাজেট করি৷ সরকারি বাজেট কী অতো বুঝি না, কিন্তু আমরা ঠিকমতো তিনবেলা খাইতে পরতে পারি কিনা, সেইটাই আমগো কাছে বাজেট৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মানুষের একটাই চাওয়া যেন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি না হয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক এবং অর্থনীতিবিদ ডঃ এমএম আকাশ বলেন, ‘‘বাজেটে সাধারণ মানুষের চাওয়া একটাই, যেন কর এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি না হয়৷ তবে ভ্যাট এবং পরোক্ষ ট্যাক্স বেশিরভাগক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের উপরই বসানো হয় এবং দ্রব্যমূল্য বাড়ে৷ তবে এই বছরটা খুব ক্রুশিয়াল হওয়ায় সরকার আপ্রাণ চেষ্টা করবে যেন পরোক্ষ কর বৃদ্ধি না পায়৷’’
ছবি: Mahbub Alam
10 ছবি1 | 10
ন্যূনতম দুই হাজার টাকা
এদিকে আয় না থাকলেও রাষ্ট্রীয় কিছু সেবা পেতে নাগরিকদের আয়কর দিতেই হবে৷ অর্থাৎ এক্ষেত্রে করমুক্ত আয়সীমা প্রযোজ্য হচ্ছে না৷ ন্যূনতম এই করের পরিমাণ দুই হাজার টাকা৷ অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, ‘‘করমুক্ত আয়সীমার নীচে রয়েছে অথচ সরকার হতে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা রয়েছে এমন সকল করদাতাদের ন্যূনতম কর দুই হাজার টাকা করার প্রস্তাব করছি৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘রাষ্ট্রের একজন নাগরিকের অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্র কর্তৃক প্রাপ্ত সুযোগ সুবিধার বিপরীতে সরকারকে ন্যূনতম কর প্রদান করে সরকারের জনসেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ৷''