ইইউতে কি হিজাব নিষিদ্ধ?
২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩মুসলিম নারীদের মাথায় স্কার্ফ পরা নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন জুড়ে বেশ কয়েক বছর ধরেই বিতর্ক চলছে। কিছু দেশ মনে করে, হিজাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করলেধর্মীয় নিপীড়ন এবং সন্ত্রাসবাদকে মোকাবেলা করা যাবে। অন্যদের যুক্তি, এই নিষেধাজ্ঞা নারী অধিকারে বৈষম্য তৈরি করবে।
ইইউর কয়েকটি দেশ ইতিমধ্যে বোরকার উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ইইউ অঞ্চলের
কয়েকটি দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র এবং রাস্তাঘাটে, জনসমক্ষে হিজাব, হেডস্কার্ফের উপর সম্পূর্ণ বা আংশিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
ওপেন সোসাইটি জাস্টিস ইনিশিয়েটিভ হলো মানবাধিকারের পক্ষে আইনজীবীদের একটি দল। ২০২২ সালের মার্চ মাসে তারা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেটি অনুযায়ী, ৯/১১ হামলার প্রেক্ষিতে মার্কিন নীতিনির্ধারকরা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ ঘোষণা করে। তারপর এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়। পোশাকের কারণে মুসলিমদের নিয়ে সন্দেহই এর কারণ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, "একটি গোষ্ঠী হিসাবে মুসলিমরা নতুন 'অভ্যন্তরীণ শত্রু'- এমন ধারণা গড়ে উঠেছিল। তাদের বিশ্বাস এবং মূল্যবোধ ইউরোপের তুলনায় খারাপ- এমন ধারণা রাজনৈতিক আঙিনাজুড়ে বৈধতা পেয়েছিল।"
বিশ্ব হিজাব দিবস সংস্থার ব্লগের সম্পাদক রুমকি চৌধুরীও একই অনুভূতি শেয়ার করেছেন।
রুমকি বর্তমানে সুইডেনের স্টকহোমে থাকেন। তিনি বলেন, "তখন একটা কঠিন সময় ছিল। কারণ, আমি অ্যামেরিকায় বড় হয়েছি। এদিকে ৯/১১-র ঘটনার পরে হিজাব পরা নিয়ে ভাবাও আমার পক্ষে কঠিন ছিল।সমস্ত বড় সন্ত্রাসের পিছনে মুসলিমরাই রয়েছে- এমন প্রচারণা চলছিল হিজাব পরার জন্য বৈষম্যের শিকার হতে পারি- এমন একটা ভয় কাজ করতো আমার মধ্যে।''
ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "কিন্তু বাস্তবে এটি একটি ভুল ধারণা। কারণ, কোরআন অনুসারে আপনি যদি একজন মানুষকে হত্যা করেন, তবে সেটি মানবজাতিকে হত্যা করার সমান। আমি বুঝতে পেরেছিলাম মুসলিমদের নিয়ে মানুষ যা দাবি করছে তা সত্যি নয়। শুধু দোষারোপ করার জন্য মানুষ তখন কাউকে খুঁজছিল। তাদের রাগ, দুঃখ আমাদের উপর এসে পড়েছিল, আমাদের পোশাকের উপর এসে পড়েছিল। ”
তার কথায়, "হিজাব পরা নিয়ে মানুষ কী ভাববে সেটা আসলে আমি কেমন তার উপরে নির্ভর করছে। এটা বুঝতে পেরেছিলাম। কারণ, হিজাব আমাকে আল্লাহর কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার অনুভূতি দেয়।''
ইইউ কি হিজাব নিষিদ্ধ করছে?
৯/১১-র সন্ত্রাসী হামলার পর ২০১০ সালে প্রথম ইউরোপীয় দেশ হিসাবে ফ্রান্স জনসমক্ষে বোরকা এবং নিকাবের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, বুলগেরিয়া, ডেনমার্ক, ইটালি (কিছু এলাকায়), নেদারল্যান্ডস (জনসমক্ষে) এবং স্পেন (কাতালুনিয়ার কিছু অংশে)- এই নিয়ম অনুসরণ করেছে। অন্যদিকে, জার্মানি বোরকা এবং নিকাব ইস্যুতে দ্বিধাগ্রস্ত। কয়েকটি রাজ্য তাদের স্কুলে এবং জনসমক্ষে এই পোশাকে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। অনেকে ভয় পাচ্ছেন এমন নিষেধাজ্ঞা ইন্টিগ্রেশনে, অর্থাৎ মূলস্রোতে সবার সঙ্গে মেলামেশায় বাধা হতে পারে।
২০২১ সালের জুলাইয়ে ইউরোপিয়ান কোর্ট অফ জাস্টিস (ইসিজে), অর্থাৎ ইউরোপের ন্যায়বিচার আদালত রায় দেয়, জনসাধারণের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে হবে- এমন চাকরির ক্ষেত্রে হিজাব সরাতে অস্বীকার করলে সেই নারীকে বরখাস্ত করা যেতে পারে।
বিচারকরা বলেন, "রাজনৈতিক, দার্শনিক বা ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে কর্মক্ষেত্রে বিশেষ কোনো প্রতীক বা পোশাক পরায় নিষেধাজ্ঞা গ্রাহকদের প্রতি নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য হতে পারে। সামাজিক যে কোনো বিরোধিতা মোকাবিলায় নিয়োগকর্তা এটি প্রয়োজনীয় মনে করলে তা ন্যায্য হতে পারে।"
জার্মান বিচারকদের একটি অনুরোধের প্রেক্ষিতে এই রায় দেয়া হয়। মাথার স্কার্ফ খুলতে অস্বীকার করা দুই নারীকে বরখাস্ত করা নিয়ে দুই নিয়োগকর্তার অধিকারকে রায়ে সমর্থন করা হয়েছিল।
২০২২ সালের অক্টোবরে, ইসিজে রায় দিয়েছিল, ইইউ কোম্পানিগুলিকে ধর্মীয় প্রতীক ব্য়বহার বা পরিধান নিয়ে নিষেধাজ্ঞার ব্যাখ্যা করতে হবে। বেলজিয়ামের এক মুসলিম নারীকে নিয়ে মামলা চলছিল আদালতে। তাকে বলা হয়েছিল কাজের সময় হিজাব পরতে পারবেন না। সংস্থাটি বলে, কর্মীদের মধ্যে সমতা বাড়াতে একটি নিরপেক্ষ নিয়মের অংশ ছিল এই সিদ্ধান্ত।
জার্মানির বোখুমের আইনজীবী এবং বৈষম্য বিরোধী পরামর্শদাতা আসমা এল ইদ্রিসি ডিডাব্লিউকে বলেন, এই ধরনের নিয়ম কোম্পানির উন্নতিতে সহায়তা করে না। বরং এটি বৈষম্যমূলক।
তার কথায়, "জার্মানির হেসিয়ান মিনিস্ট্রি অফ জাস্টিসে থাকার সময় আমাকে কর্মক্ষেত্রে হিজাব নিষেধাজ্ঞার মোকাবেলা করতে হয়েছে। আমায় বলা হয়েছিল, হেডস্কার্ফের কারণে কোর্ট ইন্টার্নশিপের ব্যবহারিক প্রয়োগের কাজ করতে আমাকে বাধা দেওয়া হবে। এর মানে হলো আমাকে বিচারকের পাশে বসতে দেওয়া হয়নি, সামনে থেকে কোনো সাক্ষীকে দেখতে দেওয়া হয়নি। আমাকে কয়েকটি প্রসিকিউটরিয়াল কাজে অংশ নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। একজন প্রসিকিউটরের ভূমিকায় কাজ করতে দেয়া হয়নি। রাষ্ট্রীয় প্রসিকিউটরের অফিসে জনসমক্ষে প্রতিনিধিত্বের অনুমতি দেওয়া হয়নি।"
তার কথায়, "হিজাব হলো পরিচয়ের চিহ্ন। আমার জন্য ক্ষমতায়নের একটি হাতিয়ার। তাই আমি এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। আমার মামলাটি জার্মানির ফেডারেল সাংবিধানিক আদালতে গিয়েছিল৷ আদালত দেখেছে এটি আমাকে কোনোভাবে সাহায্য করবে না, কিংবা 'ডাইভার্সিটি' বজায় রাখতে কোম্পানিগুলিকেও সাহায্য করবে না।''
এল ইদ্রিসি বলেন, ''বৈচিত্র্য বজায় রাখার নীতির ক্ষেত্রে ইউরোপের কোম্পানিগুলোকে শুধুমাত্র ‘মুখের কথা' দিয়ে কাজ সারলেই হবে না। আমরা যদি ‘কাঠামোগত বর্ণবাদ' পরিবর্তন করতে চাই, তবে সমস্ত রকমের মানুষকে নিয়োগ করতে হবে। তারা যা পোশাক পরেন তার উপর ভিত্তি করে বৈষম্য করা যাবে না।"
ওপেন সোসাইটি জাস্টিস ইনিশিয়েটিভের প্রতিবেদন অনুসারে, ইইউর বেশিরভাগ দেশে মুখের পর্দা এবং মাথার স্কার্ফের উপর নিষেধাজ্ঞা এবং নিয়মগুলি প্রাথমিকভাবে জাতীয়তাবাদী এবং উগ্র ডানপন্থি রাজনৈতিক দলগুলির দ্বারা প্রচার করা হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে পাঁচটি ইইউ রাষ্ট্র (ক্রোয়েশিয়া, সাইপ্রাস, গ্রিস, পোল্যান্ড এবং পর্তুগাল) কখনও মাথা বা মুখ ঢাকায় নিষেধাজ্ঞা নিয়ে প্রকাশ্যে বিতর্কে অংশ নেয়নি।
'এটা আমাদের ব্যক্তিত্বের অংশ, ফ্যাশন, এটাই আমি পরতে চাই'
নেতিবাচক মনোভাব প্রতিরোধে নিউ ইয়র্কের নাজমা খান ২০১৩ সালে ১ ফেব্রুয়ারিকে বিশ্ব হিজাব দিবস (ডাব্লিউএইচডি হিসাবে পালন করার ধারণার সূচনা করেন। হিজাব পরতে চান এমন লাখ লাখ মুসলিম নারীর স্বীকৃতিস্বরূপ এই দিবস পালন করার কথা বলেন তিনি।
বিশ্ব হিজাব দিবসের ব্লগ সম্পাদক রুমকি চৌধুরী বলেন, "ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই দিনটিকে চিহ্নিত করার কারণ হলো হিজাব আমাদের পছন্দ। আমরা কী ধরনের পোশাক পরতে চাই তা আমরাই ঠিক করবো। এটি আমাদের ব্যক্তিত্বের অংশ। এটি ফ্যাশন।''
তার কথায়, " ৯/১১ ঘটনার পরে মূলধারার গণমাধ্যম দেখলে বোঝা যায় ইসলামোফোবিয়া ক্রমাগত বাড়ছে। তাই এই দিনটিকে (হিজাব দিবস) স্বীকৃতি দিয়ে আমরা এই ধরনের ভাবনা প্রতিহত করতে চাই।"
গত বছর ইরানে ২২ বছর বয়সি জিনা মাহসা আমিনিতার হিজাব ঠিকমতো না পরার জন্য তথাকথিত নীতিপুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। পুলিশ হেপাজতে তার মৃত্যু হয়। ইরান এবং সারা বিশ্বে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। নারীদের কঠোর পোশাকবিধির কারণে ইরানি কর্তৃপক্ষের তীব্র নিন্দা করে সারা বিশ্ব।
রুমকি চৌধুরীর যুক্তি, "ইরানে যা ঘটছে তা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। হিজাব পরিধানকারী নারী হিসাবেও আমরা তাদের প্রতিবাদকে সমর্থন করি, কারণ, শেষ পর্যন্ত তাদের প্রতিবাদও নারীর অধিকার রক্ষার জন্য। নারীরা যেমন চান, তেমন পোশাক পরবেন। নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার স্বাধীনতা রয়েছে তাদের।"
ইইউকে 'সমর্থন ও সংহতি দেখাতে হবে'
ইরানের একজন মানবাধিকার কর্মী সায়ে স্কাই। তিনি কখনো টরন্টো থাকেন, কখনো বা বার্লিন। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, হিজাব নিয়ে কথা বলার নিরাপদ পরিসর তৈরিতে ইইউকে আরো অনেক কিছু করতে হবে।
তার কথায়, "হিজাব পশ্চিমে এটি আলোচিত বিষয় কিন্তু যারা এটা পরে, তাদের কাছে এর অর্থ কী, সেটা অনেকে বুঝতে পারি না। ইরানে গত ৪৩ বছর ধরে, হিজাব না পরার কারণে মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। আফগানিস্তানে তালেবান নারীদের উপর কড়া হেডস্কার্ফের নিয়ম আরোপ করছে। তাই এসব জায়গায় এটা নারীদের জন্য নিপীড়ন। এদিকে, এমন নারীরাও আছেন যারা মনে করেন এটা তাদের পরিচয়ের একটি অংশ এবং নিজেদের প্রকাশ করার একটি উপায়।"
তিনি জানান, " ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে, হিজাব বিতর্কের প্রতিটি দিকশোনার জন্য একটি নিরাপদ জায়গা প্রয়োজন। সরকারকে এমন পরিসর তৈরি তরতে হবে যাতে মানুষ হিজাব পরার অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে পারেন।"
ইরান এবং আফগানিস্তানে নারী স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা মানুষদের উল্লেখ করে স্কাই বলেন, "সব দিকেই ট্রমা রয়েছে। আফগানিস্তান বা ইরানে হিজাব হয়তো নারীর নিজস্ব পরিচয় পরিচয় মুছে ফেলতে পারে। আবার নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে হিজাব পরতে চেয়ে লড়াই করেছেন অনেক নারী। সুতরাং ইউরোপকে এই জটিলতাকে বুঝতে হবে এবং হিজাবের ধারণা না বুঝে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার বদলে সংহতি জানাতে হবে।"
রুমকি চৌধুরীও একই মত প্রকাশ করেন।
তিনি জানান, "এটা একবিংশ শতাব্দী এবং ব্যক্তিত্ব এখন একটা বড় জায়গা। তাই কেউ হিজাব পরুক বা না পরুক ইউরোপীয় দেশগুলিকে সব মানুষকে আপন করে নিতে হবে। নারীকে পছন্দের বেছে নেয়ার স্বাধীনতা দিতে হবে। যে পোশাক কোনো নারী পরতে চায় সেটি পরার এবং নিজেদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দিতে হবে। "
প্রিয়াঙ্কা শঙ্কর/আরকেসি