বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রায় দশ লাখ অভিবাসী গত বছর ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোতে আশ্রয় আবেদন করেছেন, যা ২০১৬ সালের পরে সর্বোচ্চ৷ ২০০৮ সাল থেকে পাওয়া হিসাবে সর্বোচ্চ আশ্রয় আবেদনের রেকর্ড গড়েছেন বাংলাদেশিরাও৷
বিজ্ঞাপন
২০২২ সালে ইইউ প্লাস (ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭ দেশ, নরওয়ে ও সুইজারল্যান্ড) দেশগুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা নয় লাখ ৬৬ হাজার অভিবাসী আশ্রয়ের আবেদন করেছেন৷ এই সংখ্যা গত বছরের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি এবং ছয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের আশ্রয় আবেদন সংক্রান্ত সংস্থা-ইইউএএ বুধবার এই পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে৷
এর বাইরে গত বছর প্রায় ৪০ লাখ ইউক্রেনীয় সাময়িক সুরক্ষার আওতায় ইউরোপে বসবাসের অনুমতি পেয়েছেন৷ সংস্থাটি জানিয়েছে, ইউক্রেনীয়দের সাময়িক সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে গিয়ে গোটা আশ্রয় আবেদন প্রক্রিয়ার ওপরই বড় ধরনের চাপ পড়েছে৷ আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে নতুন আগতদের জায়গা দিতে গিয়ে কর্তৃপক্ষ হিমশিম খাচ্ছে৷
অভিবাসীদের নিয়ে তথ্যচিত্র: কন্ট্রাক্টের নাম সাইপ্রাস
26:26
কোন দেশ থেকে কত
অনিয়মিতভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সীমান্তে প্রবেশের পর অভিবাসীরা সংশ্লিষ্ট দেশে আশ্রয়ের আবেদন জানাতে পারেন৷ প্রথমবার আবেদন প্রত্যাখ্যান হলে তা পুনর্বিবেচনার আবেদন করতে পারেন৷ ২০২২ সালে আট লাখ ৮৫ হাজার জনই প্রথমবার আশ্রয়ের আবেদন জমা দিয়েছেন৷ পুনর্বিবেচনার আবেদন করেছেন প্রায় ৮০ হাজার৷
আবেদনকারীদের মধ্যে প্রায় ৪৩ হাজার জনই ছিলেন অভিভাবকহীন অপ্রাপ্তবয়স্ক, যা ২০১৫ সালের পর সর্বোচ্চ৷
২০২১ সালের ধারাবাহিকতায় গত বছরে আশ্রয় চাওয়াদের দুই তৃতীয়াংশই ছিলেন সিরীয় (এক লাখ ৩২ হাজার) ও আফগানরা (এক লাখ ২৯ হাজার)৷ ২০১৬ সালের পর দেশ দুইটির নাগরিকদের আবেদনের সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ৷ তৃতীয় অবস্থানের আছেন তুরস্কের মানুষ, ৫৫ হাজার আবেদনকারী ছিলেন ইউরোপীয় ইয়নিয়নের সীমান্তবর্তী এই দেশটির৷ চতুর্থ ও পঞ্চম অবস্থানে লাতিন আমেরিকার দেশ ভেনেজুয়েলা ও কলম্বিয়ার মানুষেরা৷ দেশ দুইটির আশ্রয় আবেদনকারীর সংখ্যা যথাক্রমে ৫১ হাজার ও ৪৩ হাজার জন৷
ইইউএএ-এর তথ্য অনুযায়ী, তুর্কি, ভেনেজুয়েলান, কলম্বিয়ান, বাংলাদেশি ও জর্জিয়ানদের আবেদনের সংখ্যা অন্তত ২০০৮ সালের পর সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে৷
অভিবাসীদের নিয়ে তথ্যচিত্র- ‘রুটের নাম বলকান’
24:49
This browser does not support the video element.
সিদ্ধান্ত গ্রহণে গতি
অনেক সময়ই আবেদনের পর সিদ্ধান্ত পেতে শরণার্থী, অভিবাসীদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থাকতে হয়৷ তবে গত বছর ছয় লাখ ৩২ হাজার আবেদনেরই সিদ্ধান্ত দেয়া সম্ভব হয়েছে৷ এর মধ্যে তিন লাখ ৭৯ হাজার বা প্রায় অর্ধেক আবেদনই প্রত্যাখ্যান করেছে কর্তৃপক্ষ৷ অন্যদিকে, এক লাখ ৪৭ হাজার জন শরণার্থী হিসেবে এবং এক লাখ ছয় হাজার জন সাবসিডিয়ারি প্রটেকশন বা সহায়ক সুরক্ষার আওতায় থাকার অনুমতি পেয়েছেন৷
উল্লেখ্য, নিজ দেশে বর্ণ, ধর্ম, জাতীয়তা, রাজনৈতিক কারণে কেউ নির্যাতনের শিকার হলে বা কারো জীবন হুমকির মুখে থাকলে তিনি আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ইউরোপের দেশগুলোতে সুরক্ষা চেয়ে আবেদন করতে পারেন৷
অভিবাসী বিষয়ক সংবাদমাধ্যম ইনফোমাইগ্রেন্টস তিনটি প্রধান ইউরোপীয় সংবাদমাধ্যমের নেতৃত্বে একটি যৌথ প্লাটফর্ম৷ প্লাটফর্মটিতে রয়েছে জার্মানির আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলে, ফ্রান্স মিডিয়া মোন্দ, এবং ইটালিয়ান সংবাদ সংস্থা আনসা৷ এই প্রকল্পের সহ-অর্থায়নে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷
কাতারে কাজ করা অভিবাসী শ্রমিকদের গল্প
২০১০ সালে ২০২২ সালের বিশ্বকাপের আয়োজক হিসেবে কাতারের নাম ঘোষণা করা হয়৷ এরপর সেখানকার অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করেছেন অনেক অভিবাসী শ্রমিক৷ কেমন ছিল তাদের জীবন?
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP
নতুন সাত স্টেডিয়াম তৈরি
২০১০ সালে ২০২২ সালের বিশ্বকাপের আয়োজক হিসেবে কাতারের নাম ঘোষণা করা হয়৷ এরপর সেখানে নতুন সাতটি স্টেডিয়াম নির্মাণ করা হয়েছে৷ একটি সংস্কার করা হয়েছে৷ এছাড়া নতুন আরও অনেক অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে৷
ছবি: JOHN SIBLEY/REUTERS
অভিবাসী শ্রমিক
কাতারের ২৮ লাখ জনসংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশ অভিবাসী শ্রমিক৷ সাধারণত ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ফিলিপাইন্স, কেনিয়া ও উগান্ডাসহ আফ্রিকার কয়েকটি দেশ থেকে শ্রমিকরা সেদেশে যান কাজ করতে৷ তাদের আশা থাকে দেশের চেয়ে বেশি টাকা আয় করবেন সেখানে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
কাতারের সমালোচনা
অভিবাসী শ্রমিকদের মৃত্যু এবং তাদের টাকা না দেয়ার মতো অভিযোগ রয়েছে কাতারের বিভিন্ন কোম্পানির বিরুদ্ধে৷ গত কয়েক বছরে কাতার আইন সংস্কার করেছে এবং অভিযুক্ত কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে৷ ক্ষতিপূরণ হিসেবেও শ্রমিকদের অনেক টাকা দিয়েছে৷ তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, পরিবর্তন সামান্য হয়েছে এবং অনেক দেরিতে এসেছে৷
ছবি: Igor Kralj/PIXSELL/picture alliance
শ্রাবনের বাবা মরে গেছে
ভারতের তেলেঙ্গানা থেকে কাতারে কাজ করতে গিয়েছিলেন শ্রাবন ও তার বাবা রমেশ৷ একদিন কাজ করতে গিয়ে বুকে ব্যথা উঠলে বাবা মারা যান৷ তার মৃতদেহ দেশে নিয়ে যাওয়ার পর আর কাতার যাননি শ্রাবন৷ তার অভিযোগ, তাদের অনেক ঘণ্টা কাজ করতে হতো৷ এবং ওভারটাইম হিসেবে অল্প টাকা দেয়া হত৷ তার বাবা ভোর তিনটায় কাজ শুরু করে রাত ১১টা পর্যন্ত কাজ করতো বলে জানান শ্রাবন৷ ছবিতে মায়ের সঙ্গে শ্রাবনকে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: NOAH SEELAM/AFP
আটশ টাকা নিয়ে ফেরেন বাংলাদেশের আপন মীর
সাত লাখ টাকা খরচ করে শ্রীপুরের আপন মীর ২০১৬ সালে কাতার গিয়েছিলেন৷ চার বছর পর মাত্র আটশ টাকা নিয়ে দেশে ফেরেন তিনি৷ খলিফ ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়াম সংস্কারে কাজ করেছেন মীর৷ ফোরম্যান তাদের টাকা তুলে পালিয়ে যায় বলে জানান তিনি৷ এছাড়া বৈধ কাগজপত্র না থাকায় ২০২০ সালে গ্রেপ্তার করার পর তাকে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP
ঋণে জর্জরিত
বাবা ও আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে টাকা ধার করে কাতার গিয়েছিলেন মীর৷ কিন্তু পর্যাপ্ত টাকা নিয়ে ফিরতে না পারায় ঋণ শোধ করতে পারেননি৷ অথচ কাতারে প্রচণ্ড গরমে দিনে ১০ ঘণ্টার বেশি পরিশ্রম করেছেন৷ ‘‘রক্ত ঘাম হয়ে যেত,’’ বলে জানান তিনি৷ অনেকসময় খাবার টাকা থাকতো না৷ আর ভাড়া দিতে না পারায় বেঞ্চেও তাকে ঘুমাতে হয়েছে বলে জানান মীর৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP
স্বপ্ন পূরণ হয়নি
এলাকায় একটা ভালো ঘর তৈরির স্বপ্ন নিয়ে কাতার গিয়েছিলেন মীর৷ আশা ছিল পরিবারের জীবনযাত্রার মান বাড়বে, সন্তানদের ভালো স্কুলে পড়াবেন৷ কিন্তু তা পূরণ হয়নি৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP
নতুন মোটরসাইকেল কিনেছেন
বাংলাদেশেরই আরেক অভিবাসী শ্রমিক আবু ইউসুফ৷ এটা তার প্রকৃত নাম নয়৷ কারণ আগামী মাসে আবার কাতার যাবেন তিনি৷ কাতারে তিনি মাসে ৭০ হাজার টাকা পেতেন৷ সেই টাকা জমিয়ে এলাকায় দুই তলা বাড়ি করেছেন৷ নতুন একটি মোটরসাইকেলও কিনেছেন৷ কাতারিরা তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছে এবং তাকে অনেক সহায়তা করেছে বলেও জানান৷
ছবি: KARIM JAAFAR/AFP/Getty Images
কাতারে কাজ করতে গিয়ে দৃষ্টিশক্তি হারান শেখ
দোহায় ভবন নির্মাণ কাজ করতে গিয়ে বাবু শেখ একদিন ১৪ ফুট উঁচু থেকে পড়ে যান৷ এরপর চারমাস কোমাসহ ১৮ মাস হাসপাতালে ছিলেন৷ পুরো চিকিৎসা তার পরিবারকে করতে হয়েছে৷ কাতার কর্তৃপক্ষ তার মালিকের বিচার করলেও তিনি কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি৷ কোমা থেকে ফিরে তিনি আর কিছু দেখতে পান না৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP
‘ছেলে কি দেখতে আমার মতো হয়েছে?’
শেখের ছেলের বয়স পাঁচ৷ এখন বিকাল বেলায় ছেলে তাকে হাত ধরে গ্রামের বাজারে নিয়ে যায়৷ এই ছেলের জন্মের সময় কাতারে ছিলেন শেখ৷ ফলে ছেলেকে কোনোদিন দেখা হয়নি তার৷ ‘‘ছেলে কি দেখতে আমার মতো হয়েছে’ প্রশ্ন শেখের৷ তিনি এমন জীবন থেকে মুক্তি চান৷ পরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন শেখ৷ তাই রাতে ঘুম হয় না বলে জানান তিনি৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP
ফ্রি খাবার পেতে জেলে যেতেন
২০১২ সালে কাতার যান ফিলিপাইন্সের জোভানি কারিও৷ ২০১৮ সালে মালিক বেতন দেয়া বন্ধ করে দিলে জেলে বিনামূল্যে খাবার পাওয়ার আশায় ইচ্ছে করে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন৷ তিনি জানান, ফিলিপিনো শ্রমিকদের এটা কৌশল ছিল৷ যখই ক্ষুধা লাগতো তখন পুলিশকে মেয়াদোত্তীর্ণ কাগজ দেখিয়ে জেলে যেতেন৷ ছয় বছর পর্যন্ত বেতন পেয়েছেন৷ ২০১৮ সালে মালিক দেউলিয়া হয়ে গেলে কাতারের শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে তিন মাসের বেতন পান কারিও৷ এরপর দেশে ফিরে যান৷