ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বাধ্য হয়ে ব্রেক্সিটের সময়সীমা বাড়ানোর যে আবেদন করেছেন, সেটি বিবেচনা করতে আরো সময় নিচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ সেই আবেদন যাতে নাকচ হয়ে যায়, জনসন নিজে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সেই চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছেন৷ দীর্ঘমেয়াদী বিলম্বের পূর্বশর্ত হিসেবে তিনি কোনো জরুরি কারণ উল্লেখ করেননি৷ ফলে ব্রিটেনে প্রক্রিয়াগত জটিলতার খাতিরে ইইউ বড়জোর মাত্র কয়েক সপ্তাহের বিলম্ব মেনে নেবে, এমনটাই আশা করছেন তিনি৷ সে ক্ষেত্রে সংসদের উপর ব্রেক্সিট সংক্রান্ত সব প্রস্তাব দ্রুত অনুমোদন করার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী৷
অন্যদিকে জনসনের আশঙ্কা, তিন মাস অথবা আরও লম্বা বিলম্ব ঘটলে বিরোধীরা দ্বিতীয় গণভোট বা আগাম নির্বাচন তরান্বিত করতে পারে৷ সে ক্ষেত্রে ঘটনাপ্রবাহের রাশ তাঁর হাতছাড়া হয়ে যাবে৷ এমন পরিস্থিতিতে জনসন নিজেই আগাম নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন৷ ইইউ ব্রেক্সিটের সময়সীমা ৩ মাস পিছিয়ে দিলে খ্রিস্টমাসের আগেই নির্বাচন চান তিনি৷ তাঁর টোরি দলের মধ্যে এমন উদ্যোগ নিয়ে মতভেদ স্পষ্ট হয়ে উঠছে৷ সংসদে এই প্রস্তাব অনুমোদন করাতে হলে বিরোধী লেবার পার্টির সমর্থনেরও প্রয়োজন হবে৷ চুক্তিহীন ব্রেক্সিটের আশঙ্কা সম্পূর্ণ দূর হলেই বিরোধী দল আগাম নির্বাচনের পথ সুগম করে দেবে বলে জানিয়েছে৷
ইইউ সদস্য দেশের সরকারগুলির পরিষদের প্রধান ডোনাল্ড টুস্ক এক টুইট বার্তায় ব্রিটেনের আবেদনের ভিত্তিতে ব্রেক্সিটে বিলম্ব মেনে নেবার পরামর্শ দিয়েছেন৷ ইউরোপীয় পার্লামেন্টেও এই অবস্থানের পক্ষে সমর্থন বাড়ছে৷ ইইউ কর্মকর্তাদের মতে, শীর্ষ নেতারা সম্ভবত তিন মাসের বিলম্ব মেনে নেবেন৷ তবে ব্রিটেন তার আগেই ব্রেক্সিট চুক্তি সংক্রান্ত আইনি প্রক্রিয়া সেরে ফেলতে পারলে ইইউ ত্যাগ করতে পারবে৷
অন্যদিকে ফ্রান্সের মতো কিছু দেশ বড়জোর কয়েক সপ্তাহের বিলম্ব মেনে নিতে প্রস্তুত৷ জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাইকো মাস-ও কিছুদিনের বিলম্বের পক্ষে সওয়াল করেছেন৷ শুক্রবার ২৭টি ইইউ দেশের রাষ্ট্রদূতরা এই প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন৷ তার আগে ঐকমত্য অর্জনের চেষ্টা চলছে৷ কূটনৈতিক পর্যায়ে সেটা সম্ভব না হলে ইইউ শীর্ষ নেতাদের জরুরি সম্মেলন ডাকা হতে পারে৷
এলেমেলো চুল, ব্যতিক্রমী চাহনি আর ঝাজালো বক্তব্যের জন্য খ্যাতিমান নয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে আসা জনসনের বেড়ে ওঠার গল্পও বিচিত্র রকম৷
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন৷
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/D. Kitwoodকিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।
ছবি: Getty Images/L. Drayব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardyটেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PA Wire/J. Stillwellটেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Imago Images/PA/I. Infantesযুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের৷
ছবি: Reuters/P. Nichollsজনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের (ছবিতে বামে) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/D.L. Olivasপ্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।
ছবি: Getty Images/AFP/T. Akmenবাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/empics/B. Kendall এসবি/এসিবি (রয়টার্স, এপি, ডিপিএ)