ইইউ, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির 'গিভ অ্যান্ড টেক' কূটনীতি
১৭ অক্টোবর ২০২৪
রাশিয়ার আরো কড়া নিন্দা চেয়েছিল ইইউ, আর ইসরায়েল নিয়ে কড়া মনোভাব দেখাতে চেয়েছিল জিসিসি।
বিজ্ঞাপন
ব্রাসেলসে ইইউ এবং ছয় দেশের গালফ কোঅপারেশন কাউন্সিল(জিসিসি)-র শীর্ষ বৈঠক হলো। বুধবার সেখানেই লাল কার্পেটের উপর দিয়ে হাঁটছিলেন সৌদির যুবরাজ মোহামেদ বিন সালমান। একবার তিনি সাংবাদিকদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লেন। তারপর ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাক্রোঁর সঙ্গে গভীরভাবে কিছু আলোচনা করতে শুরু করলেন।
একসময় সৌদির যুবরাজকে নিয়ে হইচই কম হয়নি। ২০১৮ সালে সাংবাদিক জামাল খাসোগির হত্যায় তার ভূমিকা নিয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলি সোচ্চার হয়েছে। কিন্তু এখন তাকে নিয়ে আর যে ইইউ-র কোনো আপত্তি নেই, তিনি যে কূটনীতির মূল ধারায় চলে এসেছেন, সেটা বোঝা গেল।
কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন তার উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। ইইউ-র কূটনীতিকদের প্রশ্ন করা হয়, সৌদির যুবরাজের প্রথমবার ব্রাসেলস সফর নিয়ে কি বিতর্ক দেখা দিয়েছে? তাদের জবাব ছিল, এমন কোনো বিতর্কের কথা তারা শোনেননি।
তাদের মনোযোগ অবশ্য অন্য জায়গায় ছিল। কারণ, দুই পক্ষই তাদের প্রতিবেশীদের সংঘাত নিয়ে একে অপরের উপর চাপ দিতে ব্যস্ত ছিল।
রাশিয়ার কড়া নিন্দা চেয়েছিল ইইউ
ইইউ ও জিসিসি সূত্র জানাচ্ছে, বুধবারের শীর্ষবৈঠকের কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। ইইউ চেয়েছিল, এই শীর্ষ সম্মেলন থেকে ইউক্রেনে আগ্রাসনের জন্য রাশিয়ার কড়া নিন্দা করা হোক।
একজন ইউরোপীয় কূটনীতিক জানিয়েছেন, জিসিসি-র সদস্য দেশগুলি গৃহীত প্রস্তাবে রাশিয়ার নামই প্রথমে রাখতে চায়নি। জিসিসি-র সদস্য দেশের মধ্যে আছে সৌদি আরব, কাতার, আমিরাত, বাহরিন, কুয়েত ও ওমান।
রাশিয়ার মিসাইলে বিধ্বস্ত ইউক্রেনের শিশু হাসপাতাল
ইউক্রেনের পাঁচটি শহরে আবার মিসাইল হামলা চালিয়েছে রাশিয়া৷ হামলায় বিধ্বস্ত হয়েছে কিয়েভের একটি শিশু হাসপাতাল৷ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের চিফ অব স্টাফ আন্দ্রেই ইয়েরমাক জানান, হামলায় মোট ৩৬ জন নিহত হয়েছেন৷ আহত হয়েছেন ১৪০ জন৷
ছবি: Thomas Peter/REUTERS
বিধ্বস্ত শিশু হাসপাতাল
রাশিয়ার ছোঁড়া মিসাইলের আঘাতে বিধ্বস্ত হয়েছে কিয়েভের অকমাডিট শিশু হাসপাতাল৷ এটিই ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় শিশু হাসপাতাল৷ মিসাইলের আঘাতে হাসপাতাল ভবনটির ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ সেখানে কর্মরত চিকিৎসক লেসিয়া লিজিটসিয়া ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে এ কথা জানিয়েছেন৷
ছবি: Oleksandr Ratushniak/REUTERS
ভীতিকর পরিস্থিতি
ভীতিকর পরিস্থিতি
হামলার সময়কার ভীতিকর অবস্থান বর্ণনা করেছেন চিকিৎসক লেসিয়া লিজিটসিয়া৷ তিনি বলেন, যখন মিসাইল এসে হাসপাতালে আঘাত হানে তখন পুরো বিষয়টি ‘সিনেমার দৃশ্যের’ মতো মনে হচ্ছিল৷ তিনি ‘ভয়ঙ্কর তীব্র আলো’ দেখতে পেয়েছিলেন জানিয়ে আরো বলেন, ‘‘এর পরপরই বিকট এবং ভীতিকর শব্দ শুনতে পাই৷’’ হামলায় হাসপাতালের একটি অংশ গুঁড়িয়ে গেছে, অন্য অংশে আগুন ধরে যায় বলেও জানান তিনি৷
ছবি: Oleksandr Ratushniak/REUTERS
মোট নিহত ৩৬, হাসপাতালে ২
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদোমির জেলেনস্কির চিফ অব স্টাফ আন্দ্রেই ইয়েরমাক জানিয়েছেন, কয়েকটি শহরের এ হামলায় মোট ৩৬ জন নিহত হয়েছেন৷ আহত হয়েছেন আরো ১৪০ জন৷ কিয়েভের মেয়র ভিতালি ক্লিৎসকো জানিয়েছেন, মিসাইল হামলায় হাসপাতালের এক চিকিৎসকসহ দুই ব্যক্তি মারা গেছেন৷ উদ্ধারকর্মীদের বরাত দিয়ে তিনি আরো জানিয়েছেন, আশঙ্কা করা হচ্ছে ধ্বংসস্তূপের নিচে আরো কেউ আটকা থাকতে পারেন৷
ছবি: Thomas Peter/REUTERS
থমকে গেছে চিকিৎসাসেবা
রাশিয়ার হামলায় থমকে গেছে হাসপাতালটির চিকিৎসাসেবা৷ চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, চিকিৎসাধীন রোগীদের দ্রুত কাছের হাসপাতালগুলোতে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে৷ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ইউক্রেনীয় একটি টিভি চ্যানেলকে জানিয়েছে, যে ওয়ার্ডটিতে মিসাইল আঘাত হেনেছে সেখানে অন্তত ২০ জন চিকিৎসাধীন রয়েছে৷
ছবি: Thomas Peter/REUTERS
দায় অস্বীকার রাশিয়ার
বিবিসি জানিয়েছে, হাসপাতালে হামলার বিষয়টি অস্বীকার করেছে রাশিয়া৷ উল্টো ইউক্রেনের ঘাড়ে দায় চাপিয়েছে তারা৷ রাশিয়া দাবি করছে, হাসপাতালটি ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষা মিসাইলের একটি অংশের আঘাতে বিধ্বস্ত হয়েছে৷ কিন্তু ইউক্রেন জানিয়েছে, তারা রাশিয়ার ছোঁড়া মিসাইলের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পেয়েছে৷
ছবি: Evgeniy Maloletka/AP Photo/picture alliance
গণহত্যার অভিযোগ
রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনে গণহত্যার চালানোর অভিযোগ এনেছেন কিয়েভের মেয়র ভিতালি ক্লিৎসকো৷ তিনি বলেন, ‘‘এ ঘটনার মধ্য দিয়ে পুরো বিশ্ব দেখতে পাচ্ছে রাশিয়ার মিসাইল ও ড্রোন কিভাবে আমাদের শান্তিপূর্ণ শহরকে তছনছ করে দিয়েছে এবং নাগরিকদের হত্যা করেছে৷’’ রাশিয়ার হামলায় একটি মাতৃ ও প্রসূতি হাসপাতালও আংশিক ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি৷ বলেছেন, সেখানে অন্তত সাত জন মারা গেছেন৷
ছবি: STATE EMERGENCY SERVICE OF UKRAINE/REUTERS
পশ্চিমা বিশ্বের প্রতি জেলেনস্কির আহ্বান
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেয়া এক বার্তায় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি লিখেছেন, রাশিয়ার ছোঁড়া বিভিন্ন ধরনের ৪০টিরও বেশি মিসাইল কিয়েভ, দিনিপ্রো, ক্রিভিই রি, স্লোভিয়ানস্ক ও ক্রামাতোরস্ক শহরে আঘাত করেছে৷ ইউক্রেনের জনগণ, ভূমি ও শিশুদের উপর রাশিয়ার এই হামলার পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমা বিশ্বকে শক্তিশালী পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান তিনি৷
ছবি: EPA/MICHAEL BUHOLZER
7 ছবি1 | 7
শেষ পর্যন্ত নেতারা ২০২২ সালে জাতিসংঘের প্রস্তাবে যা বলা হয়েছিল, সেটাই প্রস্তাবে রাখতে একমত হন। জাতিসংঘের প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের কঠোর নিন্দা করা হচ্ছে।
ইউরোপীয়ান কাউন্সিল অফ ফরেন রিলেশনসের ভিসিটিং ফেলো সিনজিয়া বিয়ানকো চলতি মাসের গোড়ায় লিখেছেন, ''কাতার, সৌদি আরব এবং আমিরাত চেষ্টা করেছিল, ইউক্রেনের আটক শিশুদের রাশিয়া ছেড়ে দিক, বিনিময়ে ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধবন্দিদের মুক্তি দিক। কিন্তু এই সংঘাতের উৎপত্তি ও সমাধান নিয়ে নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির সঙ্গে ইইউ-র দেশগুলির মতে মেলেনি।''
ইইউ চেয়েছিল, রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টিও রাখতে। ডিডাব্লিউ এর আগের দুইটি খসড়া প্রস্তাব দেখেছে। সেখানে এই প্রসঙ্গে সরাসরি উল্লেখ ছিল। কিন্তু চূড়ান্ত প্রস্তাবে শুধু বলা হয়েছে, নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থাগুলি ও তার রূপায়ণ নিয়ে আলোচনা হবে।
মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে কঠোর প্রতিক্রিয়া চেয়েছিল জিসিসি
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চল সহিংসতার কবলে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে জিসিসি চেয়েছিল, ইসরায়েলের কড়া সমালোচনা করা হোক। যৌথ ঘোষণাপত্রে গাজা, লেবাননে যুদ্ধবিরতির কথা বলা হয়েছে এবং ইসরায়েল সরকারের বসতি সম্প্রসারণ করা ও অধিকৃত ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক বা পশ্চিম তিরে তাদের বসতিকে আইনি ঘোষণার সিদ্ধান্তের নিন্দা করা হয়েছে।
কিন্তু জিসিসি-র এক সূত্র ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, ইউক্রেনের তুলনায় মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে তারা হতাশ। সিনজিয়াও বলেছেন, ''ইউরোপের দেশগুলি যেন লেকচার কম দেয় এবং আরো বেশি করে মধ্যপ্রাচ্যের কথা শোনে।''
গাজায় ধ্বংসের পরিসংখ্যান
গতবছরের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে সন্ত্রাসী হামলা করার পর ইসরায়েল গাজায় হামলা শুরু করে৷ সেটি এখনো চলছে৷ বিভিন্ন সংস্থা গাজার ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে৷
ছবি: Evad Baba/AFP
হতাহত
গতবছরের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে সন্ত্রাসী হামলা চালায়৷ এতে ১,২০০ জন নিহত হন বলে ইসরায়েল জানিয়েছে৷ এরপর ইসরায়েল গাজায় হামলা শুরু করলে এখন পর্যন্ত ৪১ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি মারা গেছেন বলে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে৷ আহতের সংখ্যা প্রায় ৯৫ হাজার৷
ছবি: Omar Ashtawy/ZUMA/picture alliance
ধ্বংসস্তূপের পরিমাণ
জাতিসংঘ বলছে, ইসরায়েলের বোমাবর্ষণে গাজায় প্রায় ৪০ মিলিয়ন টন ধ্বংসস্তূপ সৃষ্টি হয়েছে৷ এগুলো সরাতে ১৫ বছর লেগে যেতে পারে৷ খরচ হতে পারে পাঁচ থেকে ছয় মিলিয়ন ডলার৷
ছবি: Evad Baba/AFP
ধ্বংসস্তূপের নিচে মরদেহ
ধ্বংসস্তূপে অ্যাসবেস্টস ও মরদেহ থাকতে পারে৷ ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গত মে মাসে জানিয়েছিল, ধ্বংসস্তূপের নিচে ১০ হাজার মরদেহ থাকতে পারে৷
ছবি: Bashar Taleb/AFP/Getty Images
সংস্কারের সময়
মে মাসে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন জানিয়েছিল, গাজার ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি সংস্কার করতে অন্তত ২০৪০ সাল পর্যন্ত সময় লাগতে পারে৷ ফিলিস্তিনের তথ্য বলছে, প্রায় ৮০ হাজার ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে৷
ছবি: Omar Al-Qattaa/AFP/Getty Images
অবকাঠামোর ক্ষতি
জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে, অবকাঠামোর ক্ষতির পরিমাণ ১৮.৫ বিলিয়ন ডলার৷ আবাসিক ভবন, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জ্বালানির মতো জরুরি সেবাকে এর মধ্যে ধরা হয়েছে৷ গাজা শহর তার প্রায় পানি উৎপাদনের পুরো ক্ষমতা হারিয়েছে৷ ৮৮ শতাংশ পানির উৎস ও ১০০ ভাগ লবণমুক্তকরণ প্ল্যাট ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে বলে অক্সফ্যামের এক প্রতিবেদন বলছে৷
ছবি: Omar Ishaq/dpa/picture alliance
কৃষিজমির ক্ষতি
কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে পাওয়া ছবি বিশ্লেষণ করে জাতিসংঘ জানিয়েছে, গাজার মোট কৃষিজমির অর্ধেকের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷
ছবি: Hatem Khaled/REUTERS
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, গির্জার ক্ষতি
গাজা গভর্নমেন্ট মিডিয়া অফিস আগস্টে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০০ সরকারি অবকাঠামো, ১২২টি স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়, ৬১০টি মসজিদ ও তিনটি গির্জা ধ্বংস হয়েছে৷
ছবি: Bashar Taleb/AFP/Getty Images
7 ছবি1 | 7
কাতারের নেতা শেখ তামিম বিল হামাদ আল থানি ব্রাসেলসে প্রারম্ভিক ভাষণে সাবধান করে দিয়ে বলেছেন, দ্বিচারিতা করলে তার ফল ভালো হবে না। কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, নীতি সকলের জন্য এক হতে হবে।
ইরান নিয়ে
ইরানের ক্ষেত্রে ভাষা ব্যবহারে সংযত থেকেছে দুই পক্ষ। যৌথ ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, ইইউ এবং জিসিসি চায় ইরান যেন ওই অঞ্চলে উত্তেজনা কম করার চেষ্টা করে।
ইউ কূটনীতিকরা জানিয়েছেন, জিসিসি ইরানের বিরুদ্ধে কড়া ভাষার ব্যবহার চায়নি। জিসিসি সূত্র ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, ইরান নিয়ে পরিস্থিতি খুবই স্পর্শকাতর ও বিপজ্জনক। জিসিসি দেশগুলি কূটনৈতিক পথে ইরানের সঙ্গে আলোচনা করছে। এটাই একমাত্র পথ বলে তারা মনে করে।