ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন আইন অনুযায়ী ইইউ-তে রেজিস্ট্রিকৃত জাহাজগুলি শুধুমাত্র টেকসই পদ্ধতিতে ভাঙা চলবে, যা দৃশ্যত ভারত, বাংলাদেশ কিংবা পাকিস্তানের জাহাজ ভাঙার কারখানা বা শিপব্রেকিং ইয়ার্ডগুলিতে সম্ভব নয়৷
বিজ্ঞাপন
রয়টার্সের বিশেষ প্রতিবেদনে প্রথমেই যে পরিসংখ্যানটি তুলে ধরা হয়েছে, তা লক্ষণীয় এই কারণে যে, বিশ্বের অধিকাংশ পুরনো জাহাজই কিন্তু ভাঙা হয়ে থাকে উপমহাদেশের সমুদ্রসৈকতে৷
‘শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্ম' নামধারী একটি এনজিও গত জানুয়ারি মাসেই জানায় যে, ২০১৪ সালে যে ১,০২৬ টি সামুদ্রিক পোত ভেঙে ফেলা হয়, তাদের মধ্যে ৬৪১টি ভাঙা হয়েছে উপমহাদেশের তিনটি দেশের ইয়ার্ডগুলিতে৷
জাহাজগুলি সৈকতে তুলে পরে ব্লোটটর্চ দিয়ে সেই লোহালক্কড়ের সুবিশাল দানবগুলিকে কাটার কাজ যারা করে, তারা সাধারণত অতি দরিদ্র, প্রশিক্ষণবিহীন, ক্ষেত্রবিশেষে বহিরাগত শ্রমিক৷
দুর্ঘটনা লেগেই থাকে৷ গুজরাতে জাহাজ ভাঙার দীর্ঘতম সৈকতটির নাম হল আলাং-সোসিয়া: এখানে গত বিশ বছরে অন্তত ৪৭০ জন শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন, বলে মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্সেস জানিয়েছে৷
শ্রমিকরা প্রাণ হারান উঁচু ডেক থেকে পড়ে; অথবা ইস্পাতের পাতের ধাক্কা লেগে৷ জাহাজের ভেতর থেকে নানা বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ সাগরের পানিতে ধুয়ে সাগরে গিয়ে পড়ে৷ ওদিকে শ্রমিকদের অথবা পরিবেশের সুরক্ষা সংক্রান্ত আইন ও তার প্রয়োগ ঢিলেঢালা বলেই উপমহাদেশে জাহাজ ভাঙতে দিয়ে মালিকরা পান প্রতি টন ইস্পাত অনুযায়ী ৫০০ ডলার, যেখানে চীনে জাহাজ ভাঙতে দিলে পাওয়া যায় টন প্রতি ৩০০ ডলার এবং ইউরোপে আরো কম – মাত্র ১৫০ ডলার৷
চট্টগ্রাম – জাহাজের কবরস্থান
প্রতিবছর এক হাজারের বেশি জাহাজ ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যায়৷ এগুলোর অধিকাংশের শেষ ঠিকানা তখন হয় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের কোনো শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে৷ এই কাজ অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং প্রাণঘাতী৷
ছবি: DW/G. Ketels
শান্তিতে থাকুক?
চট্টগ্রামে কয়েক ডজন শিপব্রেকিং ইয়ার্ড রয়েছে৷ দুই লাখের মতো শ্রমিক হাজার কোটি টাকার এই বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ বড় বড় জাহাজ টুকরা টুকরা করার কাজ অধিকাংশক্ষেত্রে করে খালি হাতে৷ তাই শারীরিক ক্ষতি এমনকি মৃত্যু সেখানে অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়৷
ছবি: DW/G. Ketels
আলমগীর – জাহাজের কবর খোঁড়েন যিনি
ডয়চে ভেলের লাইফ লিংকস অনুষ্ঠানের ‘#হেডএবাভওয়াটার’ পর্বের জন্য আমরা আলমগীরের সঙ্গে দেখা করতে চট্টগ্রাম যাই৷ সে দিনে ১৪ ঘণ্টার মতো কাজ করে৷ মজুরিও অনেক কম৷
ছবি: DW/G. Ketels
টুকরা টুকরা করে ফেলা হয়
একটি মালবাহী শিপ গড়ে ২৫ থেকে ৩০ বছর ব্যবহার করা যায়৷ এরপর সেটার ইন্সুরেন্স এবং রক্ষণাবেক্ষণ খরচ এত বেড়ে যায় যে সেটি ব্যবহার আর লাভজনক থাকে না৷ ফলে অধিকাংশ জাহাজ তখন চলে যায় বাংলাদেশ, ভারত কিংবা পাকিস্তানের কোনো শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে৷ এ সব ইয়ার্ডে মূলত অদক্ষ শ্রমিকরা জাহাজ ভাঙার কাজ করে৷
ছবি: DW/G. Ketels
বিপজ্জনক বিনাশ
একটি জাহাজের ভেতরের অংশ প্রথমে ভাঙা হয়৷ কাজটি অত্যন্ত কঠিন এবং বিপজ্জনক৷ কেননা জাহাজ তৈরি করা হয় এমনভাবে, যাতে সেটা প্রতিকূল আবহাওয়ার মোকাবিলা করতে পারে এবং ভেঙে না যায়৷ তাই সেই জাহাজ কার্যত খালি হাতে ভাঙতে গিয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার শঙ্কায় থাকেন শ্রমিকরা৷
ছবি: DW/G. Ketels
ধীরে ধীরে মৃত্যু
অধিকাংশ শ্রমিককে কাজ করার সময় ‘প্রটেকটিভ গিয়ার’ দেয়া হয়না৷ তারা জাহাজ ভাঙেন খালি হাতে ‘এসেটিলিন টর্চ’ ব্যবহার করেন৷ অদক্ষ এই শ্রমিকরা কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনা বা বিস্ফোরণে আহত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন৷
ছবি: DW/G. Ketels
বিপজ্জনক অবস্থা
জাহাজ ভাঙা শিল্পের শ্রমিকরা কাজ করার সময় বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্যের সংস্পর্শে আসেন যা ফুসফুসে সমস্যা, এমনকি ক্যানসারেরও কারণ হতে পারে৷ আরা যাঁরা কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাঁদের পর্যাপ্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে না ইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ৷ এমনকি অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণও দেয়া হয় না৷
ছবি: DW/G. Ketels
স্টিলের উৎস
বেসরকারি উন্নয়নসংস্থা শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্মের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর দু’শ-র মতো জাহাজ চট্টগ্রামে ভাঙা হয়৷ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে স্টিলের যে চাহিদা রয়েছে, তার অধিকাংশই জোগাড় হয় জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে৷ চট্টগ্রামের উত্তরে সীতাকুণ্ড হচ্ছে এই শিল্পের রাজধানী৷ সেখানে বঙ্গোপসাগরের সমুদ্র সৈকতে আট মাইল এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছে এই শিল্প৷
ছবি: DW/G. Ketels
১৯৬৯ সালে শুরু
চট্টগ্রামে জাহাজ ভাঙা শুরু হয় ১৯৬৯ সালের দিকে৷ একটি স্টিল কোম্পানি সেসময় একটি অকেজো জাহাজ সেখানে নিয়ে যায় এবং ভাঙতে শুরু করে৷ কয়েক বছর লেগেছিল সেটি ভাঙতে৷ চট্টগ্রামে জাহাজ ভাঙা শিল্পের শুরুটা এভাবেই৷
ছবি: DW/G. Ketels
শিশুরাও কাজ করছে
জাহাজ ভাঙা শিল্পে শিশুশ্রম সাধারণ ব্যাপার৷ বাংলাদেশের মোট কর্মশক্তির এক পঞ্চমাংশের বয়স ১৫ বছরের নীচে৷ ধারণা করা হয় জাহাজ ভাঙা শিল্পের শ্রমিকদের অর্ধেকের বয়স ২২ বছরের নীচে৷ অল্প বয়সি শিশুরা গ্যাস কাটারদের সহযোগী হিসেবে কাজ করে এবং মালামাল বহন করে৷ এসব শিশু লেখাপড়ার সুযোগ পাওয়া না এবং বিরূপ পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য হয়৷
ছবি: DW/G. Ketels
পণ্য বিক্রি
জাহাজের মধ্যে পাওয়া বিভিন্ন পণ্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করেন শ্রমিকরা৷ এ সবের মধ্যে আসবাবপত্র এবং ‘শো পিস’ ছাড়াও রয়েছে মালিকদের জাহাজে ফেলে যাওয়া বিভিন্ন সামগ্রী৷
ছবি: DW/G. Ketels
দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষেধ
সীতাকুণ্ডের সমুদ্র সৈকত একসময় পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় এক স্থান ছিল৷ কিন্তু এখন জাহাজ ভাঙা শিল্পের কারণে সেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষেধ৷ শিপিং ইয়ার্ড থেকে বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক আশেপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে৷ বাংলাদেশ সরকার এক্ষেত্রে বেশ উদাসীন৷
ছবি: DW/G. Ketels
11 ছবি1 | 11
ইউরোপে যে গতবছর মাত্র চার শতাংশ জাহাজ ভাঙা হয়েছে, সেটার পিছনেও রয়েছে মালিকদের মুনাফার লোভ৷ কাজেই ইইউ-র নতুন আইনের প্রাথমিক লক্ষ্য শ্রমিক ও পরিবেশের সুরক্ষা হলেও, এর ফলে যে ইউরোপীয়, এবং সেই সঙ্গে তুর্কি ও চীনা শিপব্রেকিং শিল্পের হাতে আরো বেশি অর্ডার গিয়ে পড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷
অবশ্য ‘শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্ম'-এর পাট্রিৎসিয়া হাইডেগার-এর মতে, ইইউ এবার যে তালিকা প্রকাশ করবে, তার ফলে জাহাজ ভাঙার বাজার একটি নিরাপদ, ও একটি নিম্নমানের বাজারে বিভক্ত হবে৷
অপরদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন নিয়মাবলীতে একটি বড় ফাঁক রয়ে গেছে: জাহাজের মালিকরা তাদের জাহাজ ইইউ-বহির্ভূত কোনো দেশে নতুন করে রেজিস্ট্রি করতে পারেন, কিংবা তৃতীয় কাউকে বেচে দিতে পারেন – যার ফলে সেই জাহাজ তার ভাঙার সময় উপস্থিত হলে, শেষমেষ উপমহাদেশেই গিয়ে পৌঁছতে পারে৷