ফিলিস্তিনিদের সাহায্য করার জন্য তৈরি জাতিসংঘের সংগঠন যদি অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে আর্থিক ও সামাজিক সমস্যা হবে বলে বিশেষজ্ঞদের মত।
বিজ্ঞাপন
মধ্যপ্রাচ্যের মানুষকে সাহায্য করে জাতিসংঘের সংগঠন ইউনাইটেড নেশনস রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্কস এজেন্সি (ইউএনআরডাব্লিউএ)। তারা যদি অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যায় বা কাজের পরিধি কমিয়ে দেয় তখন কী হবে? সানা সারহাল বলছিলেন, ''তাহলে সহিংসতা ও দাঙ্গা হবে। এই সংগঠনের কাজ বন্ধ হওয়া মানে বিশাল ক্ষতি হওয়া।''
সারহাল গাজায় থাকেন না। ৪৩ বছর বয়সি থাকেন উত্তর লেবাননের একটি ত্রাণশিবিরে, যে শিবির ১৯৫৫ সালে প্রথম তৈরি হয়েছিল ফিলিস্তিনিদের জন্য, যে ফিলিস্তিনিরা যুদ্ধ ও সহিংসতার হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে এসেছিলেন।
ইউএনআরডাব্লিউএ যদি কাজের পরিধি কমিয়ে দেয়, তাহলে তার প্রভাব এখানেও পড়বে।
গত জানুয়ারিতে ইসরায়েল ইউএনআরডাব্লিউএ-কে বলে তাদের ১৩ হাজার কর্মীর মধ্যে ১২ জন ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণে অংশ নিয়েছিল। হামাসকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন বলে চিহ্নিত করেছে অ্যামেরিকা, ইইউ, জার্মানি-সহ বেশ কয়েকটি দেশ। এরপর ইউএনআরডাব্লিউএ ওই কর্মীদের বরখাস্ত করে এবং তদন্ত করে। এপি, গার্ডিয়ান, সিএনএন, ওয়াশিংটন পোস্টের মতো যে মিডিয়া সংস্থাগুলি ইসরায়েলের দেয়া তথ্যপঞ্জি দেখেছে, তাদের মত হলো, এই অভিযোগ স্বাধীনভাবে যাচাই করা যাচ্ছে না।
দক্ষিণ গাজায় উদ্বাস্তু শিবিরে ইসরায়েলের আক্রমণ
খান ইউনিসের ইউএনআরডাব্লিউএ-এর একটি শিবিরে ইসরায়েল আক্রমণ চালিয়েছে। অন্তত ১২ জন নিহত। মৃতের সংখ্যা বাড়ছে।
ছবি: Ohad Zwigenberg/AP/picture alliance
খান ইউনিসের আশ্রয়শিবির
দক্ষিণ গাজার সবচেয়ে বড় শহর খান ইউনিস। ইসরায়েল গাজা স্ট্রিপে অভিযান চালানোর পর থেকে বহু মানুষ ঘর-বাড়ি ছেড়ে দক্ষিণ গাজার এই শহরে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। এখানেই ইউনাইটেড নেশনস রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্ক এজেন্সি ফর প্যালেস্টাইনের (ইউএনআরডাব্লিউএ) সবচেয়ে বড় আশ্রয়শিবিরটি আছে।
ছবি: Ramez Habboub/AP Photo/picture alliance
ইসরায়েলের হামলা
এই আশ্রয় শিবিরে প্রায় ৪৩ হাজার উদ্বাস্তু বসবাস করছেন। শুধু তা-ই নয়, আশ্রয়শিবিরের বাইরে আরো অন্তত ৩০ হাজার মানুষ খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন। অভিযোগ, বৃহস্পতিবার এই আশ্রয় শিবির লক্ষ্য করে ইসরায়েল হামলা চালিয়েছে।
ছবি: Adel Hana/AP Photo/picture alliance
মৃতের সংখ্যা বাড়ছে
ইউএনআরডাব্লিউএ জানিয়েছে, এখনো পর্যন্ত ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। বহু মানুষকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে।
ছবি: Ohad Zwigenberg/AP/picture alliance
ইসরায়েলের মাইকিং
ওই আশ্রয় শিবিরটি কার্যত ঘিরে রেখেছে ইসরায়েলের সেনা। মাইকিং করে তারা বলছে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সকলকে ওই আশ্রয় শিবির ছেড়ে চলে যেতে হবে।
ছবি: Ohad Zwigenberg/AP/picture alliance
জাতিসংঘের প্রশ্ন
জাতিসংঘের বক্তব্য, হাজার হাজার মানুষের পক্ষে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আশ্রয়শিবির ছেড়ে চলে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। আশ্রয়শিবিরের বাইরে লড়াই চলছে। ফলে এই সময় শিবির ছেড়ে বাইরে যাওয়া মোটেই নিরাপদ নয়। তাছাড়া ৭০ হাজার মানুষের পক্ষে নতুন জায়গা খুঁজে বার করাও প্রায় অসম্ভব।
ছবি: Ohad Zwigenberg/AP/picture alliance
ইসরায়েল ও হামাসকে জানানো হয়েছিল
জাতিসংঘের সংস্থাটি জানিয়েছে, তারা আশ্রয় শিবিরের সমস্ত তথ্য ইসরায়েল এবং হামাসকে দিয়ে রেখেছিল, যাতে সেখানে কোনোভাবেই লড়াই না হয়। তারপরেও ওই শিবিরে আক্রমণ চালানো হলো।
ছবি: Ohad Zwigenberg/AP/picture alliance
আন্তর্জাতিক আদালতে গাজা মামলা
আন্তর্জাতিক আদালতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ করেছিল সাউথ আফ্রিকা। আন্তর্জাতিক আদালত সেই মামলার প্রাথমিক রায় শুক্রবার দিতে পারে। জাতিসংঘ অবশ্য আন্তর্জাতিক আদালতকে মামলাটি গ্রহণ না করার আর্জি জানিয়েছিল। কিন্তু আদালত মামলাটি শুনেছে।
ছবি: Nicolas Economou/NurPhoto/picture alliance
অভিযান বন্ধের আবেদন
সাউথ আফ্রিকা নয়টি পয়েন্ট আদালতের সামনে রেখেছে। গাজায় বেসামরিক মানুষের নিরাপত্তা, তাদের জন্য আরো ত্রাণের ব্যবস্থা এবং যত দ্রুত সম্ভব ইসরায়েলের অভিযান বন্ধের আবেদন ওই পয়েন্টগুলির মধ্যে আছে। শুক্রবার আদালত ওই বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
ছবি: THILO SCHMUELGEN/REUTERS
চার হুতি নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য চার হুতি নেতার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ওই নেতাদের নির্দেশেই লোহিত সাগরে হুতি বিদ্রোহীরা একের পর এক আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ।
ছবি: Mohammed Hamoud/Anadolu/picture alliance
9 ছবি1 | 9
ইসরায়েলের এই অভিযোগের জেরে জার্মানি, অ্যামেরিকা, ইইউ-র মতো ১৬টি দেশ ইউএনআরডাব্লিউএ-কে অর্থসাহায্য করা বন্ধ করে দেয়। ওই দেশগুলিই তাদের সবচেয়ে বেশি অর্থসাহায্য করত।
তারপর থেকে প্রশ্ন উঠেছে, ইউএনআরডাব্লিউএ-র অর্থাভাবের প্রভাব গাজায় কতটা পড়বে? ইউএনআরডাব্লিউএ-র বাজেটের ৪০ শতাংশ অর্থ এই এনক্লেভের ২০ লাখ মানুষকে সাহায্য করার জন্য খরচ করা হয়। বাকিটা লেবানন, জর্ডন, সিরিয়া ও অধিকৃত পশ্চিম তীরে খরচ করা হয়।
'রাষ্ট্রের পরিপূরক'
ব্রাসেলসের থিংক ট্যাংক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের জাতিসংঘ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড্যানিয়েল ফর্টি বলেছেন, ''ইউএনআরডাব্লিউএ-কে বলা যায়, ফিলিস্তিনিদের জন্য জনকল্যাণমূলক কাজের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের পরিপূরক আনঅফিশিয়াল সংস্থা। তারা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করে, খাদ্যসামগ্রী দেয়, স্বাস্থ্য পরিষেবা ও ত্রাণসামগ্রী দেয়। ফলে ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুরা যে সব দেশে আশ্রয় নিয়েছেন, সেই দেশকে বা প্রশাসনকে তাদের সামাজিক চাহিদা পূরণে খরচ করতে হয় না।''
৭ অক্টোবর নিয়ে ইসরায়েলের অভিযোগের আগে থেকে জাতিসংঘের এই সংগঠনকে নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক উঠেছে। ফর্টি জানিয়েছেন, ''ফিলিস্তিনিদের কাছে ইউএনআরডাব্লিউএ-র একটা প্রতীকী মূল্য আছে। তারা মনে করে এই সংগঠন ফিলিস্তিনিদের ফিরে যাওয়ার অধিকার রক্ষা করে। ইসরায়েল মনে করে, এই সংগঠন তাদের কাছে বিপদের কারণ।''
ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের আবার অর্থসাহায্য অ্যামেরিকার
বন্ধ করে দিয়েছিলেন ডনাল্ড ট্রাম্প। বাইডেন আবার ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের জন্য অর্থসাহায্যের ঘোষণা করলেন। ক্ষুব্ধ ইসরায়েল।
ছবি: Majdi Fathi/NurPhoto/picture alliance
বাইডেনের সিদ্ধান্ত
ফিলিস্তিনিদের জন্য ২৩ কোটি ৫০ লাখ ডলারের অর্থসাহায্য দেয়ার কথা ঘোষণা করলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি এই সাহায্য দেবেন ইউএন এজেন্সি ফর প্যালেস্টাইন রিফিউজিস ইন দ্য নিয়ার ইস্ট বা ইউএনআরডাব্লিউএ-কে।
ছবি: Evan Vucci/AP Photo/picture alliance
বন্ধ করেন ট্রাম্প
ফিলিস্তিনিদের আগে অ্যামেরিকা অর্থসাহায্য করত। কিন্তু ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ২০১৮ সালে তা বন্ধ করে দেন।
ছবি: Octavio Jones/REUTERS
নিরাপত্তা ও স্থায়িত্বের জন্য
মার্কিন সেক্রেটারি অফ স্টেট অ্যান্টনি ব্লিংকেন বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, এই অর্থ দিয়ে এলাকার স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। তাছাড়া যাদের খুব বেশি করে সাহায্য দরকার, তাদেরকে সাহায্য দেয়া হবে।
ছবি: Majdi Fathi/NurPhoto/picture alliance
৫৭ লাখ উদ্বাস্তুকে সাহায্য
ইউএনআরডাব্লিউএ প্রতি বছর ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক, গাজা স্ট্রিপ এবং মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে থাকা ৫৭ লাখ ফিলিস্তিনিকে সাহায্য করে।
ছবি: imago/photothek/T. Imo
ক্ষুব্ধ ইসরায়েল
বাইডেনের এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ ইসরায়েল। তাদের প্রতিক্রিয়া, তথাকথিত উদ্বাস্তুদের জন্য জাতিসংঘের এজেন্সির থাকারই দরকার নেই। অ্যামেরিকায় নিযুক্ত ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত বলেছেন, বাইডেন প্রশাসনের সিদ্ধান্তে তিনি হতাশ এবং তাদের এই নিয়ে যথেষ্ট আপত্তি রয়েছে।
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Issa
ফিলিস্তিনের প্রতিক্রিয়া
ফিলিস্তিন জানিয়েছে, তারা খুবই আগ্রহভরে ত্রাণসাহায্যের প্রত্যাশা করছে। তারা অ্যামেরিকার সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক চালুরও অপেক্ষায় আছে। ফিলিস্তিনিরা এমন এক রাষ্ট্র চান, যার রাজধানী হবে জেরুসালেম।
ছবি: Abed Rahim Khatib/AA/picture alliance
6 ছবি1 | 6
মার্চে সমস্যা শুরু হবে
মার্চের শেষ দিক থেকে ইউএনআরডাব্লিউএ অর্থাভাবের সমস্যা বুঝতে পারবে। তাদের কোনো জরুরি তহবিল নেই, যেখান থেকে অর্থ আসতে পারে।
নরওয়ের পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সিনিয়ার গবেষক জোরগান জেনসেহগান বলেছেন, ''প্রথমে গাজায়, তারপর লেবানন, সিরিয়া, তারপর ওয়েস্ট ব্যাংক ও জর্ডনে এর প্রভাব পড়বে।''
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা প্রোগ্রামের প্রধান জুস্ত হিলটারম্যান বলেছেন, লেবাননে এর প্রতিক্রিয়া খুব বেশি করে অনুভূত হবে। কারণ, সেখানকার আর্থিক অবস্থা খারাপ। ফলে তারা অতিরিক্ত কোনো আর্থিক বোঝা বহন করতে পারবে না। সিরিয়ার অবস্থাও সমান। বরং তুলনায় জর্ডনের পক্ষে উদ্বাস্তুদের ভার বহন করা সম্ভব।
জেনসেহগান জানিয়েছেন, ''কোনো স্কুল, স্বাস্থ্য পরিষেবা, কোনো সামাজিক সুবিধা সেখানে পাওয়া যাবে না। তার প্রভাব স্থানীয় মানুষের উপর পড়বে। শিবিরগুলিতে শুধু যে বিক্ষোভ হবে তাই নয়, অনেকে অর্থ রোজগার করতে পারবে বলে অপরাধী গোষ্ঠীগুলিতে বা সন্ত্রাসবাদী সংগঠনে যোগ দিতে পারে।''