খারকিভ পুনর্দখল করেছে ইউক্রেন। কীভাবে সেখানে অত্যাচার চালিয়েছে রাশিয়ার সেনা, বর্ণনা করেছেন এক নারী।
বিজ্ঞাপন
গত ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেন আক্রমণ করে প্রথমেই খারকিভ অঞ্চল দখল করে নিয়েছিল রাশিয়া। বস্তুত, তাদের সেখানে সাহায্য করেছিল রাশিয়াপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। সেপ্টেম্বরে ফের ওই অঞ্চল ইউক্রেন পুনর্দখল করেছে। গত ছয়মাস রাশিয়া সেখানে কীভাবে অত্যাচার চালিয়েছে, তা প্রকাশ পাচ্ছে।
বালাকলিয়ায় মারিনা নয়দিন জেলে ছিলেন
খারকিভেরইএকটি শহরের নাম বালাকলিয়া। মারিনা এবং তার স্বামী সেখানেই থাকেন। রাশিয়া যখন আক্রমণ করে, তারা তখন পালানোর কথা ভাবতে পারেননি। কারণ স্ট্রোক হওয়ার কারণে তার মা চলতে পারেন না। ফলে বালাকলিয়াতেই থেকে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন তারা।
মারিনার কথায়, খারকিভ অঞ্চলে রাশিয়াপন্থি অনেকেই আছেন। রাশিয়া আক্রমণ চালানোয় তারা খুশি। আবার তার মতো ইউক্রেনপন্থিও অনেকে আছেন। প্রথম থেকেই যাদের সন্দেহের চোখে দেখা হতো। বস্তুত, রাশিয়াপন্থিরা রাশিয়ার সেনা এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ইউক্রেনপন্থিদের পরিচয় ফাঁস করে দিয়েছিল। চিনিয়ে দিয়েছিল, কারা ইউক্রেনের হয়ে লড়াই করেছে। গোটা পরিস্থিতি স্ট্যালিনের আমলের মতো হয়ে গেছিল। খারকিভ ফিরে গেছিল ১৯৩০ এর দশকে।
যুদ্ধের আতঙ্ক নিয়ে ইউক্রেনে স্কুলে ফিরছে শিশুরা
02:15
রাশিয়ার সেনা শহরে ঢোকার পরে শুরু হয় লুঠতরাজ। রাস্তায় যখন তখন গাড়ি থামিয়ে সেই গাড়ি নিয়ে নিতে শুরু করে রাশিয়ার সেনা। বাড়ি থেকেও গাড়ি, বাইক চুরি হতে শুরু করে। যখন তখন সেনা বাড়িতে ঢুকে তল্লাশি চালাতে শুরু করে। মারিনার এক বন্ধুর বাড়িতে ঢুকে তার সেলফোন পরীক্ষা করা হয়। সেখানে যুদ্ধের সময় রাশিয়ার সেনার ছবি ছিল। শুধুমাত্র সেই কারণে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। মারিনার কাছেও ওই ধরনের ছবি ছিল।
পরিস্থিতি যখন এমন, মারিনা এবং তার স্বামী ঠিক করেন, রাশিয়ার ভিতর দিয়ে তারা পালিয়ে যাবেন। কারণ, ইউক্রেনের দিকে পালানো সম্ভব নয়। বিষয়টি নিয়ে তারা প্রতিবেশীদের সঙ্গেও আলোচনা করেন। খবর পৌঁছে যায় সেনার কানে। ছয়জন মুখোশ পরা ব্যক্তি আচমকাই তাদের তুলে নিয়ে যায় থানায়। সেখানে তাদের মাথার উপর ব্যাগ চাপিয়ে দেওয়া হয়। সেভাবেই বসে থাকতে হয় অনেকক্ষণ। শেষ পর্যন্ত একটি সাত ফুট বাই সাত ফুটের সেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় মারিনাকে। আগামী নয়দিন সেখানেই থাকতে হবে মারিনাকে। ছোট্ট ওই কুঠুরিতে একসঙ্গে থাকতে হয়েছে আটজন মেয়েকে। যার মধ্যে এক ৭০ বছরের বৃদ্ধাও ছিলেন।
রুশ গোলায় লাগা আগুন যেভাবে নেভান ইউক্রেনীয় দমকলকর্মীরা
আপৎকালীন পরিস্থিতিতে কাজের অভিজ্ঞতা ছিল ইউক্রেনের দমকলকর্মীদের। অগ্নিকাণ্ড মোকাবেলার জিনিসপত্র থাকতো তাদের কাছে। কিন্তু রুশ আগ্রাসন কঠিন কাজকে আরো কঠিন করে দিয়েছে।
ছবি: Leah Millis/Reuters
জ্বলছে ঘর, পুড়ছে বাড়ি
সুবিশাল এক অ্যাপার্টমেন্টে রাশিয়ার গোলাবর্ষণের ফলে আগুন লাগে। খারকিভের আশেপাশের এলাকাগুলিতেও গোলাবর্ষণ চলে। যুদ্ধপীড়িত ইউক্রেনের দমকলকর্মীরা এখন জানেন, একাধিক বাড়িতে আগুন লাগলে কোনটিকে আগে বাঁচাতে হবে, কাদের প্রথমে উদ্ধার করতে হবে এবং একই সময়ে কিলোমিটার দূরে কারখানায় আগুন লাগলে, তা কীভাবে সামলাতে হবে।
ছবি: Leah Millis/Reuters
একযোগে হার না মানা লড়াই
ইউক্রেনের খারকিভ শহরের একটি দমকলকেন্দ্রের প্রধান রোমান কাশানভ রয়টার্সকে বলেন, "একই সময়ে ছয় বা সাতটি অ্যাপার্টমেন্ট জ্বলতে দেখছেন। অথচ আপনি জানেন না কিছু লোক আদৌ কোথায় রয়েছে। এদিকে আপনার কাছে মাত্র তিনটি ট্রাক আছে। এটা একটা লটারির মতো।"
ছবি: Leah Millis/Reuters
পরিবারকে কবে দেখবেন
গোলাবর্ষণের মাঝেই রোমান কাশানভদের মনে পড়ে পরিবারকে। তার সাত বছরের শিশুকন্যা ভিওলেত্তা, স্ত্রী মারিনা জার্মানিতে রয়েছেন। জীবন মৃত্যুর মধ্যে লড়াই করতে করতে ভিডিও কলে প্রিয়জনের মুখ দেখেন কাশানভ। তার কথায়, "পরিস্থিতি ইরাক, আফগানিস্তানের মতো। কোথায় কখন বোমা হামলা হবে কেউ জানে না।"
ছবি: Leah Millis/Reuters
লড়ছেন নারী কর্মীরাও
মার্গারিটা এবং অন্যান্য দমকল কর্মীরা কাজের মাঝে কখনো সখনো জানলার বাইরে চোখ রাখেন। কিন্তু কালো পর্দায় ঢাকা তাদের কার্যালয় ভবনটি। যাতে সহজে সেটি লক্ষ্য করে শত্রুশিবির আক্রমণ করতে না পারে। উদাস চোখে চেয়ে থাকেন মার্গারিটা।
ছবি: Leah Millis/Reuters
মাঝরাতে কাজের ডাক
ঝুঁকি নেওয়ার জন্য অতিরিক্ত অর্থ পান দমকলকর্মীরা। কাজের ধরন বদলে যায়, কর্মীরা যাতে সবাই একটু বিশ্রাম নিতে পারেন, সে কথাও মাথায় রাখা হয়। কিন্তু মাঝরাতে ডাক এলেই আলেকজান্ডারের মতো কর্মীরা মানুষকে বাঁচাতে বেরিয়ে পড়েন। কাজের মাঝে প্রশিক্ষণ নেন, ব্যায়াম করেন কারণ সুস্থ থাকতেই হবে।
ছবি: Leah Millis/Reuters
অন্ধকারে কাজ
অগ্নিদগ্ধ বাড়িগুলিতে কাজ করতে হয় তাদের। অন্ধকার, সামান্য টর্চের আলো ভরসা। তারা খতিয়ে দেখেন, গোলার আঘাতের ফলে ভাগ্যজোরে কেউ বেঁচে রয়েছেন কিনা। কাশানভ বলেন, তিনি খুশি স্ত্রী এবং সন্তান নিরাপদে রয়েছে। প্রতি রাতে মেয়েকে গল্প বলে ঘুম পাড়িয়ে দেয়ার কথা মনে পড়ে তার।
ছবি: Leah Millis/Reuters
লক্ষ্যে অবিচল
বুলেটরোধক পোশাক, জ্যাকেট সবমিলিয়ে নিজের ওজনের থেকে প্রায় ২০ কেজি বেশি ওজন সমেত চলাফেরা করতে হয় তাদের। খারকিভের আপৎকালীন পরিষেবা বিভাগের গণণাধ্যম সচিব ইভজেনি ভাসিলেঙ্কো আগস্টে বলেছিলেন, যুদ্ধের শুরু থেকে, দমকলকর্মীরা ১৭০০ বার খারকিভের নানা এলাকায় গোলার হানার ফলে আগুন নিয়ন্ত্রণ করেছেন।
ছবি: Leah Millis/Reuters
খবর পড়েন মোবাইলে, ক্লান্তি আসে
ডিমা আর নিকোলাই বেশ পরিশ্রান্ত। ছবি দেখেই তা বোঝা যাচ্ছে। যুদ্ধ থেমে যাওয়ার আশা নিয়ে মোবাইলে খবরে চোখ রাখেন তারা। তারা জানেনা না কবে এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি মিলবে। মৃত শিশুর দেহ কিংবা অনাথ হয়ে যাওয়া শিশুর বাবা মায়ের দেহ দেখে বিচলিত হয়ে পড়েন কাশানভও। মানসিকভাবে একেবারে বিধ্বস্ত তিনি, জানান কাশানভ।
ছবি: Leah Millis/Reuters
মন শান্ত রাখার চেষ্টা
সামান্যতম সুযোগ পেলে একটু মন হালকা রাখার চেষ্টা করেন কেউ কেউ। মোবাইলে গান শোনেন হয়তো কিংবা মনকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা। মৃতদেহ দেখতে দেখতে চোখে জল চলে আসে দমকলকর্মীদের।
ছবি: Leah Millis/Reuters
প্রাণের ঝুঁকি, অপেক্ষা পরিস্থিতি বদলের
এতকিছুর মাঝেও লড়াই ছাড়ছেন না তারা, আশা রাখছেন পরিস্থিতির বদল হবে, প্রিয়জনকে ফিরে পাবেন এই দমকলকর্মীরাও। এই সাইনবোর্ডটা লাগাতে ইগর তার বন্ধুদের সাহায্য করছেন। এখানে লেখা আছে, শুভ সন্ধ্যা, আমরা ইউক্রেন থেকে এসেছি।
ছবি: Leah Millis/Reuters
10 ছবি1 | 10
এক রাতে ওই বৃদ্ধার বুকে ব্যথা শুরু হয়। অনেক ডেকেও কাউকে পাওয়া যায়নি। পরদিন সকালে থানার লোকেরা অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে আসে। দুইবেলার খাবারে দেওয়া হতো প্রায় পচে যাওয়া ভাত এবং টিনের মাংস। প্রথম দিন খেতে পারেননি মারিনা। পরে খেতে বাধ্য হয়েছেন।
প্রথম আটদিন সেই অর্থে অত্যাচার হয়নি। যদিও ওই কুঠুরিতে কাটানোই একরকমের অত্যাচার। নবম দিন তাকে নিয়ে যাওয়া হয় জেরার ঘরে। নিলডাউন করে বসিয়ে তার হাত পিছমোড়া করে দেওয়া হয়। মুখোশ পরা ব্যক্তিরা এরপর তাকে তার কাজ নিয়ে প্রশ্ন করতে থাকে। তার পায়ে এবং হাতে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয়।
মারিনা পরে শুনেছেন, তার স্বামীর উপরেও একইরকম অত্যাচার চালানো হয়েছে। নবম দিনেই অবশ্য ফের সেল থেকে ডেকে পাঠানো হয় মারিনাকে। বাইরে বেরিয়ে তিনি দেখেন তাকে এবং তার স্বামীকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। বিস্মিত হয়েছিলেন মারিনা। পরে জানতে পারেন, পুলিশ স্টেশনে এসে নিজের সমস্ত সোনার গয়না দিয়ে দিয়েছেন তার বোন। তারই বিনিময়ে তাদের মুক্তি হয়েছে।