ইউক্রেনের পাশে দাঁড়ালো ইউরোপ। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার চার দফা কর্মসূচি ও নতুন জোটের ঘোষণা করলেন।
শীর্ষবৈঠকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিও ছিলেন। ছবি: Carlos Jasso/REUTERS
বিজ্ঞাপন
কিযের স্টারমার জানমিয়েছেন, যুদ্ধ বন্ধ করতে এবং এবং ইউক্রেনকে রক্ষা করতে চার দফা কর্মসূচি নিয়ে চলতে চান তারা। লন্ডনে ইউক্রেন নিয়ে ইউরোপের দেশগুলির শীর্ষবৈঠকে স্টারমার বলেছেন, তারা ইউক্রেন নিয়ে 'কোযালিশন অফ দ্য উইলিং' বা ইচ্ছুক দেশগুলির জোটগঠনের চেষ্টা করবেন। তারা ইউক্রেনের জন্য অ্যামেরিকার সমর্থনও চাইবেন।
এই শীর্ষবৈঠকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি-সহ ১৮ জন শীর্ষনেতা যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে স্টারমার বলেন, ''আমরা ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি।''
বৈঠকের পর সাংবাদিক সম্মেলনে স্টারমার জানিয়েছেন, ''শীর্ষবৈঠকে চার দফা কর্মসূচি নিয়ে মতৈক্য হয়েছে। এই চার দফা কর্মসূচি হলো, ইউক্রেনকে সামরিক সাহায্য দেয়া হবে এবং রাশিয়ার উপর আর্থিক চাপ বহাল রাখা হবে। ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা বজায় রেখে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি আনতে হবে এবং শান্তি আলোচনায় ইউক্রেনের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। শান্তিচুক্তিতে ইউক্রেনের আত্মরক্ষার ক্ষমতা বৃদ্ধির কথা থাকবে। ভবিষ্যৎ আগ্রাসন বন্ধ করতে এটা জরুরি। এই চুক্তি যাতে ঠিকভাবে কার্যকর হয় সেটা নিশ্চিত করতে 'কোয়ালিশন অফ দ্য উইলিং' গঠন করা হবে এবং তারা পরবর্তীকালে শান্তি বজায় রাখার নিশ্চয়তা দেবে।''
স্টারমার বলেছেন, ''যুক্তরাজ্য ইউক্রেনকে দুইশ কোটি ডলার দেবে, যাতে তারা পাঁচ হাজার এয়ার ডিফেন্স মিসাইল কিনতে পারে। এছাড়াও রাশিয়ার ফ্রিজ করা সম্পদের লভ্যাংশ থেকে ২২০ কোটি ইউরো ইউক্রেনকে ঋণ হিসাবে দেয়া হবে।''
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পর ন্যাটো
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর ৩২টি পশ্চিমা রাষ্ট্রের সামরিক জোট ন্যাটোর অবস্থান নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। অনেক বিশ্লেষকই মনে করছেন, আবার ফিরে আসছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী স্নায়ুযুদ্ধের পরিস্থিতি।
ছবি: Gints Ivuskans/Getty Images/AFP
ন্যাটোয় ঢুকবে ইউক্রেন?
ন্যাটোতে ইউক্রেনের সদস্যপদ নিয়ে আলোচনা চলছে বেশ কয়েকবছর ধরেই। কিন্তু দেশটি আনুষ্ঠানিকভাবে সদস্যপদের জন্য আবেদন করে রাশিয়ার আক্রমণের পর, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে। ইউক্রেনের প্রতি ন্যাটোভুক্ত বিভিন্ন রাষ্ট্রের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও সদস্যপদ প্রাপ্তি এখনও অনেক দূরের পথ। অনেক দেশই মনে করে এমন পদক্ষেপ রাশিয়াকে আরো উসকে দিতে পারে। তাছাড়া দেশটির বিভিন্ন নীতি এখনও ন্যাটোর মানে পৌঁছায়নি বলেও মনে করে অনেক দেশ।
ছবি: Artur Widak/NurPhoto/picture alliance
ন্যাটোর নতুন সদস্য
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পর দীর্ঘদিন ধরে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে চলা দুই স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ ফিনল্যান্ড ও সুইডেন ন্যাটোয় যোগ দিয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে সবচেয়ে দীর্ঘ সীমান্ত ফিনল্যান্ডের। সোভিয়েত ইউনিয়নের ফিনল্যান্ড আগ্রাসনের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে, এমন ক্রমবর্ধমান আশঙ্কা থেকেই মূলত নিরপেক্ষতা নীতি ভেঙে ২০২৩ সালের এপ্রিলে ন্যাটোতে যোগ দেয় দেশটি। সুইডেন জোটে যোগ দেয় ২০২৪ সালের মার্চে।
ছবি: Pond5 Images/IMAGO
পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর উপস্থিতি
রাশিয়ার সম্ভাব্য আগ্রাসনের আশঙ্কায় রয়েছে পূর্ব ইউরোপের নানা দেশ। পূর্ব ইউরোপের আটটি দেশে ন্যাটোর উপস্থিতি বাড়ানো হয়েছে। ন্যাটো জানিয়েছে, এর মাধ্যমে জোটটি আবারও স্পষ্ট করছে, 'জোটের এক সদস্যের ওপর আক্রমণের মানে সবাইকে আক্রমণ'। পূর্ব ইউরোপের যেসব দেশে ন্যাটোর সামরিক উপস্থিতি বাড়ানো হয়েছে সেগুলো হচ্ছে বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, এস্তোনিয়া, লিথুয়ানিয়া এবং লাটভিয়া।
ছবি: U.S. Army/Zuma/imago images
বাল্টিকে সবচেয়ে বড় মহড়া
বাল্টিক সাগর এবং তার আশেপাশের অঞ্চলে ১৯৭১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সামরিক মহড়া করে আসছে ন্যাটো। এই মহড়াকে সংক্ষেপে বলা হয় বাল্টোপস। ২০২৪ সালের ৭ থেকে ২০ জুন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বাল্টোপসের ৫৩তম সংস্করণ ন্যাটোর ইতিহাসে এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় সামরিক মহড়া। ২০টি দেশ থেকে আসা নয় হাজার সৈন্য অংশ নেন এতে। ৩০টি যুদ্ধজাহাজ ছাড়াও স্থল ও আকাশপথেও মহড়া অনুষ্ঠিত হয়েছে।
ছবি: Getty Images/AFP/P. Malukas
নড়বড়ে মার্কিন অবস্থান
২০১৭ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ডনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন সময়ে ইউরোপে ন্যাটোর সহযোগীদের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। ন্যাটোর চুক্তি অনুসারে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর নিজেদের জিডিপির দুই শতাংশ ন্যাটোর প্রতিরক্ষা বাজেট হিসাবে দেয়ার কথা। বেশিরভাগ দেশই তা না করায় যুক্তরাষ্ট্রকেই জোটের প্রতিরক্ষা বাজেটের বড় অংশ বহন করতে হয়। এ নিয়ে সমালোচনা করায় জোটের অংশীদারদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল।
ছবি: Nicholas Kamm/AFP
ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা
নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আবার জিততে পারেন ডনাল্ড ট্রাম্প। ন্যাটোর সদস্যদের নিয়ে তার সাম্প্রতিক মন্তব্য ভাবিয়ে তুলেছে অনেককে। ফেব্রুয়ারিতে প্রচারণায় তিনি বলেছেন, কোনো দেশ বাজেট বরাদ্দ না করলে তাদের আক্রমণে তিনি রাশিয়াকে 'উৎসাহিত' করবেন। এই মন্তব্যকে 'ভয়াবহ এবং অনাকাঙ্খিত' বলে নিন্দা জানিয়েছে হোয়াইট হাউজ। এসব মন্তব্যে 'ন্যাটোর সদস্যরা ঝুঁকিতে পড়ছে' বলে মন্তব্য করেছেন ইয়েন্স স্টোলটেনবার্গ।
ছবি: picture-alliance/dpa/E. Vucci
শীর্ষে সম্ভাব্য পরিবর্তন
২০২৪ সালের জুলাইয়ে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর শীর্ষ সম্মেলনে জোটের নতুন প্রধান নিয়োগ দেয়া হতে পারে। বর্তমান প্রধান নরওয়ের ইয়েন্স স্টোলটেনবার্গের মেয়াদ বেশ কয়েকবার বাড়ানো হয়েছে। তবে এবার সে পদে বিদায়ী ডাচ প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটে বেশ এগিয়ে রয়েছেন। হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, রোমানিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশ তাকে সরাসরি সমর্থনও জানিয়েছে। ডনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে নানা বিষয়ে সহজে বোঝাপড়ার করার ইতিহাস রয়েছে তার।
ছবি: NATO
ইউরোপিয়ান সেনাবাহিনী
ট্রাম্পের আগের মেয়াদে ন্যাটোর সদস্যদের মধ্যে ইউরোপের নিরাপত্তা বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব সংকটে পড়েছিল। এরপরই ইউরোপের রাজনীতিতে জোরেসোরে উচ্চারিত হতে থাকে ন্যাটোর বিকল্প একটি ইউরোপীয় সেনাবাহিনী গঠনের প্রস্তাব। এই প্রস্তাবের মূলে ছিলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ। তবে এখনও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যরা এ নিয়ে ফলপ্রসূ আলোচনায় পৌঁছাতে পারেননি।
ছবি: FABRICE COFFRINI/AFP
8 ছবি1 | 8
তিনি জানিয়েছেন, ''আমাদের অতীতের ভুল থেকে শিখতে হবে। আমরা কোনো দুর্বল চুক্তি চাই না, যা রাশিয়া আবার ভঙ্গ করতে পারে। বরং শক্তিশালী অবস্থানে থেকে চুক্তি করতে চাই। ''
স্টারমার বলেছেন, ''চুক্তির শর্ত রাশিয়া ঠিক করবে তা হবে না। আমরা চাই, অ্যামেরিকাও এই চুক্তি সমর্থন করুক। ট্রাম্পের সঙ্গে আমি এই বিষয়ে একমত যে, স্থায়ী শান্তি প্রয়োজন। ''
ট্রাম্প কি বন্ধু হিসাবে নির্ভরযোগ্য? এই প্রশ্নের জবাবে স্টারমার বলেছেন, ''শুক্রবার যা হয়েছে, সেরকম ঘটনা কেউই চায় না। তবে অ্যামেরিকা নির্ভরয়োগ্য নয়, এমন কথা আমি মানতে চাই না।''
অন্যরা কী বললেন?
শীর্ষবৈঠকে যোগ দিয়েছিল ফ্রান্স, পোল্যান্ড, সুইডেন, তুরস্ক, নরওয়ে, চেক প্রজাতন্ত্র, ডেনমার্ক, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, রোমানিয়া, ফিনল্যান্ড, ইটালি, স্পেন এবং ক্যানাডা।
ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডেয়ার লাইয়েন বলেছেন, ''ইউরোপকে সামরিক দিক দিয়ে আরো সজ্জিত হতে হবে।''
ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল মার্ক রুটে বলেছেন, ''যতদিন সম্ভব ইউক্রেন যাতে লড়তে পারে, সে জন্য এই বৈঠক ডাকা হয়েছিল।''
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ বলেছেন, ''ইউরোপের দেশগুলিকে প্রতিরক্ষাখাতে জিডিপি-র তিন থেকে সাড়ে তিন শতাংশ অর্থ খরচ করতে হবে। গত তিন বছর ধরে রাশিয়া ১০ শতাংশ অর্থ প্রতিরক্ষায় খরচ করছে। তাই ইউরোপকেও প্রস্তুত থাকতে হবে।''
জার্মানির পরবর্তী চ্যান্সেলর হিসাবে যাকে চিহ্নিত করা হচ্ছে, সেই সিডিইউ নেতা ফ্রিডরিশ ম্যার্ৎস বলেছেন, ''স্টারমার ও মাক্রোঁ ইউক্রেনে দীর্ঘস্থৈা্য়ী শান্তির জন্য প্রয়াসের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাই তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে।''
জেলেনস্কি যা বলেছেন
শাীর্ষবৈঠকের পর জেলেনস্কি রাজা চার্লসের সঙ্গে দেখা করতে যান। তারপর তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ''লন্ডনের শীর্ষবৈঠক থেকে তার মনে হয়েছে, ইউরোপ এক হয়ে ইউক্রেনের পাশে আছে।''
তিনি বলেছেন, ''আমরা একযোগে কাজ করব এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে শান্তি ফেরাতে চাইব।''