সোমবার ইউক্রেনের দুই বিচ্ছিন্ন অংশের স্বীকৃতি ও সেখানে ‘শান্তিরক্ষী বাহিনী’ পাঠানোর ঘোষণা করে রুশ প্রেসিডেন্ট পুটিন সংঘাতের পথ বেছে নিলেন৷ সেই সিদ্ধান্তের জোরালো নিন্দার পর নিষেধাজ্ঞার প্রস্তুতি চলছে৷
বিজ্ঞাপন
যাবতীয় কূটনৈতিক চাপ ও জোরালো নিষেধাজ্ঞার হুমকি সত্ত্বেও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন শেষ পর্যন্ত সংঘাতের পথই বেছে নিলেন৷ সোমবার সন্ধ্যায় টেলিভিশনে এক দীর্ঘ ভাষণে নিজস্ব যুক্তি ও আবেগ তুলে ধরে তিনি প্রথমে ইউক্রেনের পূর্বে ডনবাস অঞ্চলের দুই স্বঘোষিত প্রজাতন্ত্রকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবার ঘোষণা করেন৷ তারপর সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে পুটিন ডিক্রি জারি করেন৷ শেষে লুহানস্ক ও দনেৎস্ক ‘প্রজাতন্ত্রের’ ডাকে সেখানে রুশ ‘শান্তিরক্ষী’ বাহিনী পাঠানোর ঘোষণাও করেন তিনি৷ ভাষণের আগে পুটিন জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁকে টেলিফোনে নিজের সিদ্ধান্তের কথা জানান৷
এভাবে ইউক্রেনের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ভূখণ্ডে রাশিয়া একতরফাভাবে সৈন্য মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় উত্তেজনা আরো বেড়ে গেল৷ রুশ বাহিনী প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা পর্যন্ত অগ্রসর হবে, নাকি লুহানস্ক ও দনেৎস্ক অঞ্চলে ইউক্রেন-নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডেও পা রাখার চেষ্টা করবে, তাও এখনো স্পষ্ট নয়৷ দনেৎস্ক শহরে ইতোমধ্যেই রুশ সামরিক সরঞ্জাম প্রবেশ করেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করছেন৷
বলা বাহুল্য, রুশ প্রেসিডেন্টের এমন চরম সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে৷ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেন, তিনি সহযোগী দেশগুলির কাছ থেকে স্পষ্ট ও কার্যকর পদক্ষেপ আশা করছেন৷ লুহানস্ক ও দনেৎস্কের স্বীকৃতির মাধ্যমে মস্কো ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত মিনস্ক প্রোটোকল থেকে একতরফাভাবে সরে গেল বলেও তিনি মনে করছেন৷ জেলেনস্কি আরো বলেন, ইউক্রেন রাশিয়ার প্ররোচনার প্রতিক্রিয়া না দেখালেও নিজস্ব ভূখণ্ড ছেড়ে দেবে না৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন টেলিফোনে তাঁর সঙ্গে কথা বলে ইউক্রেনের প্রতি সংহতি দেখিয়েছেন৷
এমন পরিস্থিতিতে রুশ প্রেসিডেন্ট পুটিনের সঙ্গে কূটনৈতিক সংলাপ চালানোর সার্থকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে৷ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের এক জরুরি বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত লিন্ডা টমাস-গ্রিনফিল্ড ‘শান্তিরক্ষী বাহিনী’ হিসেবে ইউক্রেনে রুশ সৈন্য পাঠানোর যুক্তি নাকচ করে দিয়ে বলেন, সে দেশের বাকি অংশেও হামলা চালানোর অজুহাত সৃষ্টি করছে মস্কো৷ জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ইউক্রেনের বিচ্ছিন্ন দুই অঞ্চলের স্বীকৃতির মাধ্যমে রাশিয়া জাতিসংঘের সনদ লঙ্ঘন করেছে৷ অ্যামেরিকা, ইউরোপ তথা পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার উপর ঘোষিত নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে৷
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কোনো দেশে রাশিয়ার উদ্যোগে এমন ভাঙনের প্রচেষ্টা প্রথম নয়৷ ২০০৮ সালে সে দেশ জর্জিয়ার দক্ষিণ ওসেটিয়া ও আবখাজিয়া অঞ্চলকেও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে একতরফা স্বীকৃতি দিয়েছিল৷ সেখানেও রুশ সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছিল৷
এসবি/এসিবি (ডিপিএ, রয়টার্স)
ভ্লাদিমির পুটিন: গোয়েন্দা থেকে প্রেসিডেন্ট
পড়াশোনা শেষে গোয়েন্দা হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন ভ্লাদিমির পুটিন৷ এরপর কয়েক বছরের মধ্যেই রাজনীতির শীর্ষে চলে আসতে সক্ষম হন তিনি৷
জন্ম ১৯৫২ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গে৷ ১৯৭৫ সালে আইন বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে সাবেক সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবিতে যোগ দিয়েছিলেন৷ তাঁর প্রথম দায়িত্ব ছিল নিজ শহর লেনিনগ্রাদে (পরবর্তীতে নাম হয় সেন্ট পিটার্সবার্গ) বিদেশি নাগরিক ও কনস্যুলেটের কর্মীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা৷ এরপর বদলি হন পূর্ব জার্মানির ড্রেসডেনে৷ বার্লিন প্রাচীর পতনের পর তিনি কেজিবির অনেক ফাইল পুড়িয়ে ফেলেন বলে জানা যায়৷
বামে তরুণ পুটিনকে দেখতে পাচ্ছেন? ছবিতে যে ব্যক্তিকে এক নারীর সঙ্গে হাত মেলাতে দেখা যাচ্ছে, তাঁর নাম আনাতোলি সবচাক৷ তিনিই প্রথম পুটিনকে রাজনীতিতে নিয়ে আসেন, নিজের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেন পুটিনকে৷
ছবি: Imago/ITAR-TASS
উল্কার বেগে উত্থান
খুব দ্রুতই সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে মস্কো চলে গিয়েছিলেন পুটিন৷ ১৯৯৭ সালে তৎকালীন রুশ প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলিৎসিন তাঁকে নিজের প্রশাসনে মাঝ পর্যায়ের এক পদে নিয়োগ দেন৷ এই পদটি আসলে ছিল গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বন্ধুত্ব গড়ে তোলার পদ, যার মাধ্যমে ভবিষ্যতে দেশ পরিচালনার অভিজ্ঞতা পেয়েছিলেন পুটিন৷
ছবি: picture alliance/AP Images
বন্ধুর মৃত্যু
২০০০ সালে সবচাকের মৃত্যু পুটিনকে আবেগে আক্রান্ত করেছিল৷ কারণ, যাঁরা পুটিনকে রাশিয়ার ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন তিনি৷ সবচাকের মৃত্যুর বছরখানেক আগে তাঁর বিরুদ্ধে থাকা প্রতারণার অভিযোগ নিজের রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে বাতিল করেছিলেন পুটিন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Chirikov
অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট
২০০০ সালের জুনে ইয়েলিৎসিন ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পুটিন অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন৷ এরপর যখন তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য প্রচারণা চালাচ্ছিলেন, তখন তাঁর বিরুদ্ধে সেন্ট পিটার্সবার্গ প্রশাসনে থাকাকালীন দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছিল৷ কিন্তু অভিযোগ যিনি এনেছিলেন, সেই সাংসদ মারিনা সালিয়েকে শেষ পর্যন্ত শহর ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল৷
ছবি: Imago/ITAR-TASS
রাজনৈতিক সঙ্গী
সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট হিসেবে দু’বার দায়িত্ব পালনের পর ২০০৮ সালে আর তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট হওয়া সম্ভব ছিল না পুটিনের৷ তাই সেই সময় তিনি তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মী দিমিত্রি মেদভেদেভকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে সমর্থন দিয়েছিলেন৷ আর নিজে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন৷ সেবারই সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয় আর প্রেসিডেন্টের মেয়াদকাল চার থেকে বাড়িয়ে ছয় বছর করা হয়৷ এরপর ২০১২ সালে আবার প্রেসিডেন্ট হন পুটিন৷
ছবি: Imago/ITAR-TASS
চতুর্থবার প্রেসিডেন্ট
১৮ মার্চ, ২০১৮ রবিবার অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আবারও জয়লাভ করেন পুটিন৷ ফলে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট থাকছেন তিনি৷ ২০৩০ সালেও তিনি প্রার্থী হবেন কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে পুটিন সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘‘১০০ বছর বয়স পর্যন্ত কাজ করে যাবার কোনো ইচ্ছা তাঁর নেই৷’’