ইউক্রেন যুদ্ধে উত্তর কোরিয়া রাশিয়াকে কীভাবে সাহায্য় করছে
২০ জুন ২০২৪
পিয়ংইয়ং মস্কোকে কয়েকলাখ গোলা এবং কার্তুজ দিয়েছে বলে জানা গেছে। বদলে রাশিয়াও সাহায্য়ের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
বিজ্ঞাপন
উত্তর কোরিয়ায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিনের সফর বিশ্ব রাজনীতিতে এক অন্য় মাত্রা যোগ করেছে। গত কয়েক দশকের মধ্যে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ হয়েছে বলে মনে করছেন কূটনীতিকেরা।
বিষয়টি আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে কারণ, কিম জং উন এবং পুটিন একটি সামরিক চুক্তি সই করেছেন। এতে বলা হয়েছে, অন্য় কোনো শক্তি এই দুই দেশের কোনো একটির উপর আক্রমণ চালালে অন্য় দেশ তাকে সাহায্য় করবে।
উল্লেখ্য, বছরখানেক ধরে অ্যামেরিকা এবং ইউক্রেন দাবি করছিল, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া উত্তর কোরিয়ার তৈরি কার্তুজ এবং গোলা ব্যবহার করছে। শুধু তা-ই নয়, উত্তর কোরিয়ার ব্যালেস্টিক মিসাইলও রাশিয়া ব্যবহার করেছে বলে অভিযোগ উঠেছিল। অন্যদিকে, রাশিয়া ইউক্রেনকে সামরিক এবং উপগ্রহ বিষয়ে প্রযুক্তিগত সাহায্য় করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে বার বার। যদিও দুই দেশই এ অভিযোগ মানতে চায়নি। কারণ, উত্তর কোরিয়াকে সামরিক সাহায্যের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের নির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা আছে। রাশিয়াও তা ভাঙতে পারে না।
পিয়ংইয়ং আরো পঞ্চাশ লাখ গোলা দিতে পারে
দক্ষিণ কোরিয়ার অভিযোগ, উত্তর কোরিয়া রাশিয়াকে আরো পঞ্চাশ লাখ গোলা পাঠিয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী শিন ওয়ানসিকের দাবি, তার দেশ অন্তত ১০ হাজার শিপিং কন্টেনার উত্তর কোরিয়া থেকে রাশিয়ার দিকে যেতে দেখেছে। যাতে গোলা ছিল বলেই মনে করা হচ্ছে। ব্লুমবার্গকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শিন বলেছেন, পিয়ংইয়ং সফরে এসে পুটিন আরো গোলা এবং কার্তুজ পাঠানোর আবেদন করেছেন বলে তাদের ধারণা।
কিমের রাশিয়া দর্শন
বিশেষ ট্রেনে চেপে প্রথমবারের মতো রাশিয়ায় গেলেন উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন৷ ১২ বছরের শাসনামলে দক্ষিণ কোরিয়া আর চীনের বাইরে এটি তার প্রথম ভিন্ন দেশে গমন৷
ছবি: Sputnik/Mikhail Metzel/Kremlin via REUTERS
‘চলমান দুর্গে’ চেপে
এই ট্রেনে চেপে ২০ ঘণ্টায় ৬৮০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে পিয়ং ইয়ং থেকে রাশিয়ায় ভ্লাদিভোস্তকে পৌঁছান কিম জং উন৷ উত্তর কোরিয়ার নিজেদের তৈরি এই ট্রেনটিকে ‘চলমান দুর্গ’ বলা চলে৷ সম্ভাব্য সব নিরাপত্তা ব্যবস্থা তো আছেই, সেই সঙ্গে ভেতরের বিলাসবহুল ব্যবস্থাও অবাক করার মতো৷
ছবি: Telegrammkanal @primamedia via AP/picture alliance/dpa/
সম্পর্কের ৭৫
সম্প্রতি প্রতিষ্ঠার ৭৫ বছর উদযাপন করেছে উত্তর কোরিয়া৷ প্রথম দেশ হিসেবে পিয়ং ইয়ংকে স্বীকৃতি দেয় তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়া৷ সেই হিসাবে দুই দেশের সম্পর্কও ৭৫-এ পা দিয়েছে৷ বুধবার কিমের সঙ্গে পুটিনের বৈঠকে সেই কথাই মনে করিয়ে দেন পুটিন৷
ছবি: Vladimir Smirnov, Sputnik, Kremlin Pool Photo via AP/picture alliance
সঙ্গে বোন
উত্তর কোরিয়ায় কিম জং উনের পরে তার বোন কিম ইয়ো জং-কে সবচেয়ে ক্ষমতাধর বলে মনে করা হয়৷ রাশিয়ার আমুর অঞ্চলে ভস্তচনিতে পুটিনের সঙ্গে বৈঠকের আগে তাকে দেখা যায়৷
ছবি: Vladimir Smirnov, Sputnik, Kremlin Pool Photo via AP/picture alliance
মহাকাশ কেন্দ্র পরিদর্শন
বুধবার কিম জং উনকে ভস্তচনি কসমড্রোম মহাকাশ উড্ডয়ন কেন্দ্রে নিয়ে যান পুটিন৷ এ সময় রকেট উড্ডয়ন প্রযুক্তি নিয়ে নানা তথ্য জানতে চান কৌতুহলী কিম৷ মস্কো কিমকে স্যাটেলাইট নির্মাণে সহায়তা করবে কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে পুটিন বলেন, ‘‘এই কারণেই এখানে আসা৷’’
ছবি: Yonhap/picture alliance
কিমের মহাকাশ ভাবনা
মহাকাশে সামরিক নজরদারি স্যাটেলাইট স্থাপনে পিয়ং ইয়ং ক্রেমলিনের সহায়তা চায় বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে৷ দক্ষিণ কোরিয়া জানিয়েছে, এই সফরে কিমের সঙ্গী হয়েছেন উত্তর কোরিয়ায় মহাকাশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কমিটির চেয়ারম্যান পাক থাই সং ও অ্যাডমিরাল মিয়ং সিক৷ তারা নজরদারি স্যাটেলাইট ও নিউক্লিয়ার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বহনে সক্ষম সাবমেরিন তৈরির প্রচেষ্টার সঙ্গে যুক্ত৷
ছবি: Sputnik/Mikhail Metzel/Kremlin via REUTERS
পুটিনের লিমুজিনে কিম
মহাকাশ উড্ডয়ন কেন্দ্রের কম্পাউন্ডে পার্ক করা ছিল পুটিনের ব্যবহৃত রাশিয়ার আউরুস লিমুজিন কার৷ দুই নেতার আলাপকালে কাছাকাছি পৌঁছাতে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকান গাড়িপ্রেমী কিম৷ বিষয়টি লক্ষ্য করে পুটিন তাকে গাড়িতে বসার আমন্ত্রণ জানান৷ সুযোগ হাতছাড়া করেননি কিম জং৷
ছবি: Sputnik/Mikhail Metzel/Kremlin via REUTERS
যুদ্ধে রাশিয়াকে সমর্থন
সফরে ইউক্রেন যুদ্ধে পুটিনকে ‘শর্তহীনভাবে পূর্ণ সমর্থন’ দিয়ে যাওয়ার কথা জানান কিম৷ নিজেদের মধ্যে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক জোরদার করার কথাও বলেন তারা৷ উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, ‘সাম্র্রাজ্যবাদী শক্তির সামরিক হুমকি ও উস্কানি বানচাল করতে’ একমত হয়েছেন দুই নেতা৷
ছবি: Sputnik/Mikhail Metzel/Kremlin via REUTERS
যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের দুশ্চিন্তা
রাশিয়া উত্তর কোরিয়ার কাছ থেকে গোলাবারুদ ও ক্ষেপণাস্ত্র সংগ্রহ করতে পারে বলে আশঙ্কা করছে যুক্তরাষ্ট্র৷ এ বিষয়ে উত্তর কোরিয়াকে সতর্ক করেছে যুক্তরাষ্ট্র৷ বৃহস্পতিবার উদ্বেগ জানিয়েছে জাপানও৷ তবে পিয়ং ইয়ংয়ের কাছ থেকে নিষিদ্ধ অস্ত্র নেয়ার আলোচনার কথা অস্বীকার করেছে মস্কো৷
ছবি: Mikhail Metzel, Sputnik, Kremlin Pool Photo via AP/picture alliance
পুটিনকে আমন্ত্রণ
উত্তর কোরিয়ার সংবাদ মাধ্যমের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, পুটিনকে উত্তর কোরিয়া ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন কিম৷ সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন পুটিন৷
ছবি: Sputnik/Artem Geodakyan/REUTERS
রাশিয়ায় প্রথমবার
উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন তার ১২ বছরের শাসনামলে এখন পর্যন্ত সাতবার দেশের বাইরে সফরে বেরিয়েছেন৷ এর মধ্যে দুই কোরিয়ার মধ্যে সীমান্ত পেরিয়েছেন দুইবার৷ আর বাকি চারবার গেছেন উত্তর কোরিয়ার প্রধান রাজনৈতিক মিত্র চীনে৷
ছবি: Korean Central News Agency/Korea News Service/AP/picture alliance
নিরাপত্তা
কিম যেখানেই যান না কেন সঙ্গে থাকে তার চৌকশ নিরাপত্তা দল৷ রাশিয়ায়ও তার ব্যতিক্রম হয়নি৷ ছবিতে ভস্তচনিতে পরিদর্শন শেষে ট্রেনে কিমের সফরসঙ্গীদের ট্রেনে উঠতে দেখা যাচ্ছে৷ বাইরে নজরদারিতে নিরপত্তারক্ষীরা৷
ছবি: Sputnik/Mikhail Metzel/Pool via REUTERS
11 ছবি1 | 11
এদিকে ডিডাব্লিউকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অস্ট্রিয়ার এক সামরিক বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, ইউক্রেনকে গত এক বছরে দশ লাখ গোলা দেওয়ার কথা ছিল পশ্চিমা দেশগুলির। কিন্তু তারা তার অর্ধেকও দিয়ে উঠতে পারেনি। অন্যদিকে, উত্তর কোরিয়ার কাছ থেকে রাশিয়া তার তিন গুণেরও বেশি গোলা আনিয়ে নিয়েছে।
উত্তর কোরিয়ার মিসাইল
মার্কিন গোয়েন্দারা গত জানুয়ারিতে অভিযোগ করেছিলেন, রাশিয়া ইউক্রেনে উত্তর কোরিয়ার তৈরি ব্য়ালেস্টিক মিসাইল ব্যবহার করেছে। যার রেঞ্জ প্রায় ৯০০ কিলোমিটার। পরে ইউক্রেনও একই দাবি করে। যদিও ব্যালেস্টিক মিসাইলের খুঁটিনাটি তথ্য মার্কিন গোয়েন্দারা দেননি।
উত্তরের আসল শত্রু দক্ষিণ
সামরিক বিশেষজ্ঞদের একটি অংশের বক্তব্য, উত্তর কোরিয়া দরকারের সময় রাশিয়াকে মিসাইল এবং গোলা দিয়ে সাহায্য় করলেও তাদের মূল লক্ষ্য রাশিয়ার কাছ থেকে আধুনিক সামরিক প্রযুক্তি শেখা। কারণ উত্তর কোরিয়ার মূল শত্রু দক্ষিণ কোরিয়া। কোনোভাবেই তারা নিজেদের অস্ত্রাগার শূন্য করে রাশিয়াকে সাহায্য করবে না। কারণ, তারা জানে, যে কোনো সময় দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে লড়াই হতে পারে। বস্তুত, বর্তমান পরিস্থিতিতে কোরিয়া সাগর অঞ্চলে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। একদিকে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান এবং অ্যামেরিকা জোটবদ্ধ এবং অন্যদিকে উত্তর কোরিয়া। এই পরিস্থিতিতে রাশিয়াকে কূটনৈতিক এবং কৌশলগতভাবে প্রয়োজন তাদের।
উত্তর কোরিয়ার শ্রমিক
কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের বক্তব্য, উত্তর কোরিয়া কেবলমাত্র সামরিক ক্ষেত্রেই রাশিয়াকে সাহায্য় করছে না, তারা শ্রমিক পাঠিয়েও সাহায্য করছে। ফ্রন্টলাইনে ইউক্রেনের যে জায়গাগুলি রাশিয়া নতুন করে দখল করতে শুরু করেছে, সেখানে শ্রমিক পাঠাচ্ছে উত্তর কোরিয়া। কারণ, রাশিয়ার অধিকাংশ শ্রমিক এখন যুদ্ধক্ষেত্রে। রাশিয়ার জন্য় এটিও একটি বড় সাহায্য। পাশাপাশি প্রথম দিন থেকেই ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার পাশে থেকেছে উত্তর কোরিয়া। এই বিষয়টিও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
চীন থেকে দূরে?
গত কয়েক বছরে কিম জং উনের আগ্রাসন আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা। যেভাবে একের পর এক সামরিক পরীক্ষা তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন, তা অভূতপূর্ব। এবং এর কারণ হলো, রাশিয়ার মতো শক্তি তার পিছনে আছে।
অন্য়দিকে, রাশিয়ার সঙ্গে কিমের এই সখ্য উত্তর কোরিয়াকে চীনের থেকে দূরে সরিয়ে নিতে পারে বলেও কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করছেন। তবে শেষ পর্যন্ত তা ঠিক কোন জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়।