তিন বছর আগে সাভারে রানা প্লাজা ধসে ১,১০০ জন পোশাক শ্রমিক নিহত হন৷ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, রানা প্লাজার পোশাক কারখানাগুলোতে যদি শ্রমিক ইউনিয়ন থাকত, তাহলে হতাহতের সংখ্যা অনেক কম হতো৷
বিজ্ঞাপন
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ) বৃহস্পতিবার তাদের এক প্রতিবেদনে জানায়, রানা প্লাজার কোনো গার্মেন্ট কারখানাতেই নাকি শ্রমিক ইউনিয়ন ছিল না৷ তাদের কথায়, যদি ঐ সব কারখানায় শ্রমিকদের সংগঠন থাকত, তাহলে ফাটল দেখা দেয়ার পরও জোর করে পোশাক শ্রমিকদের সেখানে কাজ করানো যেত না৷ আর তেমনটা হলে ভবন ধসে পড়লেও শ্রমিকরা সেখানে থাকতেন না, অর্থাৎ এত প্রাণহানি ঘটত না৷
এইচআরডাব্লিউ-র অভিযোগ, ‘‘রানা প্লাজা ধসের তিন বছর পরও বাংলাদেশের গার্মেন্ট শ্রমিকরা তাঁদের অধিকার আদায়ের জন্য শ্রমিক সংগঠন করতে গিয়ে দমনপীড়নের, এমনকি কারখানার পক্ষ থেকে হুমকিরও শিকার হচ্ছেন৷''
কল্পনা আখতার
ইউনিয়ন করার চেষ্টা করায় শ্রমিকদের শারীরিক নির্যাতন, ভয় দেখানো ও হুমকি, মিথ্যা অভিযোগসহ অনেকভাবে হয়রানি করার অভিযোগ পাওয়া গেছে বলেও জানিয়েছে এইচআরডাব্লিউ৷ তার ওপর সরকারও এ সবের জন্য গার্মেন্ট কারখানাগুলোর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছে৷
এইচআরডাব্লিউ-র কথায়, ‘‘রানা প্লাজা ধসের পর শ্রম আইন সংস্কারের বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে (ইইউ) প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বাংলাদেশ সরকার৷ অথচ এখনও বাংলাদেশে শ্রমিক ইউনিয়ন করার ব্যাপারে কঠোর নীতিমালা রয়েছে, যা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থি৷''
তারা জানায়, বাংলাদেশের সাড়ে চার হাজার গার্মেন্ট কারখানার মধ্যে শুধুমাত্র ১০ শতাংশ কারখানায় নিবন্ধিত শ্রমিক সংগঠন রয়েছে৷ তাই শ্রমিক সংগঠন করার ব্যাপারে আইনি ও বিদ্যমান বাধাগুলো দূর করার পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি৷
এইচআরডাব্লিউ-র এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ফিল রবার্টসন প্রতিবেদনে বলেন, ‘স্বাধীন শ্রমিক সংগঠনে বাধা দেওয়ার প্রবণতা শ্রমিক ও বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির ওপর হুমকিস্বরূপ৷ নিবন্ধিত ইউনিয়নের মাধ্যমে শ্রমিকদের অধিকার চর্চার সুযোগ দেওয়া এবং এ সব ইউনিয়নের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া গার্মেন্ট মালিকদের শাস্তির ব্যবস্থা করার জন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন৷'
ফিরে দেখা: আগুন, ভবন ধসে ক্ষতিগ্রস্ত পোশাক খাত
বাংলাদেশে তৈরি পোশাক ইউরোপ, অ্যামেরিকার প্রায় সব শপিং মলেই পাওয়া যায়৷ পোশাক খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি৷ আর এই খাত যেসব দুর্ঘটনায় ক্ষতির মুখে পড়েছে সেগুলো থাকছে এই ছবিঘরে৷
ছবি: Reuters
২৫.০২.২০১০: ‘গারিব এন্ড গারিবে’ আগুন
সুইডেনের একটি জনপ্রিয় ফ্যাশন চেইনের জন্য কাপড় তৈরি করার সময় আগুনে প্রাণ হারান গারিব এন্ড গারিব ফ্যাক্টরির কমপক্ষে ২১ শ্রমিক৷ নিহতদের মধ্যে ১৩ জন ছিলেন নারী আর কারখানাটি ছিল গাজীপুরে৷
ছবি: Imago/Xinhua
১৪.১২.২০১০: দ্যাটস ইট স্পোর্টসওয়ারে আগুন
সে আগুন প্রাণ হারান কমপক্ষে ২৯ ব্যক্তি, আহত অন্তত ২০০৷ হাম্মিম গ্রুপের কারখানাটি আধুনিক ভবনে অবস্থিত হলেও অভিযোগ রয়েছে অগ্নি নির্বাপকের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা তাতে ছিল না৷ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পোশাক উৎপাদন হতো কারখানাটিতে৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: picture-alliance/AP
২৪.১১.২০১২: তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন
ঢাকার অদূরে আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশন ফ্যাক্টরিতে অগ্নিকাণ্ডে নিহত কমপক্ষে ১১২, আহত কয়েকশত৷ নয় তলা ভবনটিতে আগুন লাগার পর অনেক পোশাক কর্মী লাফিয়ে পড়তে গিয়েও প্রাণ হারান৷ কেউ কেউ হয়েছেন জীবন্ত দগ্ধ৷ ভবনটির জরুরী বাইরে যাওয়ার গেটগুলো হয় বন্ধ ছিল, অথবা ব্যবহার অনুপযোগী ছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তাজরীনের মালিকের বিচার শুরু
আশার কথা হচ্ছে, তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির মালিক ও তাঁর স্ত্রীসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়েছে৷ ঢাকার একটি আদালতে বিচার কাজ চলছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
১৪.০৪.২০১৩: রানা প্লাজা ধস
ঢাকার অদূরে সাভারে রানা প্লাজা ভবন ধসে প্রাণ হারান কমপক্ষে ১,১৩৮ ব্যক্তি, আহত কয়েক হাজার৷ ইতিহাসের অন্যতম বড় দুর্ঘটনা এটি৷ রানা প্লাজা ধসে ক্ষতিগ্রস্তরা এখনো ন্যায্য ক্ষতিপূরণ পাননি৷ এই ঘটনায় দায়ীদের বিচার নিয়েও গড়িমসি চলছে৷
ছবি: Reuters
০৯.০৫.২০১৩: মিরপুর টেক্সটাইল ফ্যাক্টরিতে আগুন
মিরপুরে পোশাক কারখানায় আগুনে নিহত হয় কমপক্ষে আট ব্যক্তি৷ সেই ঘটনায় পোশাক কারখানাটির বাংলাদেশ অংশের প্রধান এবং একজন পুলিশ কর্মকর্তাও প্রাণ হারান বলে দাবি করেছে, পোশাক রপ্তানিকারকদের প্রতিষ্ঠান বিজিএমইএ৷ দ্রষ্টব্য: গ্যালারিটি তৈরিতে ক্লিন ক্লোদস ক্যাম্পেইন থেকে তথ্য নেয়া হয়েছে৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: Reuters
6 ছবি1 | 6
বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার সলিডারিটি-র নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশে এখন সব মিলিয়ে ৫০০ পোশাক রাখানায় শ্রমিক ইউনিয়নের নিবন্ধন আছে৷ অথচ পোশাক কারখানা প্রায় পাঁচ হাজার৷ এছাড়া যে ৫০০ করাখানায় শ্রমিক ইউনিয়নের নিবন্ধন আছে, তার মধ্যে সার্বেচ্চ ৫০টি কারখানার ইউনিয়ন শ্রমিক প্রতিনিধি দিয়ে করা৷ বাকিগুলোয় মালিকপক্ষের লোকজন দিয়ে নামে মাত্র ইউনিয়ন করা হয়েছে৷ শ্রমিকদের সেখানে কথা বলার সুযোগ নেই৷''
তাঁর কথায়, ‘‘আমরা আশা করেছিলাম রানা প্লাজার ঘটনার পর পরিস্থিতির উন্নতি হবে৷ মালিকপক্ষসহ সবাই সচেতন হবে৷ প্রকৃত শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ে তোলা হবে৷ কিন্তু বাস্তবচিত্র খুবই হতাশাজনক৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘শ্রমিক ইউনিয়ন থাকলে শ্রমিকদের নিরপত্তা, কাজের পরিবেশ, মজুরিই শুধু নিশ্চিত হয় না, এতে মালিকরাও লাভবান হন৷ কিন্তু মালিকরা তা বুঝতে চাইছেন না৷''
প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ২৪শে এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় ১,১০০-এরও বেশি গার্মেন্ট শ্রমিক নিহত হন, আহত হন আরো কয়েক হাজার৷ ভবনটিতে কয়েকটি গার্মেন্ট কারখানায় পাঁচ হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করতেন৷
রানা প্লাজা ধসের ঘটনা চাক্ষুস দেখার অভিজ্ঞতা কি আপনার আছে? থাকলে জানান আমাদের৷
বাংলাদেশে পোশাক কারখানার নিরাপত্তা
পশ্চিমা বিশ্বের একদল পরিদর্শক বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোতে ভয়াবহ নিরপত্তা ঝুঁকি দেখতে পেয়েছেন৷ রানা প্লাজা বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় তারা এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
রানা প্লাজা বিধ্বস্তের পর...
২০১৩ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশের সাভারে রানা প্লাজা বিধ্বস্ত হলে নিহত হয় অন্তত ১,১০০ পোশাক শ্রমিক৷ এ ঘটনার পর পশ্চিমা যেসব দেশে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি হয়, তারা পোশাক কারখানাগুলো পরিদর্শনের উদ্যোগ নেয়৷ সম্প্রতি বেশ কিছু নামি-দামি ব্র্যান্ডের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলো পরিদর্শন করেছেন৷
ছবি: Reuters
নিরাপত্তা ঝুঁকি
পরিদর্শকরা জানিয়েছেন, বেশিরভাগ পোশাক কারখানায় অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা এবং ভবনের কাঠামোর বিষয়ে অন্তত ৮০,০০০ নিরারপত্তা ইস্যু খুঁজে পেয়েছেন তাঁরা৷
ছবি: Kamrul Hasan Khan/AFP/Getty Images
২,২০০ কোটি মার্কিন ডলারের বাণিজ্য
বাংলাদেশে পোশাক খাতে বাণিজ্যের পরিমাণটি বিশাল৷ অর্থের অঙ্কে প্রায় ২,২০০ কোটি মার্কিন ডলার৷
ছবি: DW/C. Meyer
পোশাক রপ্তানিতে মন্দা
বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং পোশাক কারখানাগুলোতে নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে গার্মেন্টসগুলো তাদের ক্রেতা হারাচ্ছে৷ ফলে পোশাক রপ্তানির হার হ্রাস হয়েছে৷
ছবি: Reuters
পোশাক কারখানা পরিদর্শন
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পোশাক ব্র্যান্ড এইচঅ্যান্ডএম এবং ইনডিটেক্সসহ ১৮০টিরও বেশি ব্র্যান্ডের প্রতিনিধি ও সদস্যরা অন্তত ১,১০৬টি কারখানা পরিদর্শন করেছেন৷ তাঁরা জানিয়েছেন, প্রতিটি কারখানায় বৈদ্যুতিক ঝুঁকির পাশাপাশি, ভবনের কাঠামো ও অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থাতে গাফিলতি খুঁজে পেয়েছেন তাঁরা৷ এমনকি অনেক কারখানায় ফায়ার অ্যালার্ম ও ফায়ার এক্সিটও নেই৷
ছবি: DW/C. Meyer
অবিলম্বে খালি করার নির্দেশ
১৭টি কারখানা অবিলম্বে খালি করে বন্ধের নোটিস দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন পরিদর্শকরা৷ কারণ ঐ ১৭টি কারখানা যে কোনো মুহূর্তে ধসে পড়তে পারে বলে জানিয়েছেন তাঁরা৷ এছাড়া ১১০টি কারখানার ভবন বেশ ঝুঁকিপূর্ণ বলেও জানা গেছে৷
ছবি: Reuters
নিরাপত্তা ইস্যু খতিয়ে দেখা
এর আগে নর্থ অ্যামেরিকান কোম্পানি ওয়ালমার্ট ও গ্যাপ-এর মতো বেশ কিছু কোম্পানির প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের ৫৮০টি কারখানা পরিদর্শন করেছেন৷ উদ্দেশ্য একই, নিরাপত্তা ইস্যু খতিয়ে দেখা৷ দেশের অন্তত ৩০০টি কারখানায় ওয়ালমার্ট ও গ্যাপ-এর পোশাক তৈরি হয়৷
ছবি: AP
আশঙ্কায় শ্রমিকরা
তবে যেসব কারখানা বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে, সেসব শ্রমিকরা বেতন না পাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন৷ কেননা পরিদর্শকরা শ্রমিকদের বেতন দেয়ার কথা বললেও মালিকরা এ বিষয়ে কোনো প্রতিশ্রুতি দেননি৷
ছবি: Imago/Xinhua
পরবর্তী পদক্ষেপ
পরিদর্শকরা বেশিরভাগ কারখানার মালিক ও প্রকৌশলীদের নিয়ে আলোচনায় বসে কী কী ইস্যুতে পরিবর্তন আনা দরকার, তা নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে৷ এরপর আবারো তাঁরা পরিদর্শনে আসবেন নিজেদের নির্দেশনা কতটা বাস্তবায়ন হলো, তা দেখার জন্য৷