রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে আপত্তি প্রত্যাহার করেছে ইউনেস্কো৷ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এমন তথ্যই জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷ তবে তাতে কমছে না আপত্তি৷ বরং ইউনেস্কোকেই সন্দেহের চোখে দেখছেন আনু মুহাম্মদ৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Pacific Press/M. Hasan
বিজ্ঞাপন
এতদিন সুন্দরবনের কাছেই রামপালে ভারত -বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের তীব্র বিরোধিতা করছিল জাতিসংঘের এই সংস্থাটি৷ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা থেকে সরে না এলে ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় নেয়া হবে সুন্দরবনের নাম, এমন হুমকিও দিয়েছিল ইউনেস্কো৷
নিজের বক্তব্য থেকে ইউনেস্কোর হঠাৎ এমন সরে আসাকে তাই ভালো লক্ষণ হিসেবে দেখছেন না আন্দোলনকারীরা৷
তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর ও খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব আনু মুহাম্মদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ইউনেস্কো কয়েক বছর ধরে এ নিয়ে সমীক্ষা করেছে৷ তাদের বিশেষজ্ঞ দল রামপালে এসেছে৷ সরকারের নানা চেষ্টা সত্ত্বেও তারা স্বাধীনভাবে একটা বিশেষজ্ঞ মত দিয়েছে৷ কী কী কারণে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের জন্য সর্বনাশা হবে, সে বিষয়ে তাদের সুনির্দিষ্ট বক্তব্যও ছিল৷ সেই বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত তো পরিবর্তন হয়ে যায়নি৷''
রামপালে ইউনেস্কোর অনাপত্তি
This browser does not support the audio element.
গত বছর অক্টোবরে দীর্ঘ এক রিপোর্ট প্রকাশ করে ইউনেস্কো৷ রামপাল ঘুরে এসে বিভিন্ন পক্ষের সাথে কথা বলার পর তৈরি করা হয় এই প্রতিবেদন৷ কয়লা, বর্জ্য, শব্দ এবং শিল্পায়ন – এই চার বিষয়ে ক্ষতির আশঙ্কাও তুলে ধরা হয়৷
আনু মুহাম্মদ মনে করছেন, এই সিদ্ধান্তে ইউনেস্কোরই পরাজয় হয়েছে৷ তিনি বলেন, ‘‘সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের লবিস্টদের দীর্ঘদিনের চেষ্টার ফল ইউনেস্কোর এই মত পরিবর্তন৷ এতে ভারত সরকার এবং বিভিন্ন কোম্পানিরও ভূমিকা থাকতে পারে৷''
তবে এমন মন্তব্য একেবারেই মানতে নারাজ ইউনেস্কোতে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি শহিদুল ইসলাম৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘এতদিন সুন্দরবনের ক্ষতি প্রতিরোধে আমরা যে টেকনিক্যালি সাউন্ড, তা আমরা ইউনেস্কোকে বুঝাতে পারছিলাম না৷ তবে শেষ পর্যন্ত সরকার তা বোঝাতে সক্ষম হয়েছে৷''
পোল্যান্ডের বৈঠকে বাংলাদেশ সরকারকেসুন্দরবনসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে আবার কৌশলগত পরিবেশ সমীক্ষা করার অনুরোধ জানিয়েছে ইউনেস্কো৷ শহিদুল ইসলাম জানান, বাংলাদেশ আবারও সমীক্ষা করতে রাজি হয়েছে৷
শহিদুল ইসলাম
This browser does not support the audio element.
তবে কখন শুরু হবে সেই সমীক্ষা? শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘‘যোগ্য ফার্মকে নিয়মমাফিক কাজ দিয়ে তারা যে নাগাদ শেষ করতে পারবে, সেরকম সময়ই লাগবে৷ আনুমানিক ধারণা করা হয়েছে এই কাজ শেষ হতে ২০১৮ সালের শেষ নাগাদ লেগে যেতে পারে, কিংবা তার বেশিও হতে পারে৷''
সমীক্ষার প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার আগেই শুরু হবে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ৷ তবে শহিদুল ইসলাম মনে করছেন, ক্ষতিকর কিছু হতে পারে, সে ধারণা থেকে বসে থাকার সময় এখন আর নেই৷
গত বছরের জুলাইয়ে সরকারের দেয়া পরিবেশ সমীক্ষাকে ত্রুটিপূর্ণ বলে বয়কট করেছেন আন্দোলনকারীরা৷ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাও ‘অবৈজ্ঞানিক' আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখান করেছে এই প্রতিবেদন৷ এবারও সেরকমই একটি সমীক্ষার আশঙ্কা করছেন আনু মুহাম্মদ৷ ফলে তিনি মনে করেন, ‘‘ইউনেস্কো আপত্তি প্রত্যাহার করলেও বাংলাদেশের মানুষ তাদের আপত্তি প্রত্যাহার করছে না৷''
প্রতিবেদনটি নিয়ে আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচের ঘরে৷
সুন্দরবন ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে প্রতিক্রিয়া
বিদ্যুৎ অবশ্যই দরকার, বিশেষ করে গরিবদের তো আরো বেশি দরকার৷ তারপরও রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে তা হবে মর্মান্তিক৷ একদিকে দেশের-দশের প্রয়োজন, অন্যদিকে পরিবেশ বিপর্জয়ের ভয়৷ কী বলছে দেশের মানুষ?
ছবি: picture-alliance/dpa/Pacific Press/M. Hasan
মোশাহিদা সুলতানা, শিক্ষক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয়ের শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা ঋতুর মতে, সুন্দরবনের পাশে এত বড় একটা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করে একে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা কোনোভাবেই ঠিক হবে না৷ তাঁর মতে, সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই, কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিকল্প আছে৷
ছবি: DW
সায়েম ইউ চৌধুরী, পাখি ও বন্যপ্রাণী গবেষক
৪০ বারেরও বেশি সুন্দরবনে গেছেন সায়েম৷ তিনি জানান, সম্প্রতি চট্টগ্রামের একটি সার কারখানা থেকে অ্যামোনিয়া গ্যাস নিঃসরণ হয়ে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়৷ পুকুরের মাছ, গাছপালা, প্রাণী – সব মারা পড়ে৷ এ রকম ছোট একটা সার কারখানার দুর্ঘটনা থেকে আমাদের পরিবেশ রক্ষা করার সক্ষমতা যেখানে নেই, সেখানে এত বড় একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে কোনো দুর্ঘটনা হলে আমাদের সরকার কী-ই বা করার থাকবে?
ছবি: DW
মারুফ বিল্লাহ, স্থানীয় বাসিন্দা
মারুফ বিল্লাহর জন্ম রামপালেই৷ ছোটবেলা থেকেই তিনি সুন্দরবনকে ধ্বংস হতে দেখে আসছেন৷ আর এখন সুন্দরবন ঘেঁষে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করে একে ধ্বংসের আরেক পায়তারা করছে সরকার৷ তিনি জানান, সিডর আর আইলার পরে আমরা দেখেছি ঐ জনপদকে সে যাত্রায় বাঁচিয়েছিল সুন্দরবন৷ এখন যদি আমরাই তাকে মেরে ফেলি, তাহলে জনগণ কোথায় যাবে? তাই তাঁর প্রশ্ন, জীবন আগে, নাকি বিদ্যুৎ আগে?
ছবি: DW
সাইমুম জাহান হিয়া, শিক্ষার্থী
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাইমুম জাহান হিয়া মনে করেন, সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের পরিচয় বহন করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ বন৷ এর পাশে বিশাল আকারের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে যে কখনো কোনো দুর্ঘটনা হবে না – এটা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না৷ তাঁর মতে, দেশের উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রয়োজন আছে, এটা ঠিক, তবে সেটা সুন্দরবনকে ধ্বংস করে নয়৷
ছবি: DW
হাসিব মোহাম্মদ, শিক্ষার্থী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাসিব মোহাম্মদ কয়েকবার সুন্দরবনে গেছেন৷ আসলে এই বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র তাঁকে সবসময় টানে৷ তাই এ বনের কোনোরকম ক্ষতি করে তিনি এর কাছাকাছি রামপালের মতো কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র চান না৷ গত বছরের কয়েকটি ছোট ছোট জাহাজ সুন্দরবনে ডোবার পর যে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, সে কথাও মনে করিয়ে দেন তিনি৷ তাঁর আশঙ্কা, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে জাহাজ চলাচল বেড়ে গিয়ে দুর্ঘটনাও বাড়বে৷
ছবি: DW
মিমু দাস, শিক্ষার্থী
লেদার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র মিমু দাসও মনে করেন, সুন্দরবনের এত কাছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করা ঠিক হবে না৷ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার খবর পড়ে তাঁর মনে হয়েছে যে, এই বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করবে৷ মিমু বিদ্যুৎকেন্দ্র চান, তবে সেটা অন্য কোথাও৷
ছবি: DW
আদনান আজাদ আসিফ, মডেল ও অভিনেতা
মডেল ও অভিনেতা আদনান আজাদ আসিফ একজন ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফারও৷ কয়েক বছর ধরে সময় পেলেই তিনি সুন্দরবনে ছুটে যান৷ বিশ্বের সবেচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বেঙ্গল টাইগারের একমাত্র আবাসস্থল৷ তাঁর মতে, সুন্দরবন বাংলাদেশের ফুসফুস৷ আর এমনিতেই নানা কারণে এখানে বাঘের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে হ্রাস পেয়েছে৷ তাই এর কাছাকাছি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এমন কোনো প্রকল্প করে এ বনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া ঠিক হবে না৷
ছবি: DW
আমিনুর রহমান, চাকুরিজীবী
ঢাকার একটি পরিবহন সংস্থায় কাজ করেন আমিনুর রহমান৷ তাঁর মতে, দেশের উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ দরকার৷ তাই বড় কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে দেশের জন্য ভালোই হবে৷ তাছাড়া তিনি শুনেছেন যে, রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে তা সুন্দরবনের কোনো ক্ষতিই করবে না৷
ছবি: DW
আব্দুল আজীজ ঢালী, মধু চাষি
সুন্দরবনে গত ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মধু আহরণ করেন সাতক্ষীরার আব্দুল আজীজ ঢালী৷ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এ বনের সঙ্গে থাকতে চান তিনি৷ সুন্দরবনে থাকলেও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কে কিছুই জানেন না আব্দুল আজীজ৷
ছবি: DW
ভবেন বিশ্বাস, মাছ শিকারি
ভবেন বিশ্বাসের জীবিকার অন্যতম উৎস সুন্দরবন৷ উদবিড়াল দিয়ে এ বনে তিনি মাছ ধরেন ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে৷ তাঁর বাবা ও ঠাকুরদাদার এ পেশা এখনো তিনি ধরে রেখেছেন৷ রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে এ খবর তিনি শুনে থাকলেও, এর ভালো বা খারাপের দিকগুলো – কিছুই জানা নেই তাঁর৷ তবে সুন্দরবনকে তিনি ভালোবাসেন, খুব ভালোবাসেন৷