রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আপত্তি তুলে নিয়েছে ইউনেস্কো – পোল্যান্ডে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির সভা চলাকালেই সরকারের এ মন্তব্যে চলছে তোলপাড়৷ সভার ভিডিও, এমনকি ইউনেস্কোর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সিদ্ধান্তেও নেই এমন কোনো তথ্য৷
বিজ্ঞাপন
ইউনেস্কোর অফিশিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির ৫ তারিখের সভার ভিডিও সরাসরি প্রচারিত হয়েছে৷ প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার এই সেশনের দু'ঘণ্টা ৩৬ মিনিটে শুরু হয় বাংলাদেশের সুন্দরবন নিয়ে আলোচনা৷ প্রায় আধ ঘণ্টার এ আলোচনায় অংশ নেয় বাংলাদেশ ছাড়াও দশটি দেশ এবং পরিবেশবাদী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার-আইইউসিএন৷
ইউনেস্কোর ওয়েবসাইটে দেয়া খসড়া প্রস্তাবে দেখা যায়, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ঘুরে যাওয়া হেরিটেজ কমিটি ও আইইউসিএন প্রতিনিধি দলের সব সুপারিশ বাস্তবায়নে আবারও জোর দাবি জানানো হয়েছে৷ একই সাথে বলা হয়, এখনই ঝুঁকিপূর্ণ ঐতিহ্যের যেসব লক্ষণ দেখা যায়, সুন্দরবনে তা নেই৷ তবে, মিঠাপানির প্রবাহ, সুন্দরবনের আশেপাশে বড় আকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং সুন্দরবনের আউটস্ট্যান্ডিং ইউনিভার্সার ভ্যালু ঠিক রাখতে সমন্বিত পরিকিল্পনার অভাব রয়েছে৷
এ সব কারণে অচিরেই সুন্দরবনের অপূরণীয় ক্ষতি হবার আশংকা হেরিটেজ কমিটি এবং আইইউসিএন-এর৷ এজন্য এই সভাতেই সুন্দরবনকে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় নেয়ার সুপারিশও করা হয়৷
তবে এই বিষয়ে সর্বপ্রথম আপত্তি তোলে তুরস্ক৷ তুরস্কের মূল বক্তব্য ছিল, সুন্দরবনের পরিবেশ ও মিঠা পানির প্রবাহ নিয়ে দু'পক্ষের দ্বিমত রয়েছে৷ ফলে, মতপার্থক্য নিরসনে আরো সময় প্রয়োজন বলে মনে করে দেশটি৷ এছাড়া পরিবেশ সমীক্ষা করতে বাংলাদেশের রাজি হওয়া এবং সুন্দরবনের জটিল নদীব্যবস্থা পরিচালনা, এ সব যুক্তি দেখিয়েও বাংলাদেশকে আরো সময় দেয়ার অনুরোধ জানায় তুরস্ক৷
তুরস্কের বক্তব্যকেই সমর্থন করে লেবানন, কুয়েত, আজারবাইজান, ইন্দোনেশিয়া, পর্তুগাল, অ্যাঙ্গোলা এবং তানজানিয়া৷ ২০১৬ সালে দেয়া সুপারিশ বাস্তবায়নে মত জানায় জিম্বাবোয়ে৷ রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বন্ধের আহ্বানও জানায় দেশটি৷ তবে একই সাথে নিজেদের অবস্থান ব্যাখার জন্য বাংলাদেশকে আরো সময় দিতেও অনুরোধ জানায় জিম্বাবোয়ে৷
এদিকে, মূল সুপারিশ, অর্থাৎ এখনই সুন্দরবনকে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় স্থানান্তরের বিষয়ে একমত হলেও সভার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার কথা জানান ফিনল্যান্ডের প্রতিনিধি৷
ইউনেস্কোতে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি শহিদুল ইসলাম ছাড়াও সভায় উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী৷ তৌফিক-ই-ইলাহী তাঁর বক্তব্যে বরাবরের মতোই সুন্দরবন রক্ষায় সরকারের উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন৷
ইউনেস্কো রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাংলাদেশি সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেয়া বিবৃতিতে এমন তথ্য দেয়া হলেও, ইউনেস্কোর আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্তে পাওয়া যায়নি এমন কোনো কথা৷
আলোচনার পর – রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ বা স্থানান্তর না করলে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় স্থানান্তর করা হবে – এই অংশটুকু খসড়া থেকে বাদ দেয়া হয়৷ কিন্তু সভার সিদ্ধান্ত বা আলোচনা, কোনো অংশেই রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বিষয়ে অনাপত্তি, বা ছাড়পত্র দেয়ার মতো কোনো কিছুই ছিল না৷
সুন্দরবনের কাছেই প্রস্তাবিত অরিয়ন বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ বাতিল করায় সিদ্ধান্তে ধন্যবাদ জানানো হয়েছে বাংলাদেশকে৷ অপর দু'টি বক্তব্যে ২০১৬ সালে হেরিটেজ কমিটি এবং আইইউসিএন-এর করা সুপারিশ পূর্ণ বাস্তবায়ন করতেও অনুরোধ করা হয়েছে গৃহীত সিদ্ধান্তে৷
পশুর নদীর খননে পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) না করায় উদ্বেগও প্রকাশ করে ইউনেস্কো৷ সবশেষ, সুন্দরবন সংরক্ষণ নিয়ে আপডেট প্রতিবেদন এবং বাকি সব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রতিবেদনও ২০১৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির কাছে জমা দিতে অনুরোধ করা হয়েছে৷
খসড়াতে এর পরই ছিল সব সুপারিশ না মানলে ২০১৮ সালে কমিটির পরবর্তী বৈঠকে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় সুন্দরবনের নাম নেয়ার হুঁশিয়ারি৷ তবে গৃহীত সিদ্ধান্ত শুধু বাদ পড়েছে এই অংশটুকুই৷
সুন্দরবন ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে প্রতিক্রিয়া
বিদ্যুৎ অবশ্যই দরকার, বিশেষ করে গরিবদের তো আরো বেশি দরকার৷ তারপরও রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে তা হবে মর্মান্তিক৷ একদিকে দেশের-দশের প্রয়োজন, অন্যদিকে পরিবেশ বিপর্জয়ের ভয়৷ কী বলছে দেশের মানুষ?
ছবি: picture-alliance/dpa/Pacific Press/M. Hasan
মোশাহিদা সুলতানা, শিক্ষক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয়ের শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা ঋতুর মতে, সুন্দরবনের পাশে এত বড় একটা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করে একে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা কোনোভাবেই ঠিক হবে না৷ তাঁর মতে, সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই, কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিকল্প আছে৷
ছবি: DW
সায়েম ইউ চৌধুরী, পাখি ও বন্যপ্রাণী গবেষক
৪০ বারেরও বেশি সুন্দরবনে গেছেন সায়েম৷ তিনি জানান, সম্প্রতি চট্টগ্রামের একটি সার কারখানা থেকে অ্যামোনিয়া গ্যাস নিঃসরণ হয়ে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়৷ পুকুরের মাছ, গাছপালা, প্রাণী – সব মারা পড়ে৷ এ রকম ছোট একটা সার কারখানার দুর্ঘটনা থেকে আমাদের পরিবেশ রক্ষা করার সক্ষমতা যেখানে নেই, সেখানে এত বড় একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে কোনো দুর্ঘটনা হলে আমাদের সরকার কী-ই বা করার থাকবে?
ছবি: DW
মারুফ বিল্লাহ, স্থানীয় বাসিন্দা
মারুফ বিল্লাহর জন্ম রামপালেই৷ ছোটবেলা থেকেই তিনি সুন্দরবনকে ধ্বংস হতে দেখে আসছেন৷ আর এখন সুন্দরবন ঘেঁষে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করে একে ধ্বংসের আরেক পায়তারা করছে সরকার৷ তিনি জানান, সিডর আর আইলার পরে আমরা দেখেছি ঐ জনপদকে সে যাত্রায় বাঁচিয়েছিল সুন্দরবন৷ এখন যদি আমরাই তাকে মেরে ফেলি, তাহলে জনগণ কোথায় যাবে? তাই তাঁর প্রশ্ন, জীবন আগে, নাকি বিদ্যুৎ আগে?
ছবি: DW
সাইমুম জাহান হিয়া, শিক্ষার্থী
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাইমুম জাহান হিয়া মনে করেন, সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের পরিচয় বহন করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ বন৷ এর পাশে বিশাল আকারের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে যে কখনো কোনো দুর্ঘটনা হবে না – এটা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না৷ তাঁর মতে, দেশের উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রয়োজন আছে, এটা ঠিক, তবে সেটা সুন্দরবনকে ধ্বংস করে নয়৷
ছবি: DW
হাসিব মোহাম্মদ, শিক্ষার্থী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাসিব মোহাম্মদ কয়েকবার সুন্দরবনে গেছেন৷ আসলে এই বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র তাঁকে সবসময় টানে৷ তাই এ বনের কোনোরকম ক্ষতি করে তিনি এর কাছাকাছি রামপালের মতো কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র চান না৷ গত বছরের কয়েকটি ছোট ছোট জাহাজ সুন্দরবনে ডোবার পর যে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, সে কথাও মনে করিয়ে দেন তিনি৷ তাঁর আশঙ্কা, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে জাহাজ চলাচল বেড়ে গিয়ে দুর্ঘটনাও বাড়বে৷
ছবি: DW
মিমু দাস, শিক্ষার্থী
লেদার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র মিমু দাসও মনে করেন, সুন্দরবনের এত কাছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করা ঠিক হবে না৷ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার খবর পড়ে তাঁর মনে হয়েছে যে, এই বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করবে৷ মিমু বিদ্যুৎকেন্দ্র চান, তবে সেটা অন্য কোথাও৷
ছবি: DW
আদনান আজাদ আসিফ, মডেল ও অভিনেতা
মডেল ও অভিনেতা আদনান আজাদ আসিফ একজন ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফারও৷ কয়েক বছর ধরে সময় পেলেই তিনি সুন্দরবনে ছুটে যান৷ বিশ্বের সবেচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বেঙ্গল টাইগারের একমাত্র আবাসস্থল৷ তাঁর মতে, সুন্দরবন বাংলাদেশের ফুসফুস৷ আর এমনিতেই নানা কারণে এখানে বাঘের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে হ্রাস পেয়েছে৷ তাই এর কাছাকাছি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এমন কোনো প্রকল্প করে এ বনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া ঠিক হবে না৷
ছবি: DW
আমিনুর রহমান, চাকুরিজীবী
ঢাকার একটি পরিবহন সংস্থায় কাজ করেন আমিনুর রহমান৷ তাঁর মতে, দেশের উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ দরকার৷ তাই বড় কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে দেশের জন্য ভালোই হবে৷ তাছাড়া তিনি শুনেছেন যে, রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে তা সুন্দরবনের কোনো ক্ষতিই করবে না৷
ছবি: DW
আব্দুল আজীজ ঢালী, মধু চাষি
সুন্দরবনে গত ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মধু আহরণ করেন সাতক্ষীরার আব্দুল আজীজ ঢালী৷ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এ বনের সঙ্গে থাকতে চান তিনি৷ সুন্দরবনে থাকলেও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কে কিছুই জানেন না আব্দুল আজীজ৷
ছবি: DW
ভবেন বিশ্বাস, মাছ শিকারি
ভবেন বিশ্বাসের জীবিকার অন্যতম উৎস সুন্দরবন৷ উদবিড়াল দিয়ে এ বনে তিনি মাছ ধরেন ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে৷ তাঁর বাবা ও ঠাকুরদাদার এ পেশা এখনো তিনি ধরে রেখেছেন৷ রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে এ খবর তিনি শুনে থাকলেও, এর ভালো বা খারাপের দিকগুলো – কিছুই জানা নেই তাঁর৷ তবে সুন্দরবনকে তিনি ভালোবাসেন, খুব ভালোবাসেন৷