শিক্ষা খাতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সফল ব্যবহার করায় ‘আইসিটি ইন এডুকেশন' বিভাগে ‘ইউনেস্কো কিং হামাদ বিন ইসা আল খলিফা' পুরস্কার পেয়েছে জাগো ফাউন্ডেশন৷ তাদের সঙ্গে যৌথভাবে পুরস্কারটি পেয়েছে জার্মানির এনজিও ‘কিরণ'৷
বিজ্ঞাপন
বস্তির শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেশে দারিদ্র্য দূর করার অঙ্গীকার করেছিলেন করভী রাকসান্দ৷ আর এ জন্য বস্তির একটি ঘর ভাড়া করেছিলেন পাঠদান কার্যক্রমের জন্য৷ প্রতিদিন বস্তির ঐ শিশুদের বাবা-মা কে আধা কেজি করে চাল দিতেন যাতে তাঁরা সন্তানদের ঐ স্কুলে পাঠায়৷ সেই থেকে শুরু, করভীর সেই কাজ আজ নেশায় পরিণত হয়েছে৷ প্রতিষ্ঠা করেছেন ১০ টি অনলাইন স্কুল৷ এছাড়া নির্মাণ করেছেন ৩টি স্কুল৷ এসবের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে হাজারো শিশুর মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে করভীর ‘জাগো ফাউন্ডেশন'৷
মঙ্গলবার থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে করভী বলেন, ‘‘আমরা যেটা করেছি সেটা কোনো মহাকাশে রকেট পাঠানোর মতো কঠিন কাজ নয়, এটা খুবই সাধারণ ব্যবস্থা, কিন্তু যে জিনিসটি কেউ কখনো করার চেষ্টা করেনি৷''
ইউনিসেফ-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা বিনামূল্যে হওয়া সত্ত্বেও বস্তিতে থাকা অর্ধেকেরও বেশি শিশু স্কুলে যায় না৷
করভী রয়টার্স ফাউন্ডেশনকে বলেন, ‘‘প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে স্কাইপ, ম্যাসেজিং এবং ভিডিও কল-এর মাধ্যমে পাঠদান করা হয়৷ কিন্তু বর্তমানে শিক্ষকরা ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে লাইভ টিউটোরিয়াল, বিশ্লেষণমূলক তালিকা এবং শিক্ষামূলক ভিডিও দেখায়, যেগুলো শিশুদের তাড়াতাড়ি শিখতে সাহায্য করে৷'' ‘‘এই শিশুরা নিজেদের জন্য ভিডিওতে দেখে, তখন নিজেদের তারকা ভাবতে শুরু করে৷ এছাড়া ঢাকায় যারা পাঠ দান করেন, অনেক সময় তাদের মধ্যে তারকা শিল্পী বা অভিনেত্রীরাও থাকেন৷ তাই তারা খুব ভালোবেসে পড়ালেখাটা শেখে৷''
সবার জন্য গুণগত শিক্ষা জাতিসংঘের ১৭ টা লক্ষ্যের অন্যতম, যা তারা ২০৩০ সালের মধ্যে পূরণ করতে চায়৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বে যুদ্ধ, দারিদ্র্য এবং স্থানান্তরের কারণে লাখো শিশু ও বয়স্ক মানুষ শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে৷
মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ইউনেস্কোর সদর দফতর থেকে পুরস্কারটি গ্রহণ করেন জাগো ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা করভী রাকসান্দ৷
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আইসিটি সুবিধা ব্যবহার করে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিয়েছে জাগো ফাউন্ডেশন৷ তার এই কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পুরস্কার পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি৷
একুশে ফেব্রুয়ারির মতো ঐতিহাসিক দিনে এই পুরস্কার দেয়ার জন্য ইউনেস্কোকে ধন্যবাদ জানান করভী৷ অনুষ্ঠানে অনলাইন স্কুলের শিশুদের সঙ্গে সরাসরি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কথা বলেন উপস্থিত অতিথিরা৷ পুরস্কার হিসেবে ২৫ হাজার মার্কিন ডলার ও একটি করে সনদপত্র দেয়া হয়েছে৷
অন্যদিকে, জার্মানির বেসরকারি সংস্থা কিরণ শরণার্থীদের স্মার্টফোনের মাধ্যমে হিসাব বিজ্ঞান, প্রকৌশল এবং অন্যান্য কোর্স করায়৷ জার্মানি, ফ্রান্স, তুরস্ক ও জর্ডানের ২৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ হাজার শিক্ষার্থী এই শিক্ষাদানের সঙ্গে জড়িত৷
এপিবি/এসিবি (এপি, এএফপি, রয়টার্স)
শিশুদের নানা রকমের ক্লাসরুম
বর্ণমালার সঙ্গে পরিচয়ের মাধ্যমে শুরু হয় শিক্ষাজীবন৷ সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য শিশুদের শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই৷ চলুন দেখা যাক, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শ্রেণিকক্ষে শিশুদের কীভাবে লেখাপড়া শেখানো হয়৷
ছবি: picture-alliance/landov
বেশির ভাগ দেশের শ্রেণিকক্ষে যা থাকে...
বিশ্বের প্রায় সব দেশের শ্রেণিকক্ষেই চক আর ব্ল্যাক বোর্ড থাকে৷ শিক্ষক বা শিক্ষিকা সেই ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে শিক্ষার্থীদের বোঝান৷ শিক্ষার্থীরা বেঞ্চে বসে বসে শোনে৷ তবে অনেক দেশই এই সাবেকি ব্ল্যাকবোর্ড এবং চক ছেড়ে দিয়েছে৷ আবার এমন দেশও আছে, যেখানে ছাত্র-ছাত্রীদের মাথার ওপরে কোনো ছাদ নেই৷ মাটিতে বসেই লেখাপড়া করতে হয় তাদের৷
ছবি: AP
দক্ষিণ কোরিয়ায় ডিজিটাল বই...
দক্ষিণ কোরিয়ার স্কুলে এসে গেছে কম্পিউটার৷ ইন্টারনেট সংযোগও দেয়া হয়েছে প্রতিটি ক্লাসরুমে৷ অর্থাৎ ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীদের হাতে কোনো বই-খাতা থাকবে না৷ বইয়ের পরিবর্তে ‘ই-বুক’ দেয়া হবে তাদের৷ সেই লক্ষ্যেই কাজ করছে সরকার৷ সবাইকে ডিজিটাল শিক্ষাদান পদ্ধতির আওতায় নিতে দরিদ্র পরিবারের ছেলে-মেয়েদের বিনামূল্যে ‘ট্যাবলেট পিসি’ দেয়ার কথাও ভাবা হচ্ছে৷
ছবি: AP
ঘানার শিশুদের অবস্থা
অনেক দেশের স্কুলে আবার কম্পিউটার তো দূরের কথা, ক্লাসরুমই নেই৷ আফ্রিকার দেশ ঘানার এই স্কুলটি দেখুন৷ ভবনই নেই! তাই গাছের ছায়াতেই নেয়া হচ্ছে ক্লাস৷ শিক্ষিকা পড়াচ্ছেন আর ছোটমনিরা বেঞ্চে বসে মন দিয়ে শুনছে তাঁর কথা৷
ছবি: Fotolia/Living Legend
জার্মানির অত্যাধুনিক ক্লাসরুম
জার্মানিতে কিন্তু ছোট ছোট বাচ্চারাও ক্লাসে পেন্সিল ব্যবহার করে না৷ নোট লেখার বইও নয়৷ টাচ প্যাড, স্মার্টবোর্ড, নেটবুক – এই সমস্ত আধুনিক জিনিসপত্র এ বয়সেই এসে গেছে তাদের হাতে৷
ছবি: AP
যুক্তরাষ্ট্রের স্কুল
শিল্পোন্নত দেশগুলোতে শিশুদের শিক্ষা যেন বাড়তি চাপ৷ ছবির এই চার বছর বয়সি শিশুগুলোর মতো সব শিশুকেই বলতে গেলে মায়ের কোল থেকে নেমে ঢুকে পড়তে হয় স্কুলে৷ চাপ যে তখন থেকেই শুরু!
ছবি: AP
কেনিয়ার স্কুল এবং ক্লাসরুম
কেনিয়ায় শিক্ষাজীবনের প্রথম আট বছর শিক্ষার্থীদের কোনো বেতন দিতে হয় না৷ তারপরও লেখাপড়া করা সবার জন্য খুব সহজসাধ্য নয়৷ দরিদ্র পরিবারের বাবা-মায়েরা বই-খাতা, পেন্সিল, পোশাক, জুতো ইত্যাদির খরচ জোগাতে পারেন না বলে অনেক শিশুকেই লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হয়৷
ছবি: DW/J.Bruck
ব্রিটেনের স্কুলে ‘ইউনিফর্ম’ বাধ্যতামূলক
ইংল্যান্ডের প্রায় সব স্কুলেই শিক্ষার্থীদের নির্ধারিত পোশাক পরতে হয়৷ সবাই এক রকম পোশাক পরলে শিক্ষার্থীদের চিনতে সুবিধা হয় এবং তাদের পড়াশোনাতেও মন বসে – এমন কিছু যুক্তিতেই শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট পোশাক পরার নিয়ম মানছে স্কুলগুলো৷ তবে ব্রিটেনে একটা সুবিধা আছে৷ দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ হিসেবে অনুদান দেয়া হয়৷ ফলে দরিদ্ররা চাইলেই ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে পারেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/dpaweb
পাকিস্তিনে অবহেলিত শিক্ষাখাত
পাকিস্তানে গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কমিয়ে সামরিক খাতে ব্যয় বাড়ানো হচ্ছে৷ ফলে শিক্ষার হার আরো কমছে, কমছে স্কুলও৷ ওপরের ছবিতে একটি পার্কে লেখাপড়া করতে দেখা যাচ্ছে শিশুদের৷ পাকিস্তানে এমন দৃশ্য অপরিচিত নয়৷
ছবি: AP
দক্ষিণ সুদানে মেয়েরা বিপদে...
দক্ষিণ সুদানেও প্রায় একই অবস্থা৷ গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত দেশটির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে রীতিমতো সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হচ্ছে৷ সে দেশের মাত্র ১৬ ভাগ নারী এখন কোনো রকমে পড়তে এবং লিখতে পারে৷ যুদ্ধের ধ্বংসলীলা থেকে হাতে গোনা যে কয়েকটি স্কুল রক্ষা পেয়েছে, তার মধ্যে অনেকগুলোতে চেয়ার-টেবিল, বেঞ্চ নেই৷ বই-পত্রও নেই কিছু স্কুলে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
উন্নতিশীল ব্রাজিলেরও করুণ অবস্থা
দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে ব্রাজিলে৷ কিন্তু তাতে দরিদ্রদের ভাগ্যের খুব একটা উন্নতি হচ্ছে না৷ গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলোতে তাই খুব কষ্ট করে লেখাপড়া করতে হয় শিশুদের৷
ছবি: dapd
উন্নতিশীল ব্রাজিলেরও করুণ অবস্থা
দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে ব্রাজিলে৷ কিন্তু তাতে দরিদ্রদের ভাগ্যের খুব একটা উন্নতি হচ্ছে না৷ গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলোতে তাই খুব কষ্ট করে লেখাপড়া করতে হয় শিশুদের৷
ছবি: picture-alliance/dpa
এবং বাংলাদেশ...
২০১৩ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের সময় অসংখ্য স্কুলের ক্ষতি সাধন করা হয় বাংলাদেশ৷ এ বছর দীর্ঘদিন হরতাল, অবরোধ চলায় স্কুলগুলোও অনেক দিন বন্ধ ছিল৷ এক পর্যায়ে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ক্লাস নিতে শুরু করে কিছু স্কুল৷ হরতাল-অবরোধের কারণে সপ্তাহের ৫-৬ দিন গৃহবন্দী, তারপর ছুটির দিনে স্কুলবন্দী৷ বাংলাদেশের শিশুদের অসহায়ত্ব ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন৷