পরমাণু বিজ্ঞানীর হত্যার পর দেশের ইউরেনিয়াম মজুত কয়েক গুণ বাড়াতে চাইছে ইরানের পার্লামেন্ট।
বিজ্ঞাপন
ইরানের পার্লামেন্ট নতুন আইনের প্রস্তাব পাঠালো প্রেসিডেন্টের কাছে। যেখানে বলা হয়েছে, দুই মাসের মধ্যে ইরানের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা না তুললে দেশে ইউরেনিয়ামের মজুত কয়েক গুণ বাড়ানো হবে। প্রেসিডেন্ট অবশ্য জানিয়েছেন, এখনই এ ধরনের আইন প্রণয়নের তিনি বিরোধী। এর ফলে কূটনৈতিক চাপ আরো বৃদ্ধি পাবে। তবে পার্লামেন্ট সর্বসম্মতিক্রমে নতুন আইন তৈরির পক্ষে। তাদের বক্তব্য, ইসরায়েল যে ভাবে চক্রান্ত করে দেশের পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফখরিজাদেহকে হত্যা করেছে, তার পর এমন আইনই বলবৎ করা উচিত।
পরমাণু পরীক্ষায় ইউরেনিয়াম সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। ইউরেনিয়ামের পরিমাণ বাড়ানোর অর্থ পরমাণু অস্ত্র তৈরির পরিকল্পনা। ২০১৫ সালে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তিতে স্থির হয়েছিল ইরান পরমাণু পরীক্ষার জন্য তিন দশমিক ছয় সাত শতাংশের বেশি ইউরেনিয়াম মজুত করতে পারবে না। পার্লামেন্ট নতুন যে আইনের কথা বলেছে, তাতে ২০ শতাংশ ইউরেনিয়াম মজুত করার কথা বলা হয়েছে। যা রাখা হবে দেশের দুইটি পরমাণু কেন্দ্রে। যা থাকলে যে কোনো পরমাণু অস্ত্র তৈরি করা সম্ভব। আইনে বলা হয়েছে, জাতিসংঘকেও পরমাণু কেন্দ্রে যেতে দেওয়া হবে না। আইনে স্পষ্ট ভাবে বলা আছে, দুই মাসের মধ্যে অ্যামেরিকা এবং ইউরোপকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানের উপর জারি করা নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হবে।
ইরান পরমাণু চুক্তি কী ও কেন?
অ্যামেরিকা একতরফাভাবে ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি বাতিল করলেও বাকি স্বাক্ষরকারী দেশগুলি চুক্তি মেনে চলতে বদ্ধপরিকর৷ ‘জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন’ নামের এই চুক্তির প্রধান শর্তগুলি কী?
ছবি: picture-alliance/dpa/H. Neubauer
পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ?
২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী ইরান শুধু পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা চালাতে পারবে না৷ তবে আন্তর্জাতিক নজরদারির মধ্যে শান্তিপূর্ণ পরমাণু কর্মসূচি চালু রাখার অধিকার সে দেশের রয়েছে৷ অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চিকিৎসার মতো ক্ষেত্রে পরমাণু শক্তি কাজে লাগানো যেতে পারে৷
ছবি: Getty Images/IIPA
ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ
চুক্তির প্রথম আট বছরে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের সীমা মেনে চলতে রাজি হয়েছিল৷ সেইসঙ্গে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত গবেষণাও বন্ধ থাকবে৷ আন্তর্জাতিক পরমাণু জ্বালানি সংস্থা আইএইএ ইরানের কার্যকলাপের উপর নজর রেখে চলেছে৷ জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেন, চীন ও রাশিয়া এক্ষেত্রে আইএইএ-র মূল্যায়নকেই গুরুত্ব দিয়ে আসছে৷
ছবি: Kazem Ghane/AFP/Getty Images
পরমাণু ভাণ্ডারের ভবিষ্যৎ
চুক্তির আওতায় ইরান ৩,৬৭ শতাংশ সমৃদ্ধকৃত ইউরেনিয়ামের ভাণ্ডার ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত কমানোর অঙ্গীকার করেছিল৷ অর্থাৎ ১৫ বছরের জন্য ৩০০ কিলোগ্রামের বেশি এমন মানের ইউরেনিয়াম ইরানের হাতে থাকার কথা নয়৷ ফলে পরমাণু অস্ত্র তৈরির পথ আপাতত বন্ধ থাকছে৷
ছবি: BEHROUZ MEHRI/AFP/Getty Images
নিষেধাজ্ঞা শিথিল
ইরান শর্ত পূরণ করার পরিবর্তে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সে দেশের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল৷ ফলে ইরান আবার আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলিয়াম বিক্রি ও আন্তর্জাতিক অর্থ বাজারে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছিল৷ অ্যামেরিকার চাপের মুখে সেই সুবিধা হাতছাড়া করতে চায় না ইরান৷
ছবি: FARS
চুক্তিভঙ্গের পরিণতি
পরমাণু কর্মসূচির উপর আন্তর্জাতিক নজরদারির ফলে একটি পরমাণু বোমা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান তৈরি করতে ইরানের কমপক্ষে এক বছর লাগবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন৷ সে রকম প্রচেষ্টা চালালে আবার সে দেশের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা চাপানোর বিধান মেনে নিয়েছে ইরান৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Jenis
চুক্তির মেয়াদ শেষের অবস্থা
সমালোচকরা বার বার চুক্তির ‘সানসেট ক্লজ’ বা মেয়াদ শেষের অবস্থার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকেন৷ তাদের অভিযোগ, শান্তিপূর্ণ লক্ষ্যে পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা সত্ত্বেও ইরান চুক্তির মেয়াদ শেষে আবার অস্ত্র তৈরির কাজ শুরু করবে৷ তবে চুক্তির প্রবক্তারা মনে করিয়ে দেন, যে বিভিন্ন ধরনের কার্যকলাপের উপর ১০, ১৫, ২০ বা ২৫ বছর পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা বজায় থাকবে৷
ছবি: Fars
ক্ষেপণাস্ত্র ও আঞ্চলিক প্রভাব
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তাঁর সমর্থকরা ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির বাড়বাড়ন্ত ও মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে সে দেশের প্রভাব প্রতিপত্তির কড়া সমালোচনা করেন৷ ইউরোপসহ অন্যান্য অনেক দেশও বিষয়ে একমত৷ তবে ‘সফল’ পরমাণু চুক্তি বাতিল করার বদলে তা কাজে লাগিয়ে ইরানের উপর চাপ সৃষ্টি করতে চায় তারা৷
ছবি: Reuters/O. Sanadiki
7 ছবি1 | 7
প্রেসিডেন্ট অবশ্য এখনই এমন আইনের বিপক্ষে। পার্লামেন্টের স্পিকার নতুন আইন তাঁর কাছে পেশ করার পর তিনি জানিয়েছেন, এখনই এমন আইন বলবৎ করলে আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়া আরো বিরূপ হতে পারে। ইরানের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক আরো জটিল হতে পারে। ফলে সে বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করা দরকার। যদিও কিছু দিন আগেই পরমাণু বিজ্ঞানীর হত্যা নিয়ে কড়া মন্তব্য করেছিলেন তিনি। জানিয়েছিলেন, দ্রুত এর জবাব দেওয়া হবে।
ইরানের পরমাণু পরীক্ষা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্ক চলছে। ২০১৮ সালে অ্যামেরিকা নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয় এবং ইরানের উপর একাধিক নিষেধাজ্ঞা চাপায়। ডনাল্ড ট্রাম্পের অভিযোগ ছিল, চুক্তিতে থেকেও ইরান পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা চালাচ্ছে গোপনে। ইরান কখনোই তা মানতে চায়নি। কয়েক সপ্তাহ আগে মার্কিন সেনার সঙ্গে ইরানের পরমাণু পরীক্ষাগারে আক্রমণ চালানোর বৈঠকও করেছিলেন ট্রাম্প। শেষ পর্যন্ত যা বাস্তবায়িত হয়নি। সম্প্রতি জাতিসংঘও জানিয়েছিল, একটি নতুন পরমাণু কেন্দ্র তৈরির কাজ শুরু করেছে ইরান। সেখানে নির্দিষ্ট পরিমাণ ইউরেনিয়ামের চেয়ে বেশি মজুত করা হতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল। ইরান অবশ্য সেই সব অভিযোগই অস্বীকার করেছিল। তারপরেই পরমাণু বিজ্ঞানীর উপর আক্রমণের ঘটনা ঘটে।