ঔপনিবেশিক ইউরোপে একসময় ‘মানব চিড়িয়াখানা' বেশ পরিচিত ছিল৷ বর্ণবাদী নৃতাত্ত্বিক এই প্রদর্শনী হামবুর্গ, লিসবন বা ব্রাসেলসের মতো শহরে মাঝেমাঝেই হতো৷ সেই সময় আর নেই৷
বিজ্ঞাপন
পঞ্চদশ শতাব্দি থেকেই এই চর্চার কথা শোনা যায়৷ তখন উপনিবেশ থেকে মানুষকে অপহরণ করে ইউরোপে নিয়ে আসা হতো এবং বিভিন্ন প্রদর্শনীতে তাদের দেখানো হতো৷ ইউরোপের বিভিন্ন শহরে অমানবিক এই বর্ণবাদী চর্চা গত শতকের শুরুর দিকেও দেখা গেছে৷
দুদিন আগেই কথা হচ্ছিল একজন সহকর্মীর সঙ্গে৷ তিনি গ্রীষ্মের ছুটিতে বার্লিন গিয়েছিলেন বেড়াতে৷ ফেরার দিন ট্রেনের এক কামড়ায় তিনিসহ আরো তিন ডজন মানুষ উঠেছিল৷ কিন্তু ট্রেনের টিকিট শুধু সেই সহকর্মীরটাই পরীক্ষা করেছেন চেকার!
এই ঘটনা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আমার সহকর্মী৷ তার কাছে এটা মনে হয়েছে অস্বাভাবিক আচরণ৷ এরকম আচরণ যে শুধু তার সঙ্গে হয়েছে বিষয়টি এমন নয়৷ এশীয় বংশোদ্ভূত এক নারী জানিয়েছেন, জার্মানিতে বাসা ভাড়া নেয়ার পর শুরুর দিকে কেউ কেউ তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন তিনি সেখানে ঘরদোর পরিষ্কারের কাজ করতে গিয়েছেন কিনা!
এগুলোকে হয়ত ছোট ছোট বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়া যায়৷ ব্যক্তিগতভাবে আমি জার্মানি বা ইউরোপে গত দেড় দশকে কোনোরকম বর্ণবাদী আচরণের মুখোমুখি হইনি৷ তবে পরিসংখ্যান বলছে, বর্ণবাদী সহিংস ঘটনাও ঘটছে জার্মানিতে৷ ২০২২ সালে জার্মানিতে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত' সহিংস ঘটনা ঘটেছিল এক হাজার ৪২টি৷ তার মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ ঘটনার ধরন ছিল বর্ণবাদী৷
জার্মানিতে মুসলমানদের বসবাসের বিষয়টি নিয়ে বিরুপ প্রতিক্রিয়ার কথা শোনা যায় মাঝেমাঝে৷ এক জরিপে অংশ নেয়াদের এক-তৃতীয়াংশ মত দিয়েছেন যে ইউরোপের দেশটিতে মুসলমানদের অভিবাসন সীমিত করা উচিত৷ সেই জরিপে অংশ নেয়াদের ২৭ শতাংশ আবার এই মতও দিয়েছেন যে জার্মানিতে অনেক বেশি মুসলমান বসবাস করছেন৷
এতটুকু পড়ে এমন ভাবার কারণ নেই জার্মানি বিদেশি বা মুসলমানদের জন্য বোধহয় নিরাপদ নয়৷ আমি বলবো উল্টো, বর্তমান জার্মানি অতীতের অনেক ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে, অনেক অপরাধের দায় স্বীকার করে সামনে আগানোর কৌশল বেছে নিয়েছে৷ ফলে ২০১৫ সালে সিরিয়ার ১০ লাখের বেশি শরণার্থীর জন্য দুয়ার খুলে দিয়ে নজির সৃষ্টি করেছিল ইউরোপের এই দেশটি৷ আরো বেশি বেশি বিদেশিকে জার্মানি আসতে উৎসাহিত করতে সম্প্রতি অভিবাসন আইনও সংস্কার করেছে দেশটি৷
তাছাড়া বর্ণবাদ প্রতিরোধে জার্মানিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে নানা উদ্যোগ সচল রয়েছে৷ সরকারি নীতির পাশাপাশি সমাজ থেকে বর্ণবাদ হটাতেও প্রচারণা চালানো হয়৷ এধরনের যেকোনো ঘটনা দ্রুত সামনে আনা হয় যাতে তা প্রতিরোধ করা যায়৷
ইউরোপের অন্যান্য দেশেও এধরনের উদ্যোগ রয়েছে৷ কিন্তু তারপরও সমাজ থেকে বর্ণবাদ পুরোপুরি সরতে এখনো অনেক সময় লাগবে মনে হচ্ছে৷ বিশেষ করে ছোটখাট বা বিচ্ছিন্ন যেসব ঘটনা এখনো ঘটছে সেগুলোও বন্ধ করতে হবে৷ পাশাপাশি বর্ণবাদের বিষবাষ্প নতুন করে যাতে বাড়তে না থাকে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে৷
ইউরোপে বাড়ছে বর্ণবাদ এবং বিদেশি-বিদ্বেষ
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গত কয়েক বছরে বর্ণবাদী ও বিদেশিদের প্রতি বিদ্বেষমূলক আচরণের সংখ্যা বাড়ছে৷ ইউরোপের কিছু দেশের এমন ঘটনার তুলনমুলক সংখ্যা থাকল ছবিঘরে৷
ছবি: Getty Images/A. Rentz
বর্ণবাদ ও বিদেশি-বিদ্বেষ
কোনো ব্যক্তির জাতি, বর্ণ, গায়ের রং, ভাষা, জাতীয়তা ইত্যাদির কারণে আক্রমণের শিকার হওয়াকে বর্ণবাদ এবং বিদেশিদের প্রতি বিদ্বেষ বলে চিহ্নিত করেছে অর্গানাইজেশন ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড কোঅপারেশন ইন ইউরোপ- ওএসসিই৷
ছবি: DW
ওএসসিই
ওএসসিই বা অর্গানাইজেশন ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড কোঅপারেশন ইন ইউরোপ হলো ইউরোপের একটি বেসরকারি সংস্থা৷ সংস্থাটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ঘটা বিদ্ধেষমুলক আচরণ বা হেইট ক্রাইমের তথ্য প্রকাশ করে থাকে৷ বর্তমানে মোট ৫৭টি দেশ সংস্থাটির সদস্য৷ সদস্য রাষ্ট্রসমূহে সব ধরনের হেইট ক্রাইম লিপিবদ্ধ করে সংস্থাটি৷
ছবি: DW / Aida Cama
অস্ট্রিয়া
ইউরোপের এই দেশটিতে বর্ণবাদ ও বিদেশিদের প্রতি বিদ্বেষমূলক ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে ৷ ২০১৭ সালে এধরনের মোট ২২৭টি ঘটনা চিহ্নিত করা হয়৷ পাঁচ বছর পর ২০২১ সালে এমন ঘটনার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় দুই হাজার ৪২০টি৷
ছবি: benkrut/YAY Images/IMAGO
বেলজিয়াম
ইউরোপের আরেক দেশ বেলজিয়ামেও পরিস্থিতি একই রকম৷ দেশটিতে ২০১৭ সালে মোট ছয়শটি এমন বিদ্বেষমূলক ঘটনা চিহ্নিত করা হয়৷ আর ২০২১ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৫৫তে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/W. Rothermel
ফ্রান্স
দেশটিতে ২০১৭ সালে ৮৮২টি বর্ণবাদী ও বিদেশিদের প্রতি বিদ্বেষমূলক ঘটনা ঘটেছে বলে জানায় ওএসসিই৷ আর ২০২১ সালে এই সংখ্যা দুই হাজার ৫৬৷
ছবি: Christophe Archambault/AFP
জার্মানি
ইউরোপের আরেক বড় দেশ জার্মানিতে ২০১৭ সালে এমন মোট ঘটনা ঘটেছে এক হাজার ৮৬০টি৷ ২০২১ সালে এমন ঘটনার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় নয় হাজার ২৩৬৷ প্রতিষ্ঠানটি বলছে, তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতির পরিবর্তনের কারণে এই সংখ্যা বেড়ে থাকতে পারে বলা ধারণা করা হচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/E. Contini
ইটালি
ইউরোপের সাগরতীরের এই দেশটিতে ২০১৭ সালে মোট ৮২৮টি ঘটনা চিহ্নিত করা হয়৷ আর ২০১৭ সালে এই ঘটনা দাঁড়ায় এক হাজার ১৬০৷
ছবি: Reuters/A. Bianchi
নেদারল্যান্ডস
নেদারল্যান্ডসে ২০১৭ সালে বর্ণবাদী ও বিদেশিদের প্রতি বিদ্বেষের মোট ৩২৭টি লিপিবদ্ধ করে ওএসসিই৷ চার বছর পর ২০২১ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৫০৷
ছবি: Getty Images/M. Thompson
গ্রিস
ইউরোপের আরেক দেশ গ্রিসে ২০১৭ সালে মোট ১২৮টি বর্ণবাদ ও বিদেশিদের প্রতি বিদ্বেষমূলক ঘটনার কথা জানায় ওএসসিই৷ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশটিতে গত চার বছরে এমন বিদ্বেষমূলক আচরণ কমেছে৷ ২০২১ সালে দেশটিতে বর্ণবাদী ও বিদেশিদের প্রতি বিদ্বেষমূলক ৬৭টি ঘটনা রেকর্ড করেছে প্রতিষ্ঠানটি৷
ছবি: picture-alliance/ZUMAPRESS/N. J. Kokovlis
স্পেন
২০১৭ সালে এই দেশটিতে মোট ৫২৪টি বর্ণবাদ ও বিদেশিদের প্রতি বিদ্বেষমূলক ঘটনা লিপিবদ্ধ করা হয়৷ ২০২১ সালে ঘটনার সংখ্যা দাঁড়ায় ৬২৯টিতে৷