অর্থনৈতিক সংকটের একটা দিক যদি বেকারত্ব হয়ে থাকে, তবে তার আরেকটা দিক হলো আধা-বেকারত্ব, অর্থাৎ যোগ্যতার তুলনায় নীচু ধরনের কাজ, পার্ট-টাইম কাজ, স্বল্প বেতনের কাজ৷ প্রধানত উচ্চশিক্ষিতরাই এই নতুন বেকারত্বের শিকার৷
বিজ্ঞাপন
সুইডেনের লিনকোপিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইকো-ট্যুরিজম ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের স্নাতক হয়ে মাসের পর মাস বেকার থাকা, অ্যাপ্লিকেশনের পর অ্যাপ্লিকেশন পাঠিয়ে মাত্র দু'টি ইন্টারভিউ'-এর ডাক পাওয়া, এই সব অভিজ্ঞতা হালের ইউরোপে সাধারণ অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷
অবশ্য জার্মানি সহ ইউরোপের অধিকাংশ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পাঠ্য বিষয় ও বিভাগের ফিরিস্তি দেখলে মনে হতে পারে, এরা বোধহয় এখনও একটা স্বপ্নলোকে বাস করে৷ নানা ধরনের বিষয়, যেগুলি পঠনপাঠনের যতই যৌক্তিকতা থাক না কেন, টানাপোড়েনের সময় সে সব ফিল্ডে চাকরি পাওয়া প্রায় অসম্ভব৷
জার্মান ভাষা জানার বিকল্প নেই
জার্মান ভাষা আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃত৷ ভারত-বাংলাদেশের মতো বিশ্বের আরো অনেক দেশে এ ভাষা শেখার জন্য রয়েছে গ্যোটে ইন্সটিটিউট৷ তবে জার্মানিতে থেকে সে’ দেশের ভাষা না জানলে যে পদে পদে সমস্যা!
ছবি: POOSHdesign/Reza Alaeddini
যদি ভাষা জানেন, সুবিধা পাবেন
যে কোনো দেশে থাকতে হলে সে দেশের ভাষা জানা খুবই জরুরি৷ তা না হলে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার তেমন কোনো সুযোগই থাকেনা৷ ভাষা না শেখার কারণে খালিদ, আইচো, শিরিয়া, আরিয়ানা বা রাইসার মতো অনেকেই নিজের দেশে চেয়ার টেবিলে বসে কাজ করলেও জার্মানিতে শ্রমিকের কাজ করতে হচ্ছে৷
ছবি: Doc RaBe - Fotolia.com
সেবিকা থেকে ক্লিনার
শিরিয়া কসোভো থেকে বেশ কয়েকবছর আগে স্বামী, সন্তান নিয়ে জার্মানিতে এসেছে৷ নিজের দেশে একটি হাসপাতালে নার্স বা সেবিকা হিসেবে কাজ করতো৷ প্রথমে ভাষা শেখাটাকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি বলে আর শেখাও হয়নি৷ বেঁচে থাকার জন্য এখন তাকে অন্যের বাড়িতে ক্লিনারের কাজ করতে হচ্ছে৷ জার্মান ভাষা জানা থাকলে সহজেই নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে হয়তো আবারও সেবিকার কাজ পেতে পারতো৷
ছবি: picture-alliance/dpa
খালিদের অনেক দুঃখ
খালিদ পোল্যান্ডের একটি কন্সট্রাকশন ফার্মে সুপারভাইজারের দায়িত্ব পালন করতো৷ ভাষা শেখেনি, তাই এখন নিজেকেই এ সব কাজে হাত লাগাতে হচ্ছে৷ ভাষা না শেখার কারণ জানতে চাইলে কিছুই বলেনা৷ তবে এখন বুঝতে পারছে সে ভাষা না শিখে ভুল করেছে এবং মানসিকভাবে অনেক কষ্টও পাচ্ছে৷ যদিও জার্মানিতে কম আয়ের বিদেশিদের জন্য বিনে পয়সায় ভাষা শিক্ষার কোর্স রয়েছে৷
ছবি: Kzenon - Fotolia.com
আরিয়ানা
কিন্ডারগার্টেন শিক্ষিকা আরিয়ানা প্রায় দশ বছর আগে ইউক্রেন থেকে এসেছে৷ নিজের দেশে টুকটাক জার্মান ভাষা শিখেছিলো, তবে জার্মানিতে এসে আর শেখা হয়নি কোলে বাচ্চা থাকায়৷ তবে ওর স্বামীর জার্মান ভাষা মোটামুটি শেখাতে একটি চাকরি এবং জার্মানিতে থাকার অনুমতি পেয়েছে৷ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে আরিয়ানাকেও কাজ করতে হয়৷ স্বামীর সহায়তায় অগত্যা একটি সরকারি অফিসে মেঝে মোছার কাজই করছে সে এখন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বসনিয়ার মেয়ে মারিয়ম
১৫ বছর বয়সে বাবা মায়ের হাত ধরে জার্মানিতে এসেছে মারিয়ম৷ প্রথমদিকে কিছুটা অসুবিধা হলেও বাবা মায়ের উৎসাহে এবং নিজের মনোবলের কারণে ভালোভাবেই জার্মান ভাষা রপ্ত করতে পেরেছে৷ এখন সে নিজেই চাকরির জন্য অফিসে দরখাস্ত করছে৷ ওর চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে৷
ছবি: Bilderbox
জব সেন্টারে ঘোরাঘুরি
অনেকে প্রতি সপ্তাহেই চাকরির খোঁজে জব সেন্টারে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে৷ ভাষা না জানার কারণে ওদের জন্য তেমন কোনো চাকরির সুখবরও থাকেনা৷ তবে এরা সরকার থেকে বেকার ভাতা বা সামাজিক ভাতা পায় নিয়মিত৷
ছবি: dpa
ভাষা শিখে স্বপ্ন পূরণ
লায়লা ছোটবেলা থেকেই বাচ্চা ভালোবাসে তার ইচ্ছে বাচ্চাদের সাথে কাজ করবে৷ লায়লার জন্য ভাষা শেখা কোনো সমস্যাই ছিলোনা৷ সাধারণ স্কুলের পাশাপাশি আলাদাভাবে জার্মান ভাষা শেখার ক্লাস সে করেছে৷ যার ব্যয়ভার জার্মান সরকার বহন করেছে৷ কিন্ডারগার্টেনের ট্রেনিং শেষে পছন্দের চাকরিও সে পেয়ে গেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বখাটে তরুণ
যারা জার্মান ভাষা শেখেনা, তারা নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়৷ কোনো প্রয়োজনীয় চিঠিপত্র এলেও সেগুলো তারা পড়তে বা বুঝতে পারেনা৷ ফলে সবসময়ই অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়৷ ভাষা না জানা এই প্রজন্মের অনেক ছেলে মেয়েকে পয়সার জন্য অন্যায় পথে পা বাড়াতেও দেখা যায়৷ কেউ কেউ আবার অন্য বাড়ির দরজায় গিয়ে সাহায্য প্রার্থনা করে৷
ছবি: fotolia/imageteam
জন্ম থেকে জার্মানিতে, জার্মান ভাষার প্রতি আগ্রহ নেই
জার্মানিতে প্রায় ৪০ লাখ তুর্কি রয়েছে৷ যাদের জন্ম জার্মানিতে, জার্মান স্কুলে পড়ে – তারপরও অনেকেই তেমন ভালো জার্মান ভাষা জানেনা৷ কারণ হিসেবে অনেক সময় বলা হয় জার্মান স্কুলের বাইরে অর্থাৎ নিজেদের মধ্য এরা সবসময়ই তুর্কি ভাষায় কথা বলে৷
ছবি: picture-alliance/ZB
নারীদের ভাষা শেখার আগ্রহ খুব কম
নিজ দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অনেকেই জার্মানিতে পাড়ি জমিয়েছেন৷ তাদের মধ্যে পুরুষরা কিছুটা জার্মান ভাষা শিখে বিভিন্ন দোকান, কারখানা, রেস্তোরাঁতে কাজ করছেন৷ এদেশে স্কুলে যাওয়া বাধ্যতামূলক বলে বাচ্চারাও স্কুলে যায়৷ তবে এসব পরিবারের খুব কম নারী জার্মান ভাষা শেখে৷ অনেক বছর থাকার পরও কথা বলতে পারেন না৷ যদিও এদেশে তুর্কি নারী সংখ্যা বেশি থাকায় তাদের জন্য আলাদাভাবে ভাষা শেখার ব্যবস্থা রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তিন বোন
পোল্যান্ড থেকে আসা এক পরিবারের তিনজন৷ ছোটবোন ভালো জার্মান ভাষা শিখেছে বলে মোটামুটি ভালো বেতনে দোকানে সেলস গার্লের চাকরি করছে৷ দ্বিতীয়জনের জার্মান ভাষার জ্ঞান আরো কম বলে সে একটি ফ্যাক্টরিতে জিনিসপত্র গোছানোর কাজ করে, যেখানে তাকে বেশি কথা বলতে হয়না৷ এবং স্বাভাবিকভাবেই বেতন বেশ কম৷ আর সবচেয়ে বড় বোন একদমই ভাষা জানেনা৷ তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কোন বাড়িতে ক্লিনারের কাজও কেউ দিতে চায়না৷
ছবি: POOSHdesign/Reza Alaeddini
11 ছবি1 | 11
অথচ শুধু ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেই নয়, ইউরোপীয় সংস্কৃতির বুনিয়াদই হলো – অন্তত অংশত – এই ধরনের পঠনপাঠন, যার আপাতদৃষ্টিতে তাৎক্ষণিক ব্যবহারিক উপযোগিতা কম৷ ইউরোপীয় সভ্যতা বা সংস্কৃতি বলতে যা কিছু বোঝায়, তার একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ শুধুমাত্র ব্যবহারিক উপযোগিতার নামে জলাঞ্জলি দেওয়া চলে কিনা, তা নিয়েও আবার দ্বিমত থাকতে পারে৷
বেশি যোগ্যতা থাকা কি অপরাধ?
কিন্তু সুইডেনের মতো মাত্র ৮০ লাখ মানুষের দেশ, যারা যেমন সমৃদ্ধি, তেমনই সামাজিক সুযোগসুবিধার শিখরে, সেখানেও যখন তরুণ সুইডরা কোনো ভালো চাকরি-বাকরি পাবার সম্ভাবনা না দেখে দাঙ্গা করে – তাহলে বাকি ইউরোপের যে কি দশা, তা সহজেই উপলব্ধি করা যায়৷ ইউরোপের বহু দেশে উচ্চশিক্ষিতদের একটি গোটা প্রজন্মের উপর এই অভিজ্ঞতা মানসিক ক্ষত রেখে যেতে পারে বলে মনস্তত্ববিদদের আশঙ্কা৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকরা হ্যামবার্গার ভাজছে কিংবা কফিশপে কফি সার্ভ করছে, ইউরোপের এ দৃশ্য আজ বিরল নয়৷
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওয়ার্কফোর্স বা মোট কর্মজীবীর সংখ্যা যদি ২৪ কোটি ধরা হয়, তবে তাদের মধ্যে সাড়ে ছয় কোটি বস্তুত ওভারকোয়ালিফায়েড, বা যে চাকরি তারা করছে, তার তুলনায় তারা অনেক বেশি যোগ্যতা সম্পন্ন – এই হলো ওইসিডি-র পরিসংখ্যান৷ এছাড়া যারা অনিচ্ছাসত্ত্বেও পার্ট-টাইম চাকরি করতে বাধ্য হচ্ছে তাদের সংখ্যা প্রায় ৯০ লাখ৷ আর ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রশ্ন বাদ দিলে ইউরোপের মোট কর্মজীবীদের এক-পঞ্চমাংশই পার্ট-টাইম কাজ করে থাকেন৷
হারানো প্রজন্ম
লস্ট জেনারেশন, একটা গোটা হারানো প্রজন্মের কথা আজকাল বার বার শোনা যাচ্ছে৷ ইউরোপীয় সংসদের সভাপতি মার্টিন শুলৎস বলেছেন: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যাবৎ নাকি ইউরোপে এ রকম একটা উচ্চশিক্ষিত প্রজন্ম দেখা যায়নি৷ তাদের বাবা-মায়েরা তাদের শিক্ষায় টাকা ঢেলেছেন৷ অথচ তারা যখন কাজ করতে প্রস্তুত, তখন সমাজ তাদের বলছে, ‘তোমাদের জন্য কোনো জায়গা নেই৷' ‘‘আমরা একটা হারানো প্রজন্ম সৃষ্টি করছি,'' বলেছেন শুলৎস৷
বলা বাহুল্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকরা ছড়াছড়ি যাচ্ছে বলেই কোম্পানিগুলি চাকুরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে জব এক্সপেরিয়েন্স বা কাজের অভিজ্ঞতা দাবি করতে শুরু করেছে৷ যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুঁথিগত বিদ্যা আর কর্মক্ষেত্রের মধ্যে ব্যবধানটা আরো বেড়েছে বৈ কমেনি৷