ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ ব্রেক্সিটের প্রশ্নে অত্যন্ত কড়া অবস্থান নিয়ে আসছেন৷ এমনকি ৩১শে অক্টোবর পর্যন্ত বিচ্ছেদের সময়সীমা বাড়ানোরও ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি৷ চূড়ান্ত পর্যায়েও ব্রিটেনকে কোনো ছাড় দিতে চান না তিনি৷ তা সত্ত্বেও বৃহস্পতিবার প্যারিসে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সঙ্গে আলোচনার পর মাক্রোঁ জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের প্রস্তাব মেনে চুক্তিহীন ব্রেক্সিট এড়াতে ব্রিটেনের সঙ্গে আরও এক মাস আলোচনা চালিয়ে যেতে রাজি হলেন৷ তবে মাক্রোঁ একইসঙ্গে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, যে ব্রিটেন কোনো বড় ছাড় পাবে না৷ বিচ্ছেদ চুক্তি নিয়ে নতুন করে আলোচনার জন্য আর সময় নেই৷
মাক্রোঁর সঙ্গে আলোচনার পর জনসন বলেন, আইরিশ সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ এড়াতে সমাধানসূত্র প্রস্তুত রয়েছে৷ তবে তিনি এমন দাবি করে এলেও এখন পর্যন্ত সেই সূত্র বিষয়ে তেমন কিছু জানান নি৷ বিচ্ছেদ চুক্তির মাধ্যমেই ব্রিটেনকে ইইউ থেকে বার করতে তিনি বদ্ধপরিকর, বলেন জনসন৷ তাঁর মতে, বার্লিনে জার্মান চ্যান্সেলরের সঙ্গে আলোচনার পর তিনি এই কাজে প্রবল উৎসাহ পাচ্ছেন৷ মাক্রোঁ তাকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, যে কোনো সমাধানসূত্রের ক্ষেত্রে ইইউ-র একক বাজার ও আইরিশ দ্বীপের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে৷
এদিকে বৃহস্পতিবার ম্যার্কেলও আবার জানিয়ে দিয়েছেন, যে ৩১শে অক্টোবর ব্রেক্সিট কার্যকর করার আগে নির্ধারিত এক মাসের মধ্যে ব্রিটেনকে আইরিশ সীমান্তে ব্যাকস্টপ ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্য বিকল্প পেশ করতে হবে৷
অনেক পর্যবেক্ষকের মতে, ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল' নীতিতে ব্যর্থ হয়ে জনসন লন্ডনে ফিরে ব্যর্থতার দায় ইউরোপীয় নেতাদের উপর চাপাতে পারবেন না৷ ইউরেশিয়া গ্রুপ কনসালটেন্সি নামের প্রতিষ্ঠানের প্রধান মুজতবা রহমান তাঁর টুইট বার্তায় লেখেন, ‘‘তারা বরিসকে বলছেন, তুমি বার বার বলছো, বিকল্প রয়েছে৷ তোমরা ব্রিটিশরা যা দুই বছরে পারো নি, তা পেশ করতে এখন ৩০ দিন সময় পাবে৷''
বৃহস্পতিবার প্যারিসের এলিসে প্রাসাদে মাক্রোঁর সঙ্গে আলোচনার সময় জনসন এক মুহূর্তের জন্য টেবিলের উপর পা তুলে বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন৷ তবে নিজের ভুল বুঝে তিনি সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা চেয়ে নেন৷ ফরাসি ভাষায় দক্ষ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মাক্রোঁকে তাঁর ভাষাতেই বার বার সম্বোধন করে কিছুটা উষ্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন৷
এলেমেলো চুল, ব্যতিক্রমী চাহনি আর ঝাজালো বক্তব্যের জন্য খ্যাতিমান নয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে আসা জনসনের বেড়ে ওঠার গল্পও বিচিত্র রকম৷
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন৷
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/D. Kitwoodকিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।
ছবি: Getty Images/L. Drayব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardyটেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PA Wire/J. Stillwellটেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Imago Images/PA/I. Infantesযুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের৷
ছবি: Reuters/P. Nichollsজনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের (ছবিতে বামে) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/D.L. Olivasপ্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।
ছবি: Getty Images/AFP/T. Akmenবাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/empics/B. Kendall এসবি/কেএম (এএফপি, রয়টার্স, ডিপিএ)