ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর থেকে বরিস জনসন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বিচ্ছেদ চুক্তির বিরুদ্ধে সরব ছিলেন৷ মূলত আয়ারল্যান্ড সীমান্তে তথাকথিত ‘ব্যাকস্টপ' ব্যবস্থা নিয়েই তাঁর মূল আপত্তি৷ এতদিন তিনি সরাসরি ইইউ-র সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে দরকষাকষির পথে না গিয়ে চুক্তি ছাড়াই ব্রেক্সিটের হুমকি দিয়ে আসছিলেন৷ ফলে তিনি আদৌ কোনো বোঝাপড়া চান কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছিল৷ এবার জনসন সরাসরি তাঁর দাবি জানিয়ে ইইউ-র উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লিখলেন৷
ইইউ দেশগুলির সরকার প্রধানদের পরিষদের সভাপতি ডোনাল্ড টুস্ক-কে লেখা চিঠিতে বরিস জনসন ব্রেক্সিট চুক্তির মধ্যে ব্যাকস্টপ নিয়ে তাঁর সমস্যার উল্লেখ করেছেন৷ জনসন জানিয়েছেন, তাঁর পূর্বসূরী টেরেসা মে এই চুক্তি পুরোপুরি মেনে নিলেও তিনি ব্যাকস্টপ সংক্রান্ত বোঝাপড়া বাতিল করতে চান৷ এর বিকল্প হিসেবে তিনি পালটা প্রস্তাবও রেখেছেন৷ বিচ্ছেদ চুক্তির মধ্যে বিষয়টি বাতিল করে ইইউ-র সঙ্গে ব্রিটেনের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক স্থির করতে নতুন চুক্তির আওতায় আয়ারল্যান্ড সীমান্ত নিয়ে চূড়ান্ত বোঝাপড়ার ডাক দিয়েছেন তিনি৷
নিজের এই কড়া অবস্থান তুলে ধরতে বরিস জনসন বুধবার বার্লিনে জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল-এর সঙ্গে বৈঠক করবেন৷ তারপর বৃহস্পতিবার প্যারিসে তিনি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ-র সঙ্গে মিলিত হবেন৷ আগামী ৩১শে অক্টোবর ব্রেক্সিটের নির্ধারিত সময়সীমার আগে আলোচনার মাধ্যমে নতুন বিচ্ছেদ চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য ইইউ নেতাদের উপর চাপ সৃষ্টি করতে চান তিনি৷ জনসন বলেছেন, চুক্তির মাধ্যমে ইইউ ত্যাগ করতে তিনি অঙ্গীকারবদ্ধ৷ তাঁর সরকার সেই লক্ষ্যে যাবতীয় উদ্যোগ নিচ্ছে বলে তিনি দাবি করেছেন৷
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর এই কূটনৈতিক উদ্যোগ সম্পর্কে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় নি৷ তবে ইইউ এতকাল সাফ জানিয়ে এসেছে, যে ব্রিটেনের সঙ্গে বিচ্ছেদ চুক্তির ক্ষেত্রে কোনো রদবদল সম্ভব নয়৷ তবে সে দেশের সঙ্গে ইইউ-র ভবিষ্যৎ সম্পর্কের রূপরেখা নিয়ে আলোচনার অবকাশ আছে৷ তার আগে দুই পক্ষকেই বিচ্ছেদ চুক্তি অনুমোদন করতে হবে৷ ফলে আয়ারল্যান্ড ও ব্রিটেনের উত্তর আয়ারল্যান্ড প্রদেশের স্থলসীমান্তে সংকট এড়াতে ও ইইউ-র অভ্যন্তরীণ বাজার অটুট রাখতে ‘ব্যাকস্টপ' ব্যবস্থা মেনে নেওয়া ছাড়া ব্রিটেনের কোনো উপায় নেই৷
জনসন-সহ কট্টর ব্রেক্সিটপন্থিরা এই ব্যবস্থার ঘোর বিরোধী৷ এই বোঝাপড়াকে তাঁরা ‘ফাঁদ' হিসেবে দেখছে৷ তাঁদের আশঙ্কা, এর ফলে ব্রিটেন অনির্দিষ্টকালের জন্য ইউরোপীয় শুল্ক ইউনিয়নের মধ্যে থেকে যেতে বাধ্য হবে৷ সে ক্ষেত্রে অন্য কোনো দেশের সঙ্গে ব্রিটেন বাণিজ্য চুক্তি করতে পারবে না৷ ইইউ অবশ্য এমন অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে৷ বিচ্ছেদ চুক্তি অনুমোদনের মাধ্যমে ব্রেক্সিট কার্যকর হবার পর দুই পক্ষের মধ্যে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক স্থির করতে যে চুক্তি স্থির হবে, তার মধ্যে আইরিশ সীমান্ত নিয়ে স্থায়ী মীমাংসা করতে চায় ইইউ৷ ব্রিটেন চুক্তি ছাড়া ইইউ ত্যাগ করলে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নিয়ে আদৌ আলোচনা সম্ভব কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে৷
এলেমেলো চুল, ব্যতিক্রমী চাহনি আর ঝাজালো বক্তব্যের জন্য খ্যাতিমান নয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে আসা জনসনের বেড়ে ওঠার গল্পও বিচিত্র রকম৷
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন৷
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/D. Kitwoodকিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।
ছবি: Getty Images/L. Drayব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardyটেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PA Wire/J. Stillwellটেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Imago Images/PA/I. Infantesযুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের৷
ছবি: Reuters/P. Nichollsজনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের (ছবিতে বামে) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/D.L. Olivasপ্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।
ছবি: Getty Images/AFP/T. Akmenবাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/empics/B. Kendall এসবি/কেএম (ডিপিএ, এএফপি)