ইউরোপে ইহুদি ও মুসলিমদের ওপর চাপ বাড়ছে৷ এর কারণ কয়েকটি আইন যা এখন লুক্সেমবুর্গে ইউরোপিয়ান কোর্ট অফ জাস্টিস (ইসিজে) খুঁটিয়ে দেখছে৷ ডয়চে ভেলের ক্রিস্টোফ স্ট্র্যাকের মতে, ইউরোপে ধর্ম পালনের স্বাধীনতা ঝুঁকিতে রয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
ইউরোপীয় ন্যায়বিচার আদালত ইসিজে আগামী বুধবার লুক্সেমবুর্গে একটি মৌলিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে৷ তা হল, ইউরোপীয় পরিচয়- ধর্মের স্বাধীনতা৷ এদিকে, জার্মানিতে ইহুদি ও মুসলিমরা তাদের অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে, এমনকি ইউরোপে তাদের দীর্ঘমেয়াদী অবস্থানও ঝুঁকির মুখে৷
এই যেমন কেস সি ৩৩৬/১৯-তে অচেতন না করে পশু কুরবানির ব্যাপারে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে৷ এভাবে পশু কুরবানি বেলজিয়ামে ২০১৯ সাল থেকে নিষিদ্ধ, প্রথমে ফ্ল্যান্ডার্স অঞ্চলে এবং পরে ওয়ালোনিয়াতেও৷ বেলজিয়ামে নিষিদ্ধের এই আইনি প্রক্রিয়া শেষ হবার পর সেখানকার সাংবিধানিক আদালত একে ইসিজেতে পাঠিয়েছে যেন তারা ইইউ চার্টারে যে মৌলিক অধিকার ও ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে, তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না যাচাই করে৷ লুক্সেমবুর্গে শুনানি চলছে৷এ ধরনের বিষয়ে সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে, ইউনরোপের ন্যায়বিচার আদালত ধর্মীয় স্বাধীনতাকে অধিক গুরুত্ব দেয় কি না৷
তাহলে কি ধর্ম স্বাগত নয়?
আগে কখনো ইউরোপের রাব্বীদের (ইহুদি ধর্মগুরু) সমাবেশ ও মুসলিম বিশ্ব লীগ এমন সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে একসঙ্গে কথা বলেনি৷ এই প্রথম একটি চিঠিতে একসঙ্গে রাব্বীদের প্রধান নেতা পিনচাস গোল্ডস্মিডট ও মুসলিম বিশ্ব লীগের মহাসচিব শেখ মোহাম্মেদ আল-ইসা মতামত দেন৷ দু'জনই মনে করেন, এক্ষেত্রে তাদের ধর্ম পালনের স্বাধীনতা ক্ষু্ণ্ণ হচ্ছে৷
‘‘যদি বেলিজিয়ামের নিষেধাজ্ঞা বজায় থাকে, তাহলে ইউরোপীয়ান কোর্ট অফ জাস্টিস ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের যে বার্তা দিচ্ছে তা পরিষ্কার: ‘আপনারা এখানে স্বাগত নন','' এমন কথা বলা হয়েছে চিঠিতে৷ আরো বলা হয়েছে, ‘‘যদি খাবার খাওয়াকেই অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে আমরা আশা করতে পারিনা যে, ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলো ইউরোপে থাকবে এবং সমাজে তাদের অবদান রাখবে৷''
অবশ্যই আপনারা এই মতামতকে এড়িয়ে যেতে পারেন এই বলে: মস্কো থেকে আসা একজন প্রথাগত রাব্বী ও ইসলামের একজন সৌদি প্রতিনিধির কথা আমরা কেন শুনব? কিন্তু এটা ভুললে চলবে না যে, পুরোনো শত্রুতার ভাবমূর্তি দূরে ঠেলে সম্পূর্ণ দুই মেরুর দু'জন সংলাপে মেতেছেন৷ মোটের ওপরে, আন্তর্জাতিক প্রাসঙ্গিকতা আছে, এমন একটি আন্দোলন তৈরি হয়েছে যা দুর্ভাগ্যবশত খুব কম রাজনৈতিক নেতাই ভাবছেন বা এমনকি লক্ষ্য করছেন৷ এটি এমন একটি বিষয় যা নিয়ে জাতীয় ও ইউরোপীয় পর্যায়ে খুব কম লোকই ভাবেন৷
দিন দিন গুরুত্ব হারাচ্ছে ধর্মীয় স্বাধীনতা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একত্রিত হবার যে ইউরোপীয় ধারণা, তাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ খ্রিস্টানরা ছিলেন মূল চালিকাশক্তি: কনরাড আডেনাওয়ার, আলচিডে দ্য গাসপেরি, রবার্ট শুমান৷ তাদের ইউরোপে অবশ্যই ধর্ম ও ধর্মের স্বাধীনতা একটি বিষয় ছিল৷ কিন্তু এখন? কয়েক সপ্তাহ আগে, জার্মানির উরসুলা ফন ড্যের লেইয়েন নেতৃত্বাধীন ইইউ কমিশন সারাবিশ্বের জন্য তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধির পদটি বাতিলের ঘোষণা দিল৷ আরেকটি উদাহরণ হল, ইস্তানবুলের আয়া সোফিয়া, যা বিশ্বজুড়ে অর্থডক্স খিস্ট্রানদের প্রতীক এবং কয়েক দশক ধরে একটি মিউজিয়ম, একে তুরস্কে এরদোয়ানের ইসলাম অধিগ্রহণ করতে চাইছে৷ ইইউর শীর্ষস্থান থেকে এসব বিষয়ে কোন কণ্ঠস্বর আছে? বার্লিন বা প্যারিস থেকে? না নেই! এর অর্থ এই বিষয়ে ইসিজে বিচারকদের আলাপ-আলোচনা একটি বড় ফ্রেমওয়ার্কের অংশ৷
গোল্ডস্মিডট ও আল-ইসা, একজন ইহুদি ও একজন মুসলিম, তাদের আপীলে পরিষ্কারভাবে ও সময়োপযোগীভাবে যে বিষয়টি তুলে ধরেছেন তা হল ধর্মীয় নিয়মে খাবার গ্রহণ (ধর্মীয় উপায়ে পশু কুরবানির ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে) আর সম্ভব হবে না৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেও এমন নিষেধাজ্ঞার রেফারেন্স তুলে বলা হয়, ‘এটি ইউরোপজুড়ে ইহুদিদের কোণঠাসা করে দেয়া হয়'৷ এরপর ঘটনা প্রবাহ কোনদিকে গিয়েছে তা আমরা জানি৷
‘ইউরোপের মূল নীতি লঙ্ঘন'
‘‘যদিও ধর্মীয় স্বাধীনতা ইউরোপীয় গণতন্ত্রে মৌলিক অধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যদি ব্যক্তি ও সম্প্রদায়গুলো তাদের ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন না করতে পারেন, তাহলে তা অর্থহীন,'' ধর্মীয় প্রতিনিধিরা সতর্ক করেন৷ আর কেউ যদি মুসলিমদের হালাল ও ইহুদিদের কোসার খাবার খেতে বারণ করেন, তাহলে তিনি ‘ইউরোপের মূল নীতি লঙ্ঘন করছেন'৷
লুক্সেমবুর্গ বিচারকদের আলোচনা এক বিষয় (এবং প্রায়োগিক আইন নিয়ে বিচারিক আদালতের রায় ও ব্যাখ্যাকে অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে)- আর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো অন্য বিষয়৷ তাই ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং এক্ষেত্রে কোথায় ছাড় দেয়া হবে তার এমন পরিষ্কার ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন যে ধর্মীয় কারণে চেতনানাশক না প্রয়োগ করে পশু কুরবানিকে অনুমোদন দেয়া যায়৷ কারণ জ্যেষ্ঠ ধর্মীয় প্রতিনিধিদের পরিষ্কার বার্তা দেয়ার এমন বিরল ঘটনা আসলে ক্লান্ত ও আত্মনির্ভরশীল ইউরোপের জন্য একটি সতর্কবার্তা৷
ক্রিস্টোফ স্ট্র্যাক/জেডএ
‘আধ্যাত্মিকতা’: কোন দেশের কী অবস্থান
যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা ওয়েফেয়ারার ট্র্যাভেল সবচেয়ে ‘আধ্যাত্মিক’ দেশগুলোর একটি তালিকা করেছে৷ ধর্মীয় বিশ্বাস, বৈচিত্র্য, স্বাধীনতা, জনকল্যাণ ও জীবনমান নিয়ে করা এই তালিকায় কোন দেশের কী অবস্থান তা জানতে দেখুন এই ছবিঘর...
ছবি: Imago/Westend61
ক্যানাডা
গ্লোবাল স্পিরিচুয়ালিটি ইনডেক্স-এ ধর্মীয় আচার মেনে চলা মানুষের সংখ্যার দিক দিয়ে খুব কম নম্বর (৭-এ ২) পেয়েছে ক্যানাডা৷ তবে ধর্মে বৈচিত্র্য ও জীবনযাপনের মানের বিচারে সর্বোচ্চ ৭ নম্বর এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা, সহনশীলতা, স্থাপনা ও জনকল্যাণে ৬ নম্বর করে নিয়ে ৪৯ এর মধ্যে ৪০ নম্বর পেয়ে তালিকায় প্রথম স্থানে এসেছে দেশটি৷
ছবি: Imago/StockTrek Images
ইটালি
খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান ভ্যাটিকানের অবস্থান ইটালির রাজধানী রোমে৷ দেশটির অন্যান্য শহরজুড়েও রয়েছে নানা ধর্মীয় স্থাপনা৷ বিভিন্ন ধর্ম-মতের মানুষের সংখ্যা (৭ এ ৭ নম্বর), ধর্মীয় স্বাধীনতা ও জীবনমানসহ (৬ নম্বর) অন্যান্য বিচারে পাওয়া নম্বরের সুবাদে তালিকায় দ্বিতীয় স্থান পেয়েছে ইউরোপের এই দেশটি৷
ছবি: Getty Images/A.Solaro
ভারত
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র ভারতই এই তালিকার সেরা পাঁচে স্থান পেয়েছে৷ প্রচলিত ধর্মমত ছাড়াও বিভিন্ন গুরুর ভক্তকুল রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশে৷ ধর্মমতের বৈচিত্র্য এবং উপাসনাস্থলের সংখ্যা বিচারে এগিয়ে ৩৪ নম্বর নিয়ে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আধ্যাত্মিক দেশগুলোর মধ্যে তিন নম্বরে এসেছে তারা৷
ছবি: picture alliance/dpa/Jagadeesh NV
জাপান
বৌদ্ধপ্রধান জাপানে অন্যান্য ধর্মমতের মানুষও রয়েছে৷ এশিয়ার অন্যতম সমৃদ্ধ দেশটিতে মানুষের জীবনমানও উন্নত৷ ধর্ম বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা (১ নম্বর) ও ধর্মীয় স্থাপনার (২) দিকে খুব খারাপ হলেও জীবনমানে সর্বোচ্চ ৭ নম্বর নিয়ে তাদের মোট নম্বরও হয়েছে ভারতের সমান ৩৪৷ তালিকায় চার নম্বরে রয়েছে দেশটি৷
ছবি: AP
যুক্তরাজ্য
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতন ঘটলেও বিশ্বের বহু ধর্ম-বর্ণের মানুষের সহাবস্থান রয়েছে যুক্তরাজ্যে৷ ধর্মীয় সহনশীলতার দিক থেকেও অনেক এগিয়ে দেশটি৷ সেখানে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে মুসলিম-হিন্দুসহ অন্যান্য ধর্মের মানুষও তাঁদের আচার-অনুষ্ঠান পালন করছে৷ ধর্ম-বিশ্বাসীর সংখ্যার দিক দিয়ে সর্বনিম্ন ১ পেলেও উন্নত জীবনের কল্যাণে তালিকায় পাঁচ নম্বরে রয়েছে যুক্তরাজ্য৷
ছবি: Imago
যুক্তরাষ্ট্র
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ক্রমশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠা যুক্তরাষ্ট্রেও বহু দেশের নানা ধর্মমতের মানুষের সম্মিলন ঘটেছে৷ শিল্প, অর্থনীতি, গবেষণা ও প্রযুক্তিসহ নানা দিক দিয়ে এগিয়ে থাকা দেশটিতে ব্যক্তি স্বাধীনতা উপভোগের সুযোগও রয়েছে প্রশংসনীয় মাত্রায়৷ ধর্ম বিশ্বাসীর সংখ্যার বিচারে পিছিয়ে থাকলেও ধর্মীয় বৈচিত্র্য ও কল্যাণের ওপর ভর করে তালিকায় ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে তারা৷
ছবি: picture-alliance/AP/R. Bowmer
জার্মানি
এই তালিকায় যৌথভাবে দশম অবস্থানে রয়েছে ইউরোপের দুই দেশ জার্মানি ও সুইজারল্যান্ড, তাদের নম্বর ৩১৷ সংখ্যাগুরু খ্রিস্টান ধর্মালম্বীদের পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মমতের মানুষও এখানে তাদের ধর্ম পালন করতে পারছে৷ দুই দেশেই ধর্মবিশ্বাসীর সংখ্যা কম হলেও জীবনমানের দিক দিয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে তারা৷ তালিকায় সপ্তম, অষ্টম ও নবম স্থানে রয়েছে যথাক্রমে মেক্সিকো, অস্ট্রেলিয়া ও ফিলিপাইন্স৷
ছবি: picture alliance/dpa/F. Gambarini
সৌদি আরব
মুসলমানদের সবচেয়ে পবিত্র ভূমি মক্কা ও মদিনায় প্রতি বছর হজ করতে যান লাখ লাখ মানুষ৷ তারপরেও সৌদি আরবের নম্বর ২৭ এবং তালিকায় অবস্থান হয়েছে ২৩তম৷ ধর্মীয় স্বাধীনতা ও জনকল্যাণের দিক দিয়ে সর্বনিম্ন ১ নম্বর পেয়েছে দেশটি৷
ছবি: Getty Images/AFP/K. Sahib
পাকিস্তান
দক্ষিণ এশিয়ার আরেক বড় দেশ পাকিস্তানের অবস্থান তালিকায় ৯১তম৷ মুসলিম প্রধান দেশটির মোট নম্বর হয়েছে ১৮৷ ধর্ম বিশ্বাসীদের দিক দিয়ে ৭ এর মধ্যে ৫ নম্বর পেয়েছে দেশটি, তবে ধর্মীয় স্বাধীনতার দিক দিয়ে জুটেছে সর্বনিম্ন ১ নম্বর৷ ধর্মীয় সহনশীলতায় মাত্র ২ পয়েন্ট পেয়েছে তারা৷ আর আধ্যাত্মিক স্থাপনা ও জনকল্যাণে সর্বনিম্ন ১ করে এবং জীবনমানের দিক দিয়ে ২ পেয়েছে তারা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/K. M. Chaudary
বাংলাদেশ
বিভিন্ন ধর্মমত ও ধর্মবিশ্বাসীর সংখ্যার দিক দিয়ে ভালো অবস্থানে থাকলেও (৬ নম্বর করে) ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহশীলতার দিক দিয়ে অবস্থা খুব একটা ভালো নয় (৭ এর মধ্যে ২)৷ আর জীবনমান, জনকল্যাণ ও ধর্মীয় স্থাপনার দিক দিয়ে সর্বনিম্ন ১ নম্বর করে নিয়ে ১৯ নম্বর পেয়েছে বাংলাদেশ৷ তাই তালিকায় অবস্থান ৮৩তম৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
সিরিয়া
তালিকায় সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে কয়েক বছর ধরে যুদ্ধকবলিত মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সিরিয়া৷ তাদের সবচেয়ে বেশি নম্বর এসেছে ধর্মবিশ্বাসীর দিক দিয়ে ৭-এ ৫৷ এছাড়া ধর্মীয় বৈচিত্র্যের দিক দিয়ে পেয়েছে ২৷ জীবনমানসহ বাকি দিকগুলোতে সর্বনিম্ন ১ করে নিয়ে তাদের মোট নম্বর হয়েছে ১২৷