বোয়িং-এয়ারবাস বিরোধ আপাতত মুলতুবি রেখে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি সদিচ্ছা দেখালো বাইডেন প্রশাসন৷ ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম সংক্রান্ত বিরোধ মেটাতেও বিশেষজ্ঞরা কাজ করবেন৷
বিজ্ঞাপন
প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের আমলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে সংঘাতের যে জট সৃষ্টি হয়েছিল, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন একে একে সেগুলি দূর করে সহযোগিতা আরও নিবিড় করার পথে এগোচ্ছেন৷ বৃহত্তর স্বার্থে অনেক ‘ক্ষুদ্র' বিষয়ে আপোশ করতে প্রস্তুত তাঁর প্রশাসন৷ এমনই সদিচ্ছার পরিচয় হিসেবে অ্যামেরিকার বোয়িং ও ইউরোপের এয়ারবাস কোম্পানিকে ঘিরে প্রায় দুই দশকের সংঘাত আপাতত পাঁচ বছরের জন্য মুলতুবি করে স্থায়ী সমাধানসূত্রের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছেন তিনি৷ প্রতিযোগিতার বাজারে সরকারি ভরতুকির অভিযোগে দুই পক্ষ এতকাল একে অপরের বিরুদ্ধে এমনকি আইনি পদক্ষেপ নিয়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক শীতল করে তুলেছিল৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৯ সালে মার্কিন প্রশাসনকে ইউরোপের উপর ৭৫০ কোটি ডলার অংকের শাস্তিমূলক শুল্ক চাপানোর অধিকার দিয়েছিল৷ এক বছর পর ইউরোপও অ্যামেরিকার উপর প্রায় ৪০০ কোটি ডলার অংকের পালটা পদক্ষেপ নেবার অনুমতি পায়৷
মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্র-ইইউ শীর্ষ বৈঠকে এমন সাফল্য সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত ইইউ নেতারা৷ ইইউ কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডেয়ার লাইয়েন বলেন, এমন বোঝাপড়ার ফলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নতুন অধ্যায় শুরু হতে চলেছে৷ বিরোধ মেটাতে আলোচনার মাধ্যমে স্থায়ী সমাধানসূত্র সম্পর্কে আশা প্রকাশ করেছে দুই পক্ষ৷ সেটা সম্ভব না হলে আবার শাস্তিমূলক পদক্ষেপের ইঙ্গিত দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন৷ বাইডেন প্রশাসনের গঠনমূলক মনোভাবের কারণে ইউরোপ থেকে চিজ, মাখন, ওয়াইন, বিমান শিল্পের যন্ত্রাংশ আমদানির উপর শাস্তিমূলক শুল্ক তুলে নেওয়া হবে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নও অ্যামেরিকা থেকে বিমান শিল্পের যন্ত্রাংশ, কৃশিজাত পণ্য ও শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্য পণ্যের আমদানির উপর শুল্ক তুলে নেবে৷
এমন মীমাংসার ফলে বোয়িং ও এয়ারবাস কোম্পানির প্রায় একচেটিয়া ব্যবসার সুবিধা হবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে৷ করোনা সংকটের জের ধরে যথেষ্ট অর্ডারের অভাবে দুই কোম্পানিই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে৷ তাছাড়া চীনও ভবিষ্যতে বিশাল সরকারি সহায়তা সম্বল করে বেসামরিক বিমান উৎপাদনের ক্ষেত্রে আরও সক্রিয় হয়ে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ সে ক্ষেত্রে বোয়িং ও এয়ারবাসের আধিপত্য খর্ব হতে বাধ্য৷
এমন সাফল্যের ফলে অন্যান্য বিরোধ মেটানোর ক্ষেত্রেও বাড়তি প্রত্যাশা দেখা যাচ্ছে৷ তবে ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামকে ঘিরে দুই পক্ষের মতমার্থক্য আরও বেশি হওয়ায় দ্রুত নিষ্পত্তির আশা আপাতত কম৷ প্রেসিডেন্ট বাইডেন এখনো প্রায় তিন বছর আগে ট্রাম্প আমলের চাপানো আমদানি শুল্ক বহাল রেখেছেন৷ একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করে দুই পক্ষ বিষয়টি খতিয়ে দেখার কাজ শুরু করছে৷ চলতি বছরের শেষের মধ্যেই সমাধানসূত্রের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছে৷
জো বাইডেনের জীবনের গল্প
২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনের জীবনের গল্প দেখুন এই ছবিঘরে৷
ছবি: Kevin Lamarque/Reuters
জন্ম ও পরিবার
১৯৪২ সালের ২০ নভেম্বর স্ক্র্যানটন পেনসিলভ্যানিয়াতে জন্মগ্রহণ করেন জোসেফ রবিনেট বাইডেন জুনিয়র বা আজকের ‘জো বাইডেন’৷ জীবনের প্রথমভাগ বাইডেন কাটান দাদা-দাদির সাথে৷ পরিবারে আর্থিক অনটন থাকলেও বাইডেন স্কুলজীবনে তুখোড় ফুটবল, বেসবল খেলোয়াড় ছিলেন, যা পরে বিশ্ববিদ্যালয়েও তাঁকে জনপ্রিয় করে তোলে৷ জানা যায়, ছোটবেলায় বাইডেন কথা বলতে গেলে তোতলাতেন, যা কবিতা আবৃত্তি করার মাধ্যমে পরে নিয়ন্ত্রণে আনেন তিনি৷
ছবি: Handout Joseph Biden/AFP
তারুণ্য
প্রথমে ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক হবার পর আইনে স্নাতকোত্তর স্তরের পড়াশোনা করতে বাইডেন পাড়ি দেন নিউ ইয়র্কের সাইরাক্যুজ বিশ্ববিদ্যালয়ে৷ সেখানেই তাঁর পরিচয় নেলিয়া হান্টারের সাথে৷ ১৯৬৬ সালে নেলিয়া ও বাইডেন বিয়ে করেন৷
ছবি: Keystone/dpa/picture-alliance
রাজনীতিতে পদার্পণ
১৯৭২ সালে মাত্র ২৯ বছর বয়েসে ডেলাওয়ারে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান সেনেটর কেলেব বগসের বিরুদ্ধে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে লড়েন বাইডেন৷ অর্থাভাব, রাজনীতির ময়দানে অনভিজ্ঞতা সত্ত্বেও পারিবারিক সহায়তা ও মাঠপর্যায়ে প্রচার চালিয়ে গবসকে পরাজিত করেন বাইডেন৷ সেখান থেকেই ডেমোক্র্যাট হিসাবে তাঁর উত্থানের সূত্রপাত৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Keystone
পারিবারিক বিপর্যয়
সেনেটর নির্বাচিত হবার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বাইডেনের জীবনে আসে বিপর্যয়৷ একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় তাঁর স্ত্রী নেলিয়া ও কন্যা নাওমির মৃত্যু হয়৷ মারাত্মকভাবে জখম হন তাঁর দুই পুত্রও৷ এই বিপর্যয়ের কারণে রাজনীতি ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন বাইডেন৷ কিন্তু দলের জোরাজুরিতে হাসপাতালেই সেনেটর পদে শপথগ্রহণ করেন বাইডেন৷ পরে ১৯৭৭ সালে জিল জেকবসকে বিয়ে করেন বাইডেন৷ তাঁদের একটি কন্যা রয়েছে, নাম অ্যাশলি৷
ছবি: Kevin Larkin/AFP/Getty Images
রাজনীতির চেয়ে পরিবারকে প্রাধান্য
বাইডেনের পারিবারিক জীবনে আবার বিপর্যয় আসে ২০১৫ সালে৷ ভাইস-প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন ব্রেন টিউমারজনিত জটিলতায় তিনি তাঁর পুত্র জোসেফকে হারান৷ পরের বছর ২০১৬ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসাবে লড়ার পরিকল্পনা থাকলেও পরিবারকে সময় দিতে নির্বাচন থেকে সরে আসেন বাইডেন৷
ছবি: Kevin Lamarque/REUTERS
তবুও উত্তরণ
এর আগে ১৯৮৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রাথমিকভাবে অংশগ্রহণ করলেও প্রাইমারি নির্বাচনের আগেই নিজের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন৷ কিন্তু সেনেটর হিসাবে কাজ করে যান তিনি৷ ২০০৮ সালেও প্রথমে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আগ্রহ দেখিয়েছিলেন তিনি৷ জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রতীক হিসাবে ২০১৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁকে ‘প্রেসিডেনশিয়াল মেডাল অফ ফ্রিডম’ প্রদান করেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/N. Kamm
গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ
রাজনীতির শুরু থেকেই বাইডেন ক্রেতা সুরক্ষা ও পরিবেশবিষয়ক ইস্যু নিয়ে সোচ্চার থেকেছেন৷ ২০১০ সালের ‘পেশেন্ট প্রোটেকশান অ্যান্ড অ্যাফোর্ডেবল কেয়ার’ আইনের বাস্তবায়নে তাঁর ভূমিকার কথা বারবার আলোচিত হয়েছে৷ শুধু তাই নয়, ১৯৯২ সাল থেকেই আইনি কড়াকড়ি বাড়ানো ও সাজার মেয়াদ বাড়ানোর পক্ষে তাঁর অবস্থান তিনি স্পষ্ট করেছেন, যা অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর দলের নীতির সাথে পুরোপুরি খাপ খায়নি৷
ছবি: Jim Watson/AFP/Getty Images
বাইডেনকে ঘিরে বিতর্ক
১৯৮৮ সালের নির্বাচনি প্রচারের সময় বাইডেনের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ লেবার পার্টির নিল কিনকের বক্তব্য চুরির অভিযোগ ওঠে৷ এছাড়া অ্যামেরিকার দক্ষিণাঞ্চলের বর্ণভিত্তিক বিভেদপন্থিদের সাথে সুর মিলিয়ে আদালতের রায়ের বিরোধিতা করে সমালোচিত হন বাইডেন৷ ২০১২ সালেও সমকামী জুটিদের বিয়ের অধিকারের পক্ষে কথা বলে বাইডেন শিরোনামে উঠে আসেন৷
ছবি: Carolyn Kaster/AP/picture alliance
যৌন নির্যাতনের অভিযোগ
২০২০ সালের মার্চ মাসে টারা রিড অভিযোগ আনেন যে ১৯৯৩ সালে জো বাইডেন তাঁকে যৌন নির্যাতন করেছিলেন৷ সেনেটর থাকাকালীন বাইডেনের অফিসে সহযোগী হিসাবে কাজ করতেন রিড৷ ১৯৯৩ সালে বিষয়টি আলোচিত হবার পর নতুন করে এবছর আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রেক্ষিতে সেটি আলোচনায় উঠে আসে৷ এই অভিযোগ বাইডেন উড়িয়ে দিলেও আরো কয়েকজন নারী বাইডেনের বিরুদ্ধে অসঙ্গত আচরণের অভিযোগ এনেছেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/J. Locher
বাইডেনের যত নাম
গণমাধ্যমে বাইডেনের নামের সাথে জুড়েছে নানা ধরনের বিশেষণ৷ জীবনের গোড়ার দিকের অর্থনৈতিক বাস্তবতার কারণে কখনো তাঁর নাম হয়েছে ‘মিডল ক্লাস জো’৷ ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণের সময় বয়সের কারণে ডনাল্ড ট্রাম্প তাঁকে তাচ্ছিল্য করে বলেন ‘স্লো জো’ ও ‘স্লিপি জো’৷
ছবি: Jim Watson/AFP/Getty Images
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ
২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিসাবে অংশগ্রহণ করেন জো বাইডেন৷ তার পক্ষে ব্যাপকভাবে প্রচারে নামেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা৷ টুইটার-ইন্সটাগ্রামে পাশে দাঁড়ান সেলেব্রেটিরাও৷ নির্বাচনে ডনাল্ড ট্রাম্পকে হারিয়ে বিজয়ী হন তিনি৷ বাইডেনের নির্বাচনসঙ্গী কমলা হ্যারিস দেশের প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত, প্রথম আফ্রিকান-অ্যামেরিকান ও প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়ে ইতিহাস গড়েন৷
ছবি: Carolyn Kaster/AP Photo/picture alliance
11 ছবি1 | 11
অন্য একটি বিরোধের ক্ষেত্রেও অ্যাটলান্টিকের দুই প্রান্তের মধ্যে মীমাংসার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠছে৷ ফ্রান্স, জার্মানি, ইটালি ও ব্রিটেনের মতো কিছু শিল্পোন্নত দেশ বাইডেন প্রশাসনের প্রস্তাব মেনে বহুজাতিক কোম্পানিগুলির আয়ের উপর বিশ্বজুড়ে সর্বনিম্ন ১৫ শতাংশ কর চাপাতে রাজি হয়েছে৷ সেই প্রস্তাব কার্যকর করতে অনেক সময় লাগলেও একক নীতির ফলে আখেরে সব পক্ষের লাভ হবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে৷