1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ইউরোপের স্বপ্নের হাতছানিতে মৃত্যুযাত্রা!

সমীর কুমার দে ঢাকা
১৫ জানুয়ারি ২০২৩

স্বপ্নের হাতছানিতে অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশ করতে গিয়ে প্রতিনিয়তই মৃত্যু হচ্ছে বাংলাদেশের তরুণদের৷ মৃত্যুর এই যাত্রায় সবশেষ যুক্ত হয়েছে সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার কলেজছাত্র তানিল আহমেদের নাম৷

Flüchtlinge Griechenland Grenze zu Nordmazedonien
গ্রিস ও নর্থ মেসেডোনিয়া সীমান্তে কয়েকজন অভিবাসনপ্রত্যাশী৷ ফাইল ছবি৷ ছবি: Nicolas Economou/NurPhoto/picture alliance

গত বছরের ঠিক এই সময়ে লিবিয়া হয়ে ইউরোপে যাওয়ার পথে তীব্র তুষারপাতের কবলে পড়ে মারা যান বাংলাদেশী ৭ তরুণ৷ এছাড়া ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে প্রতিনিয়তই বাংলাদেশিদের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়৷ কেন তরুণদের নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না, এই অবৈধ যাত্রা থেকে? কীভাবেই বা কমতে পারে এই মৃত্যুর মিছিল?

দুই বছর আগে বাবা গিয়াস উদ্দিন মারা গেছেন৷ সাত ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় ২২ বছরের তরুণ তানিল আহমেদ৷ সবে ডিগ্রি পাশ করেছেন৷ কীভাবে সংসার চালাবেন? ভাইবোনকে কীভাবে শিক্ষিত করে গড়ে তুলবেন, এ চিন্তা থেকেই বিদেশে পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নেন৷ তিল তিল করে জমানো ৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা তুলে দেন গ্রামের শাহীন মিয়ার হাতে৷ তাকে তানিলরা চাচা বলেই সম্বধোন করতেন৷ একদিন মেলে বিদেশ যাওয়ার সুযোগও৷ উড়াল দেন তানিল৷ মাত্র সাড়ে তিন মাসের মাথায় এলো মৃত্যু সংবাদ৷

তানিলরা ৪ ভাই আর ৩ বোন৷ তানিলের চেয়ে দুই বছরের ছোট জামিল আহমেদ৷ কেবল এইচএসসি পাশ করেছেন৷ এখন ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত৷ ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে জামিল বলছিলেন, ‘‘ভাই ইরানে যাওয়ার পর কোম্পানি খুঁজে পায়নি৷ অনিশ্চিত একটা অবস্থার মধ্যে পড়েছিল৷ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ওরা কয়েকজন মিলে তুরস্ক হয়ে গ্রিসে যাবে৷ এর মধ্যেই ওর সঙ্গে থাকা মাসুম আহমেদ আমাকে ফোন করে ভাইয়ের মৃত্যুর খবর দিয়েছে৷ ছবিও পাঠিয়েছে৷ এরপর আর শাহীন চাচা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি৷ তার মোবাইল ফোনও বন্ধ৷ ছোট ছোট দুই ভাই আর তিন বোনকে নিয়ে আমি কীভাবে চলবো? ভেবেছিলাম ভাই টাকা পাঠালে ডিগ্রি ভর্তি হবো৷ এখন তো আর সেটাও হবে না৷ পাড়ার কোণায় আমাদের একটা টং দোকান আছে৷ এখন আমাকে সেটাই দেখতে হবে৷ খুবই অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছি আমরা৷ ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শোনার পর মা সেলিনা বেগম অসুস্থ হয়ে পড়েছেন৷ ভাই-বোনগুলো শুধুই কাঁদছে৷’’

ইরানে কোম্পানি না পেয়ে ভাই গ্রিসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল: জামিল আহমেদ

This browser does not support the audio element.

তানিলের চাচা নূর মিয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা যেটা জেনেছি, আগে ওকে মারধর করা হয়েছিল৷ পরে কয়েকজন দালালের মাধ্যমে হেঁটে ইরান থেকে তুরস্ক থেকে গ্রিসে যাওয়ার জন্য রওনা হয়েছিলেন তানিল৷ তখন তীব্র ঠান্ডা ছিল৷ তুরস্ক সীমান্তের কাছাকাছি একটি পাহাড়ে গিয়ে তানিল ঠান্ডায় অসুস্থ হয়ে পড়ে৷ সেখানেই সে মারা যায়৷ মৃত তানিলের ছবিও ওর সঙ্গে থাকা লোকজন আমাদের পাঠিয়েছে৷ এখন তানিলের লাশটি আমরা কীভাবে দেশে ফিরিয়ে আনবো সেই চিন্তাই করছি৷ গ্রামের শাহীন মিয়া ফোন বন্ধ করে রেখেছেন৷ লোকের মাধ্যমে তার সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে৷ তার কাছে আমরা অনুরোধ করেছি, অন্তত লাশটি ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করে দিক৷ আমি স্থানীয় চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করেছি যাতে তানিলের লাশটি দেশে আনার ব্যবস্থা করে দেন৷ তিনি চেষ্টা করবেন বলে জানিয়েছেন৷’’

স্থানীয় পশ্চিম বীরগাঁও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান লুৎফুর রহমান জায়গীরদার খোকন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তানিলের চাচা আমাকে বিষয়টি বলেছেন৷ আমি ইউএনও সাহেবকে অনুরোধ করেছি যাতে লাশটি ফেরত আনার ব্যবস্থা করে দেন৷’’ এভাবে তরুণরা যে অবৈধভাবে ইউরোপে পাড়ি জমানোর উদ্দেশ্যে যাচ্ছে, আপনারা কি জানেন না? জবাবে তিনি বলেন, ‘‘প্রতিদিনই আমাদের এই এলাকা থেকে ৮-১০ জন করে তরুণ বিদেশে যাচ্ছে৷ আমরা নানাভাবে তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেও পারছি না৷ দালালদের বিরুদ্ধে কেউ মামলাও করে না৷ফলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছি না৷ এর বাইরে আমরা কী করবো?’’

তানিলের লাশ ফেরত আনার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে শান্তিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আনোয়ারুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ওই ছেলেটির পরিবারের কেউ আমাদের বিষয়টি জানায়নি৷ স্থানীয় চেয়ারম্যানের কাছ থেকে জেনে আমরা ঢাকায় জানিয়েছি৷ এখনও তো লাশের অবস্থানই শনাক্ত করা যায়নি৷ ফলে কীভাবে লাশটি আনা হবে তা আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না৷ এর আগে যারা মারা গেছে তাদের লাশও কিন্তু ফেরত আনা যায়নি৷ তারপরও আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করবো লাশটি আনার জন্য৷’’

যে শাহীন মিয়ার মাধ্যমে তানিল ইরানে গেছে, সেই শাহীন মিয়ার মোবাইল ফোনটি বন্ধ৷ কোনোভাবেই তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি৷

গত ৭ মার্চ মানব পাচারকারীদের প্রতারণায় সার্বিয়ার রাস্তায় প্রাণ যায় বাংলাদেশি তরুণ বাদল খন্দকারের (৩০)৷ বাদল মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার নূর মোহাম্মদের ছেলে৷ ৬ লাখ ৯০ হাজার টাকা দিয়ে বাদল মেসার্স নূরজাহান রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে জনশক্তি ব্যুরোর ছাড়পত্র নিয়ে ২০২১ সালের ১৭ নভেম্বর সার্বিয়া যান৷ চুক্তি ছিল সার্বিয়াতে কোম্পানির কাজ দেবে৷ বাদল সেখানে গিয়ে ২৫ দিন কাজও করেছে৷ এরপর কোম্পানি বন্ধ হয়ে যায়৷ হতাশায় দিন কাটে বাদলের৷ বাঁচার তাগিদে বাদল সার্বিয়া থেকে ইতালির উদ্দেশ্য রওনা দেন৷ তীব্র ঠান্ডায় অসুস্থ্ হয়ে পথেই মৃত্যু হয় বাদল খন্দকারের৷

জনশক্তি ব্যুরোর ছাড়পত্র নিয়ে যাওয়ার কারণে বাদলের লাশ সরকারি উদ্যোগেই দেশে এসেছে৷ বাদলের স্ত্রী শাহনাজ আক্তার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি মামলা করেছিলাম৷ সেই মামলায় নূরজাহান এজেন্সির মালিককে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ৷ তারা তিন লাখ টাকা দেওয়ার শর্তে সমঝোতা করেছিল৷ এক লাখ টাকা দিয়েছে৷ আর মামলা নিষ্পত্তি হলে দুই লাখ টাকা দেবে৷ এছাড়া সরকারের তরফ থেকে তিন লাখ টাকা পেয়েছি৷ এক ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে কষ্টেই দিন চলছে৷’’ শাহনাজ জানালেন, একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করেছেন, শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে সাভারে বাবার বাড়িয়ে থাকছেন বাচ্চা দু’টিকে মানুষ করার জন্য৷

বাদলের লাশ দেশে ফিরলেও গত ১৭ ফেব্রুয়ারি তুরস্ক সীমান্তে মারা যাওয়া নজরুল ইসলাম শাহীনের লাশ দেশে আসেনি৷ স্বপ্নের হাতছানিতে অবৈধভাবে ইউরোপ প্রবেশ করতে গিয়ে ২৮ বছরের তরুণ শাহীনের মৃত্যু হয়েছে৷ তুরস্ক সীমান্ত পাড়ি দিয়ে গ্রিসে প্রবেশের চেষ্টা করছিলেন শাহীন৷ তার বাড়ি ফেনীতে৷ তিনি ওমান থেকে তুরস্ক হয়ে ইউরোপ প্রবেশ করতে গিয়ে তীব্র তুষারপাতের কবলে পড়ে মারা যান৷ তিনি ফেনী পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বারাহীপুর এলাকার মাস্টারবাড়ির মিজানুর রহমানের ছেলে৷ ফেনীর শহীদ মেজর সালাহ উদ্দিন মমতাজ বীর উত্তম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১০ সালে এসএসসি পাস করেন৷ ২০১৯ সালে জীবিকার তাগিদে তিনি দেশ ছেড়ে ওমান যান৷ দুই বছর ওমানে থাকার পর তিনি গত বছর তুরস্কে যান৷ সেখান থেকে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করেন৷ গ্রিসে প্রবেশের সময় তুষারপাতের কবলে পড়েন৷ তীব্র শীত ও খোলা আকাশের নীচে টানা দীর্ঘসময় থাকার কারণে তার মৃত্যু হয়েছে৷

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর ডয়চে ভেলেকে বলছিলেন, ‘‘এই ধরনের অবৈধ অভিবাসন বন্ধ করতে হলে শুধু একটা রাষ্ট্রের উদ্যোগ নিলেই হবে না৷ এটা একটা আন্তর্জাতিক ব্যাপার৷ যৌথ প্রচেষ্টা দরকার৷ আমাদের সরকার চাইলে কিছু উদ্যোগ নিতে পারে৷ এরা তো অনেকেই এয়ারপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে৷ সেখানে আমাদের ইমিগ্রেশন পুলিশ আছে৷ যাদের দেশি-বিদেশি প্রশিক্ষণ আছে, তারা তো কারো সঙ্গে দুই মিনিট কথা বললেই বুঝতে পারবে৷ হ্যাঁ, তার যদি বৈধ কোনো ভিসা থাকে সেটার পরও তো তাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করা যেতে পারে৷ এখানে সরকারি পর্যায় থেকে এদের সচেতন করার ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে৷’’

মনে হয়, তারা গিয়ে কী বিপদে পড়লো সেটা নিয়ে রাষ্ট্র অতটা চিন্তিত না: তৌহিদ হোসেন

This browser does not support the audio element.

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই অবৈধ চেষ্টা বন্ধে আমাদের দু’টো জিনিস দেখতে হবে৷ এই যে ছেলেগুলো যায় তারা তো এই রাস্তা বের করতে পারে না৷ কতগুলো দালাল বা মধ্যস্বত্বভোগী তাদের এই রাস্তায় নিয়ে যায়৷ এই দালালদের বিরুদ্ধে কি আমরা কখনও কোনো ব্যবস্থা নিয়েছি? একজনকেও শাস্তির আওতায় আনতে পেরেছি? না৷ তাদের শাস্তির আওতায় আনার দায়িত্ব কার? রাষ্ট্রের৷ রাষ্ট্র তো সেটা করছে না৷ তাহলে অন্যরা এটা দেখে উৎসাহিত হচ্ছেন৷ ওদেরও শাস্তি হয়নি, আমারও হবে না৷ আর দ্বিতীয় ব্যর্থতা হলো, রাষ্ট্রে ভূমিকা দেখে মনে হয়, যাচ্ছে তো যাক না৷ তবুও তো যাচ্ছে৷ যেতে থাকুক৷ যত যায় ততই ভালো৷ তারা গিয়ে কী বিপদে পড়লো সেটা নিয়ে রাষ্ট্র অতটা চিন্তিত না৷ পরে দেখা গেছে, ইউরোপের সঙ্গে চুক্তি করেও আমরা অবৈধদের ফেরত আনতে গড়িমসি করেছি৷ পরে কিছু একটা করায় বাজে রকমের যে নিষেধাজ্ঞা আসার সম্ভাবনা ছিল সেটা আর হয়নি৷ আসলে তো এই পরিবেশ সৃষ্টি হওয়া উচিত ছিল না৷’’

গত বছরের ঠিক এই সময় ২৫ জানুয়ারি লিবিয়া থেকে ইউরোপে যাওয়ার পথে সাত বাংলাদেশি তরুণ প্রাণ হারান৷ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে তখন বলা হয়েছিল, অবৈধভাবে তারা নৌকাযোগে লিবিয়া থেকে ইতালির লাম্পেদুসা দ্বীপের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন৷ ঠান্ডায় তারা প্রাণ হারিয়েছেন৷ পরে এক বিবৃতিতে ইতালির আগ্রিজেন্তোর প্রসিকিউটর লুইগি প্যাত্রোনাজিও বলেন, ঠান্ডায় শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত কমে আসায় ওই বাংলাদেশিরা প্রাণ হারিয়েছেন৷ তাদের কারো লাশ তখন দেশে ফেরত আনার ব্যবস্থা করা হয়নি৷

ব্র্যাকের অভিভাসন বিভাগের প্রধান শরীফুল হাসান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের দেশের ৮ থেকে ১০ জেলার মানুষের কাছে ইউরোপে যাওয়া স্বপ্নযাত্রা৷ আমরা এটাকে বলি মৃত্যুযাত্রা৷ এভাবে যেতে গিয়ে কত মানুষ মারা গেছেন, কত মানুষ বন্দি হয়েছেন সেটার তো শেষ নেই৷ গত একযুগে পরিসংখ্যান যে আমরা ইউরোপের কাছ থেকে পেয়েছি, তাতেই দেখা যাচ্ছে, ৬৫ হাজার মানুষ ইউরোপে ঢুকতে গিয়ে চিহ্নিত হয়েছেন বা আটক হয়েছেন৷ এখানে তো বছরের পর বছর পাচারকারী চক্র গড়ে উঠেছে৷ সবগুলো আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী তো এটা নিয়ে কাজ করে৷ কিন্তু সমন্বিত কোন অভিযান, সেটা বছরজুড়ে হচ্ছে না৷ পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবে উদ্যোগ নিতে হবে৷ সবাই মিলে চেষ্টা করলেই এই মৃত্যুযাত্রা থামানো সম্ভব৷’’

 

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ