২০২০ সালে ডিসেম্বরে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল বসনিয়ার লিপা অভিবাসী কেন্দ্র৷এরপর একটি অস্থায়ী শিবির তৈরি করা হয়, যেখানে ছিল না জীবনধারণের ন্যূনতম ব্যবস্থাও৷ অবশেষে গত নভেম্বরে চালু হয়েছে নতুন ক্যাম্প৷

দূর পাহাড়ের গায়ে ক্যাম্পগুলি দেখা যাচ্ছে৷ এখানেই অভিবাসীরা রয়েছেন৷ মূল সড়ক থেকে দুই তিন দূরে অবস্থিত এই কেন্দ্রটি৷ শীতের সময় প্রায়ই বরফে ঢাকা থাকে৷ তবে ক্যাম্পের অভিবাসীদের জন্য গরম পোশাক এবং হিটার ইত্যাদির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রয়েছে৷

লিপা মাইগ্রান্ট ক্যাম্পে ‘অভিভাবকহীন অপ্রাপ্তবয়স্ক’ দের জন্য আলাদা জোন রয়েছে৷ সেখানে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ-সহ বিভিন্ন সংস্থা শিশুদের জন্য বই খেলাধূলার সামগ্রী থেকে নানা সরঞ্জাম সরবরাহ করে৷

লিপা ক্যাম্পের বাইরে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু দোকান৷ সেখানে গেমে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম বিক্রি করা হয়৷ অনিয়মিত পথে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নে ঢোকার চেষ্টাকে গেম নামে অভিহিত করে থাকেন অভিবাসীরা৷ এই গেম শপ চালান স্থানীয় বাসিন্দারা৷

লিপা ক্যাম্পের এই জোনে ক্যাম্পে আসা নতুন অভিবাসীদের আলাদা করে রাখা হয়৷ করোনা-সহ অন্যান্য স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর তাদের পাঠানো হয় ক্যাম্পের অন্য জোনে৷ বিভিন্ন ভাষাভাষীর বোঝার সুবিধার জন্য একাধিক ভাষায় লেখা রয়েছে সাইনবোর্ড৷ এর মধ্যে রয়েছে বাংলা ভাষাও৷

পাকিস্তান থেকে আসা এক অভিবাসী নিজের উদ্যোগে ক্যাম্পে তার ঘরের বাইরে চুল, দাড়ি কাটার সেলুন খুলেছেন৷ ক্যাম্পে আনুষ্ঠানিক সেলুন থাকলেও অভিবাসীদের অনেকেই তার কাছে আসেন৷

বসনিয়ার লিপা ক্যাম্পে ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান-সহ বিভিন্ন দেশের প্রায় তিনশ জন অভিবাসনপ্রত্যাশী রয়েছেন৷

লিপা ক্যাম্প পরিচালনা করে বসনিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷ অভিবাসীদের ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম ) সহায়তা করে৷ ক্যাম্পটি জার্মানি-সহ ইউরোপের চারটি দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে তৈরি করা হয়েছে৷

দুই কোটির বেশি অভিবাসী মানুষের বসবাস ইউরোপের ২৭টি দেশে৷ এ অঞ্চলের শ্রমবাজারে নিযুক্ত রয়েছেন ৮৮ লাখ৷ ২০১৯ সালে ইইউ সদস্যভুক্ত দেশগুলোতে প্রথমবার রেসিডেন্স পারমিট বা বসবাসের অনুমতি পাওয়া তৃতীয় দেশের মানুষের সংখ্যা ছিল ৩০ লাখ৷

৩৮ ভাগ অভিবাসী রেসিডেন্স পারমিট পেয়েছেন পরিবারের কোনো সদস্য ইউরোপে থাকার কারণে৷ কাজের সূত্রে থাকার অনুমতি পেয়েছেন ১৭ ভাগ৷ আশ্রয়াপ্রার্থী ছিলেন নয় ভাগ৷ শিক্ষাগত কারণে সুযোগ পেয়েছেন চার ভাগ৷ বাকি ৩২ ভাগ অন্যান্য৷

২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো রেসিডেন্স পারমিট পাওয়াদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিলেন ইউক্রেনের নাগরিক৷ প্রথম দশের মধ্যে বাকিরা যথাক্রমে মরক্কো, চীন, ব্রাজিল, সিরিয়া, রাশিয়া, তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র ও বেলারুশের নাগরিক৷

তৃতীয় কোনো দেশ থেকে ইউরোপে চাকুরি নিয়ে আসা দক্ষ কর্মীরা পান ব্লু কার্ড৷ এটি নির্ভর করে চাকরির চুক্তিপত্র, পেশাগত যোগ্যতা ও বেতনের উপরে৷ ২০১৯ সালে ৩৭ হাজার বিদেশি নাগরিক ব্লু কার্ড পেয়েছেন ইউরোপে৷ এর বাইরে প্রতি বছর এক লাখের বেশি মানুষ মৌসুমি কর্মী হিসেবে বিভিন্ন খাতে কাজের জন্য আসেন৷ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ও কারখানার কর্মী বা স্বনিয়োজিত কাজেও ইউরোপে বসবাসের সুযোগ পান অনেকে৷

কোনো অভিবাসী ইউরোপে বৈধভাবে বসবাস ও নির্দিষ্ট কিছু শর্ত পূরণের মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদেরও আনতে পারেন৷ স্বামী বা স্ত্রী, অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তান এবং কিছু ক্ষেত্রে অবিবাহিত সঙ্গী, প্রাপ্তবয়স্ক নির্ভরশীল সন্তান, নির্ভরশীল বাবা-মা, দাদা-দাদি কিংবা নানা-নানিও অনুমতি পেয়ে থাকেন৷ নির্দিষ্ট দেশে পৌঁছানোর পর তাদেরকে রেসিডেন্স পারমিট নিতে হয়৷ শিক্ষা, কর্মসংস্থানের সুযোগ কিংবা প্রশিক্ষণও নিতে পারেন তারা৷

এজন্য আগ্রহীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভর্তির অনুমতি, হেলথ ইন্সুরেন্স, অপ্রাপ্তবয়স্ক হলে অভিভাবকের অনুমতি, কিছু ক্ষেত্রে ভাষাগত দক্ষতার প্রমাণসহ প্রয়োজনীয় শর্তগুলো পূরণ করে ইউরোপের কোনো দেশে আসার আবেদন করতে পারেন৷ কিছু দেশে পড়াশোনার টিউশন ফি নেই, আছে বৃত্তির সুযোগও৷ এছাড়াও খরচ মেটানোর জন্য শিক্ষার্থীদের সপ্তাহে ১৫ ঘণ্টা কাজের সুযোগ রয়েছে৷ পড়াশোনা বা গবেষণা শেষে কর্মসংস্থানের জন্য মেলে নয় মাস সময়৷

ইউরোপের কোনো দেশে টানা পাঁচ বছর অবস্থানের পর নির্দিষ্ট কিছু শর্ত পূরণ সাপেক্ষে অভিবাসীরা দীর্ঘ মেয়াদে বসবাসের অনুমতি পেতে পারেন৷ এর ফলে কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, সামাজিক নিরাপত্তা ও সহায়তা এবং পণ্য ও সেবাপ্রাপ্তির মতো কিছু ক্ষেত্রে ইউরোপের নাগরিকদের মতোই অধিকার ভোগ করতে পারবেন৷ তবে এক্ষেত্রে আলাদা অভিবাসন ও আশ্রয় নীতি অনুসরণ করে আয়ারল্যান্ড ও ডেনমার্ক৷

২০১৯ সালে প্রায় সাত লাখ মানুষ ইউরোপে আশ্রয়ের আবেদন জানিয়েছেন৷ প্রথমবারের মতো যারা এমন আবেদন করেছেন, তাদের ১২ ভাগই সিরিয়ার নাগরিক৷ আফগানিস্তানের আট দশমিক ছয় ভাগ, ভেনেজুয়েলার সাত দশমিক এক ভাগ, কলম্বিয়ার পাঁচ ভাগ, পাকিস্তানের ছিলেন প্রায় চার ভাগ৷ ঐ বছর দুই দশমিক এক ভাগ বা ‌১৩ হাজার ১৯০টি আবেদন পড়েছিল বাংলাদেশিদের৷ ২০২০ সালে প্রথম দশ মাসে ইউরোপে মোট তিন লাখ ৯০ হাজার মানুষ আশ্রয়ের আবেদন জানিয়েছেন৷

২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এক লাখ ১৪ হাজার ৩০০ জন অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশ করেছেন৷ এটি তার আগের বছরের একই সময়ে চেয়ে ১০ ভাগ কম৷ যারা এভাবে আসেন, তাদের একটি বড় অংশকে এক পর্যায়ে ফেরত পাঠানো হয়৷ ২০১৯ সালে চার লাখ ৯১ হাজার জনকে ইউরোপ ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল৷ এক লাখ ৪২ জনকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল৷