অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপের গ্রামাঞ্চলে জনসংখ্যা যেভাবে বাড়তে থাকে, তা থেকেই গ্রামীণ শিল্পের প্রবৃদ্ধি হয়৷ অন্যভাবে বলতে গেলে, চাষির ঘরে যে পরিমাণ সন্তান জন্মগ্রহণ করছিল, তাদের সকলের জন্য পর্যাপ্ত চাষের কাজ ছিল না৷ গ্রামের মানুষও বাড়তি রোজগারের সুযোগ পেলে ছাড়বেন কেন? কৃষিকাজ প্রধানত মৌসুমি হওয়ার ফলে, যাদের ক্ষেতখামারে বাঁধা কাজ ছিল, তাদের হাতেও প্রচুর সময় উদ্বৃত্ত থাকত৷ শহরের পুঁজিবাদিরা এই বাড়তি শ্রমিকদের আঁচ পেয়ে দেখেন যে, শহুরে শ্রমিকদের চেয়ে কম পারিশ্রমিকে এই গ্রামীণ শ্রমিকদের কাজে লাগানো যায়৷ তা থেকে যে গ্রামীণ শিল্পের সৃষ্টি, তারই নাম কুটির শিল্প৷
শহুরে ব্যবসায়ী হয়ত কোনো খামারচাষির কাছে পশম কিনে, কয়েকটি চাষি পরিবারকে দিয়ে সুতো কাটিয়ে, সেই সুতো রং করিয়ে ইত্যাদি একাধিক পদক্ষেপে গ্রামের কাঁচামালকে শহরের কাঁচামালে পরিণত করতেন এই ‘পুটিং-আউট' পদ্ধতিতে৷ তুলোর ক্ষেত্রে সুতো কাটার পরে আসত তাঁত বোনা৷ ব্যবসায়ী কাঁচামাল আর দাদন দিয়ে খালাস; পরে তৈরি পণ্য শহরে বিক্রির দায়িত্বও হতো ব্যবসায়ীর৷
ঢাকা থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে নারায়ণগঞ্জ৷ আর সেখানে রূপগঞ্জের নোয়াপাড়া এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদী তীরে ঐতিহ্যবাহী জামদানি শাড়ি তৈরি হচ্ছে বহুকাল ধরে৷
ছবি: DW/M. Mamunজনশ্রুতি আছে অতীতে সোনারগাঁও সংলগ্ন এ এলাকার মানুষরা বিশ্বখ্যাত মসলিনের কারিগর ছিলেন৷ ইংরেজরা এ শিল্পকে ধ্বংস করে দেয়ার পর, এ সব এলাকার মানুষেরা ফিরে যান কৃষি পেশায়৷ ইংরেজদের শাসনের অবসানের পর মসলিন শিল্পীদের বংশধররা আবারও শুরু করেন মসলিন তৈরি৷ কিন্তু তাঁরা ব্যর্থ হন৷ মসলিনের আদলেই তাঁরা তৈরি করেন নতুন এক কাপড়, যা পরিচিত পায় জামদানি হিসেবে৷
ছবি: DW/M. Mamunনারায়ণগঞ্জে মূল জামদানিপল্লি আসলে বিসিক শিল্প এলাকায়৷ তবে এর বাইরেও নোয়াপাড়ার বাড়িতে বাড়িতে আছে বেশ কিছু জামদানির কারখানা৷ সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি এ সব কারখানায় চলে জামদানি তৈরির কাজ৷
ছবি: DW/M. Mamunএকেকটি জামদানি কারখানায় চার থেকে ২৪ জন পর্যন্ত শ্রমিক কাজ করেন৷
ছবি: DW/M. Mamunজামদানি কারখানাগুলোর সার্বক্ষণিক দেখভাল করেন মহাজন৷ বেশিরভাগ জামদানি শ্রমিক মজুরি পান শাড়ি প্রতি চুক্তি হিসেবে৷
ছবি: DW/M. Mamunসাধারণত একটি শাড়ি তৈরি করতে দু’জন শ্রমিকের প্রয়োজন হয়৷ একজন কারিগর ও অন্যজন তাঁর সাহায্যকারী৷ সাহায্যকারীর ভূমিকায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় শিশুরাদের৷
ছবি: DW/M. Mamunএকটি জামদানি শাড়ি তৈরিতে ন্যূনতম তিন দিন সময় লাগে৷ নকশা আর কারুকাজভেদে কোনো কোনো শাড়িতে তিন মাসও লেগে যায়৷ একটি শাড়ি তৈরি করে দু’জন শ্রমিক দুই হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত মজুরি পান৷
ছবি: DW/M. Mamunজামদানি তৈরিতে নারিরাও বেশ দক্ষ৷ বেশিরভাগ কারখানাতেই নারী শ্রমিকের উপস্থিতি দেখা যায়৷
ছবি: DW/M. Mamunবিভিন্ন মহাজনী কারখানা ছাড়াও বিসিক শিল্প নগরী ও এর আশপাশের এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে দু-একটি করে তাঁত আছে৷ পরিবারের সবাই মিলে এ সব তাঁতে জামদানি তৈরি করেন৷
ছবি: DW/M. Mamunজামদানি পল্লীর তাঁতগুলো সপ্তাহের সাত দিনই সকাল থেকে রাত অবধি চালু থাকে৷ তবে শুক্রবার বাজারের দিন এ পল্লীতে কাজ কম হয়৷
ছবি: DW/M. Mamunসারা সপ্তাহের বোনা জামদানি নিয়ে মহাজন ও কারিগররা জড়ো হন শীতলক্ষ্যার পশ্চিম তীরের প্রাচীন জামদানি হাটে৷ প্রতি শুক্রবার সকাল সাতটা থেকে নয়টার মধ্যেই হাটের কেনাবেচা শেষ হয়ে যায়৷ এ হাটে সাধারণত সারা দেশের পাইকাররাই আসেন৷
ছবি: DW/M. Mamunজামদানি শিল্পীদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন বিসিক জামদানি শিল্পনগরীতেও একটি হাট স্থাপন করে দিয়েছে৷ এ হাটটিও প্রতি শুক্রবার একই সময়ে বসে, তবে দুই ঘণ্টার মধ্যেই শেষ হয়ে যায়৷
ছবি: DW/M. Mamunজামদানি হাট ছাড়াও নোয়াপাড়ার বিসিক জামদানি শিল্পনগরীতে আছে বেশ কিছু ছোট বড় বিক্রয় কেন্দ্র৷ এ সব দোকান থেকেও পাইকারি ও খুচরা মূল্যে জামদানি বিক্রি হয়৷
ছবি: DW/M. Mamunবয়নের অতুলনীয় পদ্ধতি আর শিল্পমানের কারণে জামদানি ইউনেস্কো কর্তৃক ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেইজ’ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে৷
ছবি: DW/M. Mamunজামদানি বলতে সবাই সাধারণত শাড়ি বুঝলেও বর্তমান সময়ে জামদানি দিয়ে পাঞ্জাবি, সালোয়ার কামিজ এমন কি সোফার কভার, কুশন কভার, ঘরের পর্দা ইত্যাদিও তৈরি হচ্ছে৷
ছবি: DW/M. Mamun গ্রামীণ বস্ত্রশিল্প
এভাবেই কুটিরশিল্প থেকে গড়ে ওঠে এক গ্রামীণ বস্ত্রশিল্প, যার মূল সমস্যা ছিল সংগঠনের অভাব৷ বিভিন্ন কারিগরি বা হাতের কাজের পেশার শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ, অনুমোদন ও তাদের কাজের মান নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য ইউরোপে বহুকাল ধরে তথাকথিত ‘গিল্ড' বা সমবায় সংঘগুলি ছিল৷ গ্রামীণ শ্রমিকদের উপর এই পেশাদারি সমবায় সংঘগুলির কোনো নিয়ন্ত্রণই ছিল না৷ অন্যদিকে যে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা গাঁয়ের শ্রমিকদের দাদন দিচ্ছেন, তাদের উপরেও ‘গিল্ড'-গুলির কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না৷ কাজেই গ্রামীণ বস্ত্রশিল্পে বাঁধা ওজন, কিংবা গাঁটরির সাইজ ইত্যাদি নির্দ্দিষ্ট করার মতো কেউ ছিল না৷ কাজেই ঝগড়াঝাঁটি লেগেই থাকত৷ পণ্যের মানও খুব ভালো হতো না৷ মাইনে হাতে পেয়ে শ্রমিকরা দিন দু'য়েক ‘জিরিয়ে' নিতেন৷ অর্থাৎ তথাকথিত কুটিরশিল্পের অনেক সুবিধা ও অসুবিধা এই গ্রামীণ বস্ত্রশিল্পেও ছিল৷
আজকের কুটিরশিল্প
আজ জার্মানিতে বা অস্ট্রিয়াতে কুটিরশিল্প বলতে যা বোঝায়, তা হলো হাতের কাজ – ঘড়ি তৈরি থেকে শুরু করে ঝুড়ি বোনা কিংবা কাঠ খোদাইয়ের কাজ যার মধ্যে পড়বে৷ জার্মানির সব পর্যটকপ্রিয় অঞ্চলেরই কিছু কিছু নিজস্ব হাতের কাজ আছে, যা টুরিস্টদের কাছে বিভিন্ন ‘সুভেনির'-এর দোকানে বিক্রি করা হয়ে থাকে৷
মনে রাখতে হবে, সুভেনির বলতেই যে কিছু হাতের কাজ হবে, এমন নয়৷ কোনো পরিচিত জায়গার সুভেনির বা স্মৃতিচিহ্ন এখন ফুটবল ক্লাবগুলির মার্চেন্ডাইজিং-র মতো হয়ে গেছে: কোলোনের সুবিখ্যাত ক্যাথিড্রাল থেকে শুরু করে বার্লিনের মতো রাজধানী শহর, সকলেই এভাবে টুরিস্টদের কাছে সুভেনির বেচে থাকে৷ এই সুভেনিরের ব্যবসা আজ কুটিরশিল্পের আওতা ছাড়িয়ে বাণিজ্যিকতার অন্য একটা পর্যায়ে চলে গেছে৷
বলতে কি, কুটিরশিল্পই কুটির ছাড়িয়ে কবে ছোটবড় কারখানা ও উদ্যোক্তাদের হাতে চলে গেছে – অথবা যাচ্ছিল, যদি না জার্মান সরকার কিংবা অস্ট্রিয়ান সরকারের মতো সরকারবর্গ ‘ট্রেড স্কুল', অর্থাৎ কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্র তৈরি করে সেই প্রবণতাকে কিছুটা বাঁধ দেবার চেষ্টা করতেন৷ এভাবে কুটিরশিল্প ‘সংস্কারের' যে প্রচেষ্টা করা হয়েছে, তা হল এই যে, তরুণ বা উঠতি কারিগররা তাদের প্রথাগত পণ্যগুলিকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য আধুনিক ডিজাইন শৈলীতে প্রশিক্ষণ পাবেন৷ পটারি বা মৃৎশিল্পে জার্মানির কার্লসরুহে শহরের সরকারি চারুকলা বিদ্যালয়, অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনার ‘গেভ্যার্বে' বা ট্রেড মিউজিয়াম, অথবা ইটালির রিভায় কাঠ খোদাই-এর স্কুল এই প্রবণতার উৎকৃষ্ট নিদর্শন৷
দেশ থেকে দেশে ছড়াচ্ছে এই প্রবণতা৷ সুইজারল্যান্ডের দক্ষিণ টিরোল এলাকার মানুষেরা অলিভ কাঠ দিয়ে রান্না করতেন৷ পরে প্রতিবেশী ইটালির দেখাদেখি তারা অলিভ কাঠ কুঁদে নানা ধরনের জিনিসপত্র বানাতে শিখলেন – যার আজ বিশ্বজোড়া চাহিদা৷
শহর কলকাতায় শীত মানেই মেলার মরশুম৷ যার শুরু হয় হস্তশিল্প মেলা দিয়ে৷ সারা পশ্চিমবঙ্গ থেকে নানা ধরন এবং আঙ্গিকের হস্তশিল্পের পশরা নিয়ে আসেন শিল্পীরা৷ এক চত্বরে ধরা পড়ে বাংলার সাংস্কৃতিক বিভিন্নতা এবং উৎকর্ষের চেহারা৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyayবাংলার হস্ত শিল্প মানেই বাঁকুড়ার পোড়ামাটির ঘোড়া, হাতি, মনসার পট৷ আজকাল আধুনিক শিল্পভাবনাও দেখা যায় এই সৃষ্টিতে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyayপ্রথম দর্শনে আফ্রিকা মহাদেশের কাঠখোদাই শিল্পের বিভ্রম তৈরি হতে পারে, কিন্তু এই দারুশিল্পও আদতে বাংলারই আরেক শিল্পরীতির নমুনা৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyayশুধু ঘর সাজানোর সামগ্রী নয়, টেরাকোটা শিল্পীরা এখন তৈরি করছেন গেরস্থালির নানা সরঞ্জাম৷ চায়ের কাপ-প্লেট, মোমবাতিদান, গয়নার কৌটো৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyayযাঁরা ভাবেন হস্তশিল্পে আধুনিক প্রজন্মের উৎসাহ নেই, তাঁরা ভুল ভাবেন৷ হস্তশিল্প মেলার ক্রেতাদের এক বড় অংশ কিন্তু নবীন প্রজন্ম৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyayহস্তশিল্প মেলার পশরার একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে হাতে বোনা মাদুর, নকশা করা কাপড়ের আসন, যা নিত্য ব্যবহারের কাজে লাগে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyayহাতে বোনা কার্পেটের আসন ছাড়াও এখন ক্রেতাদের আকর্ষণ করে দেওয়াল চিত্র, যা অনুপম সূচিশিল্পের সেরা নমুনা৷ এসবের বিক্রি বেশ ওপরের দিকে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyayনকল হলেও প্রকৃতির সমস্ত রঙ, রূপ আর উচ্ছ্বাস ধরা পড়ে এই ফুলের সম্ভারে৷ উপকরণ হলো বাংলার চিরন্তন শোলা এবং শুকনো খেজুরপাতা৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyayপণ্যের বস্তা, থলে ইত্যাদিতে পাটের ব্যবহার আজ আর প্রায় নেই৷ পাটশিল্প যেটুকু টিকে আছে, তা এই বাহারি ব্যাগ, বটুয়া, টেবিলম্যাট আর টুপিতে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyayকাঠ আর বেতের কাজ মানেই উত্তরবঙ্গ৷ দৃষ্টিনন্দন কাঠখোদাই ভাস্কর্য থেকে বেতের বাতিদান, বাঁশের কোঁড় দিয়ে তৈরি চায়ের কাপ, পানীয়ের গেলাস, এক বিপুল সম্ভার৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyayচিরকালীন চুবড়ি, ধামা, কুলো৷ কিন্তু ক্রেতার মন পেতে তাতেও লেগেছে রঙের ছোঁয়া৷ এর কারিগররা আসেন মূলত দক্ষিণবঙ্গ থেকে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyayবাংলায় পটের আঁকা আছে, আর পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বা আরও পশ্চিমে আছে রঙবাহারি নকশা করা কেটলি৷ দুইয়ের মিলমিশ ঘটেছে দিব্যি৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyayএই একটি ব্যাপারে এখনও মেয়েরাই এগিয়ে৷ অলঙ্করণ থেকে শুরু করে হস্তশিল্পের সব কাজেই এখনও মহিলা শিল্পীদেরই কদর বেশি৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay এ বিষয়ে আপনার মতামত লিখুন নীচে, মন্তব্যের ঘরে৷