একটা অভিযোগ প্রায়ই চোখে পড়ে, ইউরোপে ধর্ম পালন করা কঠিন৷ এখানে মুসলিম ও ইহুদিরা সবচেয়ে বেশি সংকটে৷ ঠিক ধর্ম পালনে নয়, কিছু কিছু ধর্মীয় নিয়ম পালনে কোথাও কোথাও বিধিনিষেধ থাকলেও, সার্বিকভাবে উলটো চিত্রই চোখে পড়ে৷
বিজ্ঞাপন
এবার এক ভিন্ন প্যারিস দেখে এলাম৷ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহ করাই ছিল এবারকার রথ দেখার উদ্দেশ্য৷ সঙ্গে কলা তো বেঁচতেই হবে৷ একটুখানি আইফেল না হলে কি হয়? কিংবা সিইন নদীর কুলকুল করা স্রোত লুভ মিউজিয়ামের দেয়ালের পলেস্তারা কতটা খসালো, সেসব দেখেই বনে ফিরেছি৷ বন মানে জার্মানির বন শহর৷ জঙ্গল ভেবে ভুল করবেন না যেন!
যাই হোক, আসল কথায় ফিরি৷ মধ্যপন্থি এমানুয়েল মাক্রোঁ আর অতিডানপন্থি ল পেনের লড়াই, অতি বামপন্থার প্রতি তরুণ অভিবাসী প্রজন্মের ভরসা, ধর্মীয় আচরণে কর্তৃপক্ষের প্রভাব, আর নির্বাচনের হিসেব নিকেষে এসব কতটা ফ্যাক্টর- এগুলো একটু খতিয়ে দেখতে প্যারিসের বিভিন্ন জেলার পথ যেমন মাড়িয়েছি, তেমনি সফরের সিংহভাগ কেটেছে অভিবাসীপ্রধান এলাকাগুলোতে৷
যেমন, প্যারিসের সেন্ট্রাল স্টেশন গার দ্যু নর্দের পাশেই ১০ নম্বর সাবডিভিশন৷ সেখানে গেলে চোখে পড়বে সারি সারি দোকান, খাবারের হোটেল কিংবা ছোট ছোট ব্যবসা৷ কোনোটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের৷ কোনোটি মোবাইলের দোকান৷ দেখলে মনে হবে হাতিরপুল বা এলিফ্যান্ট রোডে এসে পড়েছেন৷ হাঁটতে গেলে বাংলা কথা শুনবেন৷ চোখে পড়বে বাংলা লেখা সাইনবোর্ডও৷ অনেকগুলো মানি এক্সচেঞ্জের দোকানও রয়েছে এখানে৷ কারণ, এসব এলাকায় অভিবাসীর সংখ্যাই বেশি৷ বিশেষ করে অনেক বাংলাদেশির ব্যবসা গড়ে উঠেছে এখানে৷ আমাদের এখানে আসার উদ্দেশ্য, প্যারিসে অভিবাসীরা কেমন আছেন? বাংলাদেশিরা কেমন আছেন? মুসলিমসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ কেমন আছেন, তা স্বচক্ষে দেখা৷
ইউরোপের ধর্মের রূপ
ইউরোপ কতটা অসাম্প্রদায়িক? কোন দিকে বেশি ঝুঁকছে ইউরোপের মানুষ? ধর্ম নিয়ে রাষ্ট্রের অবস্থান কী? সাম্প্রদায়িকতা বা সম্প্রীতি কতটা? ছবিঘরে থাকছে এমন সব প্রশ্নের উত্তর৷
ছবি: René Arnold/House of One
কোন ধর্মের কত মানুষ
পিউ রিসার্চের ২০১৫ সালের এক জরিপ অনুযায়ী ইউরোপে সাড়ে ৭৪ শতাংশ জনগোষ্ঠী খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী৷ তারপর থাকা সবচেয়ে বেশি জনগোষ্ঠী ১৮ দশমিক ৮ শতাংশের কোনো ধর্ম নেই৷ তৃতীয় অবস্থানে থাকা মুসলিমরা প্রায় ছয় শতাংশ। এছাড়াও ইহুদি, হিন্দু, বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মের জনগোষ্ঠী এক শতাংশের কম করে৷
ছবি: Robert Harding/picture alliance
‘ধর্মহীন’ মানুষ
পিউ রিসার্চের ২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী, পশ্চিম ইউরোপের অনেক দেশেই অর্ধেকের বেশি মানুষ ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন৷ তবে বেছে নিতে হলে কোনটি বেছে নেবেন- এমন প্রশ্নে জার্মানির ৭১ শতাংশ ও ফ্রান্সের ৬৪ শতাংশ খ্রিস্ট ধর্মের কথা বলেছেন৷ আরেক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৫০ সাল নাগাদ এই অঞ্চলে খিস্টান ৬৫ শতাংশ, ‘ধর্মহীন’ ২৩ দশমিক তিন শতাংশ ও মুসলিমদের হার হবে ১০ দশমিক দুই শতাংশ৷ বাকিদের হার অনেকটা অপরিবর্তিতই থাকবে৷
ছবি: Diogo Baptista/ZUMAPRESS/picture alliance
রাষ্ট্র ও ধর্ম
পিউ রিসার্চের ২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী,পশ্চিম ইউরোপের বেশিরভাগ মানুষ সরকারি নীতি থেকে ধর্মকে দূরে রাখার পক্ষপাতী৷ সুইডেনে ৯০ শতাংশ, বেলজিয়ামে ৭২ শতাংশ মানুষই এমনটা মনে করেন৷ অন্যদিকে সুইজারল্যান্ডের ৪৫ ভাগ আর যুক্তরাজ্যের ৩৮ ভাগ মনে করেন সরকারের নীতিতে ধর্মকে সমর্থন দেয়া উচিত৷ ফ্রান্স, জার্মানিসহ ইইউভুক্ত বেশিরভাগ দেশে অসাম্প্রদায়িকতা এবং নাগরিকদের স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনের সাংবিধানিক স্বীকৃতি আছে৷
ছবি: Sebastian Gollnow/dpa/picture alliance
ধর্ম পালনে সমস্যা
পিউ রিসার্চের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ধর্ম পালনে সরকারের হয়রানিতে মধ্যপ্রাচ্য-উত্তর আফ্রিকার পরই রয়েছে ইউরোপ৷ এই অঞ্চলে ৯৮ শতাংশ দেশে ধর্মীয় গোষ্ঠীর উপর এবং ৯১ শতাংশ দেশে উপাসনায় হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে৷ বিভিন্ন আইনের কারণে ধর্মবিধি পালনে মানুষ সমস্যায় পড়েন৷ যেমন, স্লোভেনিয়ায় অচেতন ছাড়া প্রাণী হত্যা নিষিদ্ধ করায় মুসলিম ও ইহুদিরদের হালাল ও কোশার বিধি মানা কঠিন হয়ে পড়ে৷
ছবি: Mesut Zeyrek/AA/picture alliance
পোশাক ও প্রতীক
অনেক দেশেই জনসমক্ষে বা কর্মক্ষেত্রে ধর্মীয় পোশাকে নিষেধাজ্ঞা আছে৷ যেমন, অস্ট্রিয়ায় জনসমক্ষে মুখমণ্ডল আবৃত রাখা এবং স্কুলে ১০ বছরের কম বয়সিদের স্কার্ফ পরা নিষেধ৷ ফ্রান্সে জনসেবা প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের স্কার্ফ, টুপি, পাগড়ি বা ক্রস পরিধান নিষিদ্ধ৷ ২০১৫ সালে জার্মানির আদালত বিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের স্কার্ফ পরা নিষিদ্ধ করলেও তা বাস্তবায়ন রাজ্যগুলোর উপর ছেড়ে দিয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Johnson
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা
২০১৯ সালে ইউরোপে ১৭টি দেশে ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে সরকার, আগের বছর এমন দেশের সংখ্যা ছিল ১৯৷ এক্ষেত্রে সবার উপরে ছিল রাশিয়া৷ গত বছরের নভেম্বরে ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ধর্মীয় উগ্রবাদের অভিযোগে ২০১৭ সাল থেকে ৪৩টি মসজিদ বন্ধ করেছে ফ্রান্স৷ কোভিড-১৯-এর বিধিনিষেধের কারণে ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে দেশটির ক্যাথলিক চার্চ কর্তৃপক্ষ৷
ছবি: Ait Adjedjou Karim/Avenir Pictures/ABACA/dpa/picture alliance
উগ্রবাদ ও অসহিষ্ণুতা
সাম্প্রতিক বছরে ইউরোপের দেশে দেশে উগ্রবাদের বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে৷ ২০২০ সালে ফ্রান্সে জঙ্গিবাদ সমর্থক এক মুসলিম তরুণ এক কলেজ শিক্ষককে হত্যা করেন৷ তার আগে টিউনিসিয়ার এক অভিবাসী চার্চের ভিতরে তিন খ্রিস্টানকে হত্যা করেন৷ ২০১৯ সালে জার্মানিতে সিনাগগে হামলায় মারা যান দুইজন৷ সম্প্রতি সুইডেনে উগ্র ডানপন্থি দলের নেতা রাসমুস পালুদান সুইডেনে পবিত্র কোরানের কপি পোড়ানোর ঘোষণা দিলে ক্ষুব্ধ হন দেশটির মুসলিমরা৷
ছবি: Alain Jocard/AFP/Getty Images
সম্প্রীতির বার্তা
উগ্রতা আর সাম্প্রদায়িকতার বাইরে ইউরোপে সম্প্রীতির অনেক উদাহরণ আছে৷ ইহুদি এবং মুসলমানদের একত্রিত করতে জার্মানির মারবুর্গ শহরে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করেছেন দুই সম্প্রদায়ের মানুষ৷ বার্লিনে মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের এক ছাদের নীচে প্রার্থনার জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে ‘হাউস অব ওয়ান’৷ সম্প্রতি জার্মানির বুন্ডেসলিগার ম্যাচ চলার সময় এক ফুটবলারের ইফতারের জন্য কিছুক্ষণ খেলা বন্ধ রাখা হয় - যা আগে কখনও হয়নি৷
ছবি: Frank Senftleben/epd-bild
8 ছবি1 | 8
যা দেখলাম, প্রথমত, নানা টানাপোড়েনের মাঝেও প্যারিসের বাংলাদেশিরা ভালো আছেন৷ তারা যখন ফ্রান্সে আসছেন, অনেক পয়সা খরচ করে নিয়মিত বা অনিয়মিত উপায়ে, তখন শুরুতে বেশ কষ্ট করছেন৷ কিন্তু এখানে একটা কমিউনিটি গড়ে উঠেছে৷ সেই কমিউনিটির কারো কারো সহযোগিতায়ই হোক, ব্যবসায়িক স্বার্থেই হোক, তাদের অনেকেই পরের দিকে বেশ ভালো করছেন৷ অনেক উদাহরণ দিতে পারব৷ কিন্তু সেসবে এখন যাচ্ছি না৷
বরং দেখা যাক, ধর্মের কল এখানে কে নাড়ায়? সরকার? শহর কর্তৃপক্ষ? নাকি যার যার ধর্মীয় কমিউনিটি? আমার অভিজ্ঞতা হলো, বাইরে থেকে অনেক কথা শোনা গেলেও প্যারিসের মুসলিম কিংবা অন্য ধর্মের মানুষেরা অনেক স্বাধীনতা নিয়েই ধর্মচর্চা করতে পারেন৷ যেমন, প্যারিসের স্তাঁ জেলার একটি বাংলাদেশি মুসলিম কালচারাল সেন্টারে যাবার অভিজ্ঞতা হলো৷ দোতলা একটা বাড়ি৷ সামনে লেখা, ‘বাংলাদেশ কমিউনিটি মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টার’৷ বিশাল কাঠের দরজা, কারুকার্য করা৷ নীচতলায় একাধিক ক্লাসরুম৷ সেখানে বাংলাদেশিসহ অন্যান্য আরব দেশের শিশুরা ইসলাম বিষয়ে পাঠ নিচ্ছে৷ মসজিদের ইমাম নিজে পড়াচ্ছেন শিশুদের৷
কথা হচ্ছিল এই কালচারাল সেন্টারের সভাপতি সেরাজুল ইসলাম সালাউদ্দিনের সঙ্গে৷ তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, ধর্ম পালন করা কিংবা এমন একটা কালচারাল সেন্টার ও মসজিদ পরিচালনা করতে গিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো নিয়ম কানুন চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে কি না? তিনি বললেন, যেহেতু এই সেন্টারে শিক্ষা নেয়া শিশুর সংখ্যা কয়েকশত ছাড়িয়ে গেছে, এবং দিন দিন সংখ্যা বাড়ছে, তাই সরকার বলেছে, কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ইমারজেন্সি সিঁড়ি কিংবা শারীরিক প্রতিবন্ধীবান্ধব কিছু অবকাঠামোগত পরিবর্তন করা দরকার৷ সেটি তারা করেছেন৷ এর বাইরে ইমাম নিয়োগের সময় সরকার কিছু প্রশিক্ষণের কথা বলছে৷ তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি৷ এই প্রশিক্ষণ মূলত ইমামরা যখন আরব দেশ বা বাংলাদেশ থেকে এখানে সরাসরি আসেন, তখন এখানকার যে নিয়মকানুন সম্পর্কে না জেনে যেন কথা না বলেন, সেজন্য তাদের সেসব বিষয় অবহিত করা৷ অন্য কিছু নয়৷ এখানে যার যার ধর্ম পালনের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আছে বলে মনে করেন তিনি৷
সভাপতির এসব কথা যেমন সত্য, তেমনি এটিও সত্য যে, এখানকার দক্ষিণপন্থি রাজনীতিতে অভিবাসন ও ধর্মবিদ্বেষ একটা ইস্যু হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে৷ তবে এখনও এটি অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান কিংবা পেনশন-এসব বিষয়ের মত অত বড় বিষয় নয়৷ এমনটিই বলছিলেন আজেদিন তাইবি৷ তিনি প্যারিসের স্তাঁ শহরের মেয়র৷ আলজেরীয় বংশোদ্ভূত৷ তিনি বললেন, শহরের বাইরে কিছু কিছু পকেট আছে, যেখানে ধর্মবিদ্বেষের ইস্যুটিকে কাজে লাগিয়ে ভোট বাগানোর চেষ্টা করেন অনেকে৷ কিন্তু সার্বিকভাবে এটা মোটেই ফ্রান্সের রাজনীতির মূল ইস্যুগুলোর মধ্যে পড়ে না৷
বাংলাদেশিদের অনেকেই বললেন, এখানে যেমন মুসলিম বা ইহুদিবিদ্বেষের ঘটনা ঘটে না, তা নয়৷ আবার মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের মধ্য থেকেও সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়েছে৷ ২০১৫ সালের প্যারিস, ২০২০ সালে স্যামুয়েল প্যাটিকে হত্যা কিংবা নিসের হামলার ঘটনাও ঘটেছে৷ তাদের ভয়, উভয়দিকের এসব ঘটনা সার্বিকভাবে সবার সহাবস্থানকে হয়তো ভবিষ্যতে কঠিন করে তুলবে৷ বিশেষ করে সাধারণ অভিবাসীদের জন্য৷ তবে এখনই তেমন অবস্থা তৈরি হয়নি বলেও বলছেন তারা৷ বরং যেসব এলাকায় মুসলিমদের সংখ্যা বাড়ছে, সেখানে মসজিদও তৈরি হচ্ছে৷ সরকার সন্ত্রাসবিরোধী কিছু নিয়ম কানুন কড়াকড়ি করেছে বটে, এবং তা নিয়ে সবাই খুশিও নয়৷ কিন্তু একইসঙ্গে এটাও সত্য, এদেশের নিয়ম কানুন, সংস্কৃতি ও ভাষা এসব সম্পর্কেও সম্যক জ্ঞান থাকা জরুরি, যা অনেক অভিবাসীই অনুসরণ করতে চান না৷
এমনকি জার্মানির কথাও বলতে পারি৷ এখানে কারো ধর্ম, বর্ণের ওপর আঘাতকে বড় অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়৷ এখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে সবার ধর্ম পালনের অধিকার সংরক্ষিত৷ এখন কিছু মানুষ অন্য ধর্ম বা বর্ণের মানুষের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করছেন, এটিও যেমন সত্য, তেমনি রাষ্ট্র সবার মত ও বিশ্বাস পালনের অধিকার সংরক্ষণ করার জন্য আইন রেখেছে এবং তার প্রয়োগও করছে৷
ইউরোপে অন্তত যার যার ধর্ম তার তার কাছে, এমন নীতিতে বিশ্বাসীদের সংখ্যা অনেক বেশি বলেই মনে হয়৷ সংঘাত যা দেখি, তা সাংস্কৃতিক৷ এখানকার পোশাক, ভাষা ও সাংস্কৃতিক আচার আরব কিংবা দক্ষিণ এশীয় সংস্কৃতি, তা ধর্মীয় হোক বা সামাজিক, তা থেকে আলাদা৷ মূলত সমস্যা হয়, যখন একের সংস্কৃতি অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়৷ যদি সবাই খোলা মনে একে অন্যের ভাষা, আচার সম্পর্কে জানেন এবং শ্রদ্ধা করেন, তাহলে আমার সাদা চোখে কোনো সংকট আর ধরা পড়ে না৷
দেড় বছরে ২২টি মসজিদ বন্ধ করেছে ফ্রান্স
ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসেব বলছে, গত ১৮ মাসে ২২টি মসজিদ বন্ধ করা হয়েছে৷ তবে যে ক্ষমতাবলে এসব বন্ধ করা হয়েছে তার সমালোচনা করেছেন জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মীরা৷
ছবি: Stephane Mahe/REUTERS
১৮ মাসে ২২ মসজিদ
ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসেব বলছে, গত ১৮ মাসে ২২টি মসজিদ বন্ধ করা হয়েছে৷ এই সংখ্যা তার আগের তিন বছরে মোট মসজিদ বন্ধের তুলনায় অনেক বেশি বলে রয়টার্সকে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা৷ উপরের ছবিতে এক ব্যক্তিকে তার কম্পিউটারে বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি মসজিদ দেখাতে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Stephane Mahe/REUTERS
৯০ মসজিদে তদন্ত
ফ্রান্সে প্রায় আড়াই হাজার মসজিদ রয়েছে৷ এর মধ্যে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ মতাদর্শ প্রচার সন্দেহে ৯০টি মসজিদে তদন্ত চালানো হয়েছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে৷
ছবি: Vanessa Meyer/dpa/picture alliance
মুসলিমদের জন্য বৈরী হয়ে উঠছে ফ্রান্স
ইউরোপে সবচেয়ে বেশি মুসলমান বাস করেন এমন দেশগুলোর মধ্যে একটি ফ্রান্স৷ কিন্তু সেখানকার মুসলমানরা বলছেন, দেশটি ক্রমে মুসলমানদের জন্য বৈরী হয়ে উঠছে৷ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসেব বলছে, ২০২১ সালে মুসলিমবিরোধী বৈষম্যমূলক আচরণ বেড়েছে৷ আর অন্যান্য ধর্মের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা কমেছে৷
ছবি: Alain Pitton/NurPhoto/picture alliance
বন্ধ হয়ে যাওয়া আলন মসজিদ
ফ্রান্সের উত্তরপশ্চিমের আলন শহরের এই মসজিদটি গত অক্টোবরে বন্ধ করে দেয়া হয়৷ ছবিতে মসজিদের দরজায় বন্ধের নোটিশ দেখা যাচ্ছে৷ ‘ইসলামের মৌলবাদী রূপ’ প্রচার ও ‘ফ্রান্সের প্রতি ঘৃণার অনুভব চাষ’ করার অভিযোগ এনে মসজিদটি বন্ধ করা হয়৷ কিন্তু মসজিদের কর্মকর্তারা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, সরকার তার অভিযোগের সমর্থনে খুব কম প্রমাণ উপস্থাপন করেছে৷
ছবি: Stephane Mahe/REUTERS
রয়টার্সের বিশ্লেষণ
মসজিদ বন্ধ করার প্রমাণ হিসেবে সরকারের পক্ষে থেকে ২০ পাতার একটি নথি (যেটি ‘হোয়াইট মেমো’ নামে পরিচিত) আদালতে উপস্থাপন করা হয়৷ সেটি রয়টার্স বিশ্লেষণ করে বলছে, নথিটি কবে তৈরি হয়েছে, কে করেছে এবং তথ্য কোথা থেকে পাওয়া গেছে তার কোনো উল্লেখ নেই৷
ছবি: Vanessa Meyer/dpa/picture alliance
চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ
হোয়াইট মেমোতে আলন মসজিদের চারজনের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর ও ২০২১ সালের এপ্রিলে সংঘটিত দুটি সন্ত্রাসী হামলায় সমর্থন প্রকাশের অভিযোগ আনা হয়৷ এদের একজন করিম দাউদ (ছবি) স্থানীয় সরকারি অফিসে কাজ করেন৷ ২০২১ সালের অক্টোবরে তাকে সরকারি কর্মচারী হিসেব তার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পদক দেয়া হয়েছিল৷ ২০২০ সালে সন্ত্রাসী হামলার পর তিনি গির্জায় গিয়ে সংহতিও প্রকাশ করেছিলেন৷
ছবি: Stephane Mahe/REUTERS
পাঁচটি বই উদ্ধার
হোয়াইট মেমোতে মসজিদ থেকে পাঁচটি বই উদ্ধারের কথা বলা হয়েছে৷ এগুলোকে ‘মৌলবাদী’ বই বলে চিহ্নিত করা হয়েছে৷ অথচ এর মধ্যে চারটি বই বিশেষায়িত বইয়ের দোকান এবং অনলাইনে অনেক পাওয়া যায় বলে জানিয়েছেন লিল ইন্সটিটিউট অফ পলিটিক্যাল স্টাডিজের ইসলামিক স্টাডিজের শিক্ষক দাউদ রিফি৷ অন্য বইয়ের নাম ‘রিয়াদ আস-সালিহিন’৷ ১৩ শতকের এই বইটি ফ্রান্সের জাতীয় গ্রন্থাগারে রাখা আছে৷
ছবি: Fadel Senna/AFP/Getty Images
জিহাদের ডাক দেয়ার অভিযোগ
হোয়াইট মেমোতে আরও অভিযোগ করা হয়, আলন মসজিদের ধর্মপ্রচারকরা সশস্ত্র জিহাদের প্রশংসা করেছেন ও মুসল্লিরা সহিংসতার ডাক দিচ্ছেন বলে শোনা গেছে (যদিও কারা শুনেছেন তাদের পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি)৷ এ ব্যাপারে করিম দাউদ বলছেন, সরকার ‘জিহাদ’ শব্দটির ভুল ব্যাখ্যা করেছে৷ জিহাদের অর্থ সশস্ত্র সংঘাত হতে পারে৷ আবার ‘জিহাদ আল-আকবর’ বোঝাতে প্রায়ই এটি ব্যবহার করা হয়, যার অর্থ, নফস বা নিজ আত্মা পরিশুদ্ধ করার সংগ্রাম৷
ছবি: Stephane Mahe/REUTERS
সমালোচনা
অধিকার কর্মী, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন ও মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যদের অভিযোগ, ফ্রান্সে ধর্মীয় স্থান বন্ধের জন্য কর্তৃপক্ষকে এত ক্ষমতা দেয়া হয়েছে যে, যথাযথ পরীক্ষা না করেই মসজিদ বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে৷ এছাড়া অস্পষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করায় ও পর্যাপ্ত প্রমাণ না দেয়ায় মামলা পরিচালনা করা অনেকক্ষেত্রে সম্ভব হচ্ছে না৷
ছবি: Getty Images/AFP/I. Gaizka
সরকারের জবাব
এলিসি প্রাসাদ রয়টার্সের এই বিশেষ প্রতিবেদন নিয়ে মন্তব্য করতে চায়নি৷ তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসলামি সন্ত্রাসবাদ ঠেকাতে সরকার কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা বাড়িয়েছে এবং ‘আইনের প্রতি পূর্ণ সম্মান রেখে’ তা করা হয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/I. Gaizka
অস্থায়ীভাবে বন্ধ
যে আইনে মসজিদ বন্ধ করা হয় তাতে কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ ছয় মাসের জন্য মসজিদ বন্ধ করতে পারে৷ তবে অধিকার কর্মী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসেবে দেখা গেছে, অনেক মসজিদই আর কখনও খোলা হয় না৷ বন্ধ হওয়া ২২টি মসজিদের মধ্যে কতটি আবার খুলেছে সে হিসাব মন্ত্রণালয় জানায়নি৷