নাস্তিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা – এই দুই শব্দ নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে৷ একজন নাস্তিক আসলে কে? ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে কি বোঝায়? দুটি বিষয় যে একে অপরের চেয়ে একেবারে আলাদা, সেটা সবাইকে বুঝতে হবে, মনে করেন ডিডাব্লিউ-র গ্রেহেম লুকাস৷
বিজ্ঞাপন
বিশ্বের অনেক মানুষই ধর্মপ্রাণ৷ তাঁরা ইসলাম, খ্রিষ্টান কিংবা বৌদ্ধের মতো ধর্মে বিশ্বাসী৷ হয়ত তাঁরা খ্রিষ্টান কিংবা ইসলাম ধর্মে থাকা নানান মতবাদে বিশ্বাসী৷ তাঁরা হয়ত হাজার বছর আগে লেখা ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে জীবনযাপন করতে পছন্দ করে৷ এটি তাঁদের পছন্দ এবং এমনটিই হওয়া উচিত৷ কারণ জাতিসংঘ প্রতিটি মানুষকেই যার যার ধর্ম বা বিশ্বাস বেছে নেয়ার অধিকার দিয়েছে৷
কিন্তু এর বাইরেও বিশ্বে এমন অনেক মানুষ আছেন যাদের ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ রয়েছে৷ তাঁরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না৷ তাঁরা নাস্তিক৷ ‘অ্যাগনস্টিক' তথা অজ্ঞেয়বাদীরা আরেকটু অন্যরকম৷ তাঁরা ঈশ্বরে বিশ্বাসও করেন না আবার অবিশ্বাসও করেন না৷ তাঁদের মতে, ঈশ্বর আছে, কি নেই সে রকম কোনো প্রমাণ নেই৷
ধর্মবিশ্বাস, ধর্মান্তর এবং ধর্মের স্বাধীনতা
ডেভিড স্ট্যাং খ্রিষ্টান থেকে মুসলমান হয়েছেন৷ তবে তিনি সালাফিস্টদের উগ্রতা এড়িয়ে চলেন৷ জার্মানিতে অনেকেই মনে করেন, মানবাধিকারগুলোর মধ্যে ধর্মের স্বাধীনতাটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ৷এসব নিয়েই আজকের ছবিঘর৷
ছবি: picture-alliance/dpa
কৌতূহল
ডেভিড স্ট্যাংয়ের কৈশোর থেকেই ধর্মের প্রতি বেশ অনুরাগ৷ নিয়মিত গির্জায় যেতেন, বাইবেল পড়তেন৷ তখন সবকিছু বুঝতে পারতেন না৷ অনেক প্রশ্ন জাগতো৷ কিন্তু উত্তর জানা হতো না৷ এখনো মনে আছে, দম্পতিদের নিয়ে একটা প্রশ্ন জেগেছিল, কিন্তু গির্জার পাদ্রী সে প্রশ্নের উত্তর তাঁকে বলেননি৷
ছবি: DW/K. Dahmann
হতাশা এবং মুসলমান হওয়া
একসময় ক্যাথলিক চার্চ, অর্থাৎ ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের গির্জা সম্পর্কে কেমন যেন হতাশ হয়ে পড়লেন ডেভিড স্ট্যাং৷ অন্য ধর্ম সম্পর্কে জানার চেষ্টা শুরু করলেন৷ এক মুসলিম আইনজীবীর সঙ্গে পরিচয় হলো৷ তিনি বললেন, ‘‘ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করো৷’’ তাঁর কথা মেনে একসময় সত্যিই মুসলমান হয়েছেন এবং সেই সুবাদে সবকিছুর নতুন মানেও খুঁজে পেয়েছেন স্ট্যাং৷
ছবি: DW/K. Dahmann
ধর্ম চর্চার দীর্ঘ প্রক্রিয়া
ডেভিড স্ট্যাং মনে করেন, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার মানে হলো, নতুন করে অনেক কিছু শেখা৷ তিনি জানতেন, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে মদ্যপান করা এবং শূকরের মাংস খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে৷ রাখতে হবে দাড়ি৷ যিনি তাঁকে মুসলমান হতে বলেছিলেন, তিনি এ-ও বলেছিলেন যে, মুসলিম হওয়ার অনুভূতিটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তাই প্রক্রিয়াটাও অত্যন্ত দীর্ঘ৷
ছবি: DW/K. Dahmann
বিশ্বাসে আপোশ
কাজের সূত্রে ডেভিড স্ট্যাংকে প্রতিদিন হানোফার-বন যাওয়া-আসা করতে হতো৷ দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া সব সময় হয়ে উঠতো না৷ তাই সকাল আর সন্ধ্যার নামাজের সময়টা বাড়িয়ে নিয়েছিলেন৷ তিনি মনে করেন, জীবনের সঙ্গে বিশ্বাসের মেলবন্ধন ঘটানোটাই আসল৷
ছবি: DW/K. Dahmann
উগ্রতা পরিহার
২০১২ সালে উগ্র সালাফিস্টদের সহিংসতা দেখেছেন ডেভিড৷ তারা যেভাবে সন্ত্রাসবাদের পক্ষে যুক্ত দেখায়, তা মানতে পারেননি তিনি৷ সন্ত্রাসবাদীদের মতো ভয় দেখাতে তারা গলার কাছে বোমাও ঠেকায়৷ সালাফিস্ট সম্পর্কে তাঁর একটাই কথা, ‘‘আমি এমন কিছুর সঙ্গে থাকতে চাইনা৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa
ক্যাথলিক চার্চ ছাড়লেন উটে
উটে লাস-এর জন্ম ক্যাথলিক পরিবারে৷ ধর্মতত্ব নিয়ে পড়াশোনা করতে আগ্রহী ছিলেন৷ কিন্তু ধর্মতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করতে গেলে কিছু সমস্যাও যে হবে তা তিনি বুঝতেন৷ উটে বুঝতেন, ‘‘ক্যাথলিক থাকলে ধর্মতাত্ত্বিক হয়েও তেমন কিছু করতে পারবো না৷’’ এ সব ভেবে চার্চে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন উটে৷
ছবি: DW/K. Dahmann
অন্তর্দ্বন্দ্ব...
উটের স্বামী প্রটেস্ট্যান্ট হলেন৷ ফলে এবার প্রটেস্ট্যান্টদের গির্জায় যাওয়ার সুযোগ পেলেন উটে৷ তাঁর ছেলেটা সমবয়সিদের সঙ্গে খেলতো৷ ওরও চার্চে যাওয়ার ইচ্ছা৷ কয়্যারে যোগ দিতে চায় সে৷ এ সব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পাঁচ বছর সময় নিয়েছিলেন উটে৷ নারী যাজক আনেগ্রেট কোহেন (বাঁ দিকে) এবং নিনা গুটমান (মাঝে) উটের এ সব অন্তর্দ্বন্দ্ব সমাধানে সহায়তা করেছিলেন৷
ছবি: DW/K. Dahmann
সহনশীলতা
ব্যাপারটিকে উটের বন্ধুরাও খুব ভালোভাবেই নিয়েছিলেন৷ বন্ধুদের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পেয়ে দীক্ষা নিয়ে চার্চে যাওয়া শুরু করলেন উটে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
গির্জায় ভিড় কমছে
কয়েক বছর ধরে জার্মানিতে লোকজনের গির্জায় যাওয়ার প্রবণতা কমছে৷ গির্জার সদস্য বাড়াতে নেয়া হচ্ছে বিশেষ উদ্যোগ৷ বন শহরের ক্যাথলিক তথ্যকেন্দ্র ফিডেস-এ ধর্মের বিষয়ে সবাইকে আগ্রহী করে তোলার কাজটি করেন যাজক টোমাস ব্যার্নার্ড (ডানে)৷
ছবি: DW/K. Dahmann
কারণ কেলেঙ্কারি?
গির্জায় আর আগের মতো বেশি মানুষ আসছে না কেন? অনেকে মনে করেন, সাম্প্রতিক কালে পাদ্রিদের যৌন কেলেঙ্কারিতে জড়ানোর খবর এক্ষেত্রে বেশ প্রভাব বিস্তার করেছে৷ যাজক টোমাস ব্যার্নার্ডও এ সম্পর্কে কিছুটা একমত৷ তিনি মনে করেন, এসব খবর বেশি প্রচার করে মিডিয়া বেশ ক্ষতি করেছে৷
ছবি: DW/K. Dahmann
ধর্মের স্বাধীনতা
ধর্মান্তরিত হয়েছেন, এমন অনেকেই মিউনিখ শহরের একটা প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছিলেন৷ প্রদর্শনীতে মানবাধিকারের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মের স্বাধীনতার কথাও প্রচার করা হয়৷
ছবি: Jüdisches Museum München 2013
11 ছবি1 | 11
ইউরোপের মতো দেশগুলোতে ধর্মীয় বিশ্বাসকে ব্যক্তিগত বিষয় বলে মনে করা হয়৷ ইউরোপীয়রা নাস্তিকতা কিংবা অজ্ঞেয়বাদকে মত প্রকাশের স্বাধীনতার অংশ বলে মনে করে৷ অন্যের বিশ্বাসকে সমালোচনা করা আমার কাজ নয়৷
ইউরোপের ইতিহাসে ‘এনলাইটেনমেন্ট' (১৬২০ থেকে ১৭৮০) যুগের সময় সমাজে ধর্মের ভূমিকা নিয়ে চ্যালেঞ্জ ছোড়া হয়৷ তখন থেকেই নাস্তিকতা ও অজ্ঞেয়বাদ মতবাদের প্রসার ঘটতে থাকে৷ পরবর্তীতে ১৮ ও ১৯ শতকের সময় যখন শিল্পায়ন শুরু হয় তখন থেকে মানুষের মধ্যে ধর্মীয় বিশ্বাস ও ধর্ম পালনের হার কমতে থাকে৷
ধর্মনিরপেক্ষতা মানে হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো ধর্মের প্রভাব থাকবে না এবং রাষ্ট্রের কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে ধর্মীয় নেতারা হস্তক্ষেপ করবে না৷ প্রায় দেড়শো বছর আগে যখন শিল্পায়নের প্রসার ঘটে তখন থেকেই মূলত সেক্যুলারিজমের শুরু৷ ব্রিটিশ লেখক জর্জ জ্যাকব হোলিওক ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি প্রথমবারের মতো সেকুলারিজম শব্দটি ব্যবহার করেন৷ তিনি লিখেছিলেন, ‘‘সেকুলারিজম এটা বলে না যে, অন্য কোথাও আলো কিংবা পথনির্দেশনা নেই, তবে এটা বলে যে, ধর্ম নিরপেক্ষ বিশ্বাসে আলো ও পথনির্দেশনা আছে৷'' জার্মান দার্শনিক ফ্রিডরিশ নিৎশে ঊনিশ শতকের শেষ দিকে খ্রিষ্টান ধর্ম পালনের হার কমে যাওয়াকে ‘ঈশ্বর মরে গেছে' বলে অভিহিত করেছিলেন৷
গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় আধুনিকতার ছোঁয়া আনতে এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির বাধা পেরিয়ে পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে বিংশ শতাব্দীতে ইউরোপে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ব্যবহার করা হয়৷ উন্নত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা জীবনযাপনের মানে পরিবর্তন আনে৷ এভাবে সমাজে স্থিতিশীলতা ও শান্তি নিশ্চিত হয়৷
ইউরোপে যখন বিশের দশকে ধর্মনিরপেক্ষতা ডানা মেলতে শুরু করে তখন বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে ইসলাম ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার বাড়ে৷ যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ অ্যামেরিকায় বিশ্বাসীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে৷ এখনও আফ্রিকা সহ এশিয়ার অনেক দেশ যেমন বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোতে বিভিন্ন ধর্মের প্রসার ঘটছে৷
এই দেশগুলোর মধ্যে কয়েকটিতে – বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলোতে – ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বাড়ছে কারণ মানুষ অন্যের বিশ্বাসকে গ্রহণ করতে চাইছে না এবং যারা অন্যভাবে চিন্তা করছে তাদেরকে ভয় দেখাচ্ছে৷ সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্মীয় নিরপেক্ষতাকে হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে আর নাস্তিকদের ভাবা হচ্ছে শত্রু৷
এটি একটি চরম ভুল৷ অনেকদিন ধরে গণতন্ত্রের অনেক সমস্যা ছিল৷ কিন্তু এখনও এটি সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা৷ ধর্ম নিরপেক্ষ গণতন্ত্র ধর্মীয় গোঁড়ামিকে সরকার পরিচালনা ব্যবস্থা থেকে দূরে রাখে এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সমর্থন করে যেন সবাই, ধর্মপ্রাণ ও নাস্তিকরা, উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে৷
গ্রেহেম লুকাসের মন্তব্যের সঙ্গে আপনি কি একমত? মতামত জানান নীচের মন্তব্যের ঘরে৷