প্যারিস ও ব্রাসেলসে সন্ত্রাস যেন ইউরোপীয় মানসে ভীতি ও সন্দেহের ছাপ রেখে গেছে, যা থেকে চলতি উদ্বাস্তু সংকটে ইউরোপের প্রতিক্রিয়াও চালিত হচ্ছে৷ ইউরোপ উত্তর খুঁজছে শুধু একটি প্রশ্নের নয়, অনেক প্রশ্নের৷
বিজ্ঞাপন
২০০৪ সালের মার্চে মাদ্রিদে ট্রেনে বোমাবাজি; ২০০৫ সালের জুলাইতে লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডে বোমাবাজি; ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে শার্লি এব্দো হত্যাকাণ্ড; সে বছরের নভেম্বরে আবার প্যারিসে আক্রমণ; ২০১৬ সালের মার্চে ব্রাসেলসে গুলিবাজি৷ এ সব ঘটনা ইউরোপীয় মানসে গভীর দাগ কেটে গেছে৷ সে হিসেবে ইউরোপীয় মানস আজ ইংরেজিতে যাকে বলে ‘স্কার্ড' অর্থাৎ দাগী৷
আইএস-এর মতো সন্ত্রাসী সংগঠন যখন তথাকথিত ‘সফ্ট টার্গেট' বেছে নেয়, তখন তাদের রোখা সহজ নয়, সম্ভবও নয়, বিশেষ করে ইউরোপের মতো মহাদেশে৷ এখানকার স্বচ্ছন্দ জীবনযাত্রা, ব্যক্তিস্বাধীনতা, পরিবহণ ব্যবস্থা, মুক্ত সীমান্ত, টেলিযোগাযোগ, সব কিছুই টেররিস্টদের ‘স্লিপিং সেল'-গুলির পক্ষেও অত্যন্ত সুবিধাজনক – যদিও তাদের উদ্দেশ্য হলো, যত বেশি সম্ভব নিরপরাধ ব্যক্তির প্রাণ নেওয়া৷
বিশ্ব কি ধ্বংসের পথে?
চলতি বছরের শুরুতেই সন্ত্রাসী হামলার ব্যাপকতা দেখে এই প্রশ্ন জাগতেই পারে৷ গত বছরের নভেম্বরে প্যারিসে হামলায় নিহত হন ১৩০ জন৷ সেই ঘটনার পর একের পর এক হামলায় তটস্থ বিশ্ব৷
ছবি: Reuters/U. Bektas
ইস্তানবুলে বোমা হামলা: জানুয়ারি ১২
ইস্তানবুলের এক জনপ্রিয় চত্বরে আত্মঘাতী বোমা হামলায় প্রাণ হারান ১৩ ব্যক্তি, আহত বেশ কয়েকজন৷ নিহতদের মধ্যে কয়েকজন বিদেশি ছিলেন৷ আত্মঘাতী হামলাকারী ছিল তথাকথিত ‘ইসলামিক স্টেট’ বা আইএস অনুসারী সিরীয় নাগরিক নাবিল ফাদিলা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Kneffel
জাকার্তায় হামলা: জানুয়ারি ১৪
ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় সিরিজ বোমা হামলায় প্রাণ হারান কমপক্ষে আট ব্যক্তি, আহত ২৪৷ ‘ইসলামিক স্টেট’ সেই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: Getty images/AFP/Str
ওয়াগাডুগুর হোটেলে হামলা: জানুয়ারি ১৫
আল-কায়দা সমর্থিত জঙ্গিরা বুর্কিনা ফাসোর রাজধানী ওয়াগাডুগুতে একটি হোটেল হামলা চালায়৷ এতে ১৮টি দেশের কমপক্ষে ২৩ ব্যক্তি নিহত হন৷ ফরাসি এবং সেদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর যৌথ অপারশনে হোটেলটি জঙ্গিমুক্ত হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/W. Elsen
আঙ্কারায় হামলা: ফেব্রুয়ারি ১৭
তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় বাসের বহরে হামলার দায় স্বীকার করেছে ‘কুর্দিশ ফ্রিডম ফ্যালকনস’ বা টিএকে৷ হামলায় ২৯ ব্যক্তি নিহত এবং কমপক্ষে ৬০ ব্যক্তি আহন হন যাদের মধ্যে সাধারণ মানুষ ছাড়াও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা রয়েছেন৷
ছবি: Reuters/Ihlas News Agency
মোগাদিশুতে হোটেলে হামলা: ফেব্রুয়ারি ২৬
সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিশুর একটি হোটেলের মধ্যে নিজের গাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটায় এক আত্মঘাতী বোমারু৷ এতে ১৫ ব্যক্তি নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হন৷ আল-শাবাব জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্তরা এই হামলা চালিয়েছে বলে জানা গেছে৷
ছবি: Reuters/F. Omar
আইভরি কোস্টে হোটেলে গুলিবর্ষণ: মার্চ ১৩
আল-কায়দার উত্তর আফ্রিকা শাখার সদস্যরা আইভরি কোস্টের গ্রান্ড ব্যাসামে একটি হোটেলে গুলিবর্ষণ করে৷ এতে ১৮ ব্যক্তি নিহত এবং ৩৩ জন আহত হন৷
ছবি: Reuters/L. Gnago
আঙ্কারায় বোমা হামলা: মার্চ ১৩
তুরস্কে একের পর এক বোমা হামলা ঘটছে৷ সেদেশের রাজধানীর কেন্দ্রে বিস্ফোরকভর্তি একটি গাড়ির বিস্ফোরণ ঘটে ১৩ মার্চ৷ এতে প্রাণ হারান ৩৭ ব্যক্তি, আহত ১২৭৷ এই হত্যাকাণ্ডেরও দায় স্বীকার করেছে টিএকে৷
ছবি: Reuters/U. Bektas
ব্রাসেলসে হামলা: মার্চ ২২
ব্রাসেলসে একাধিক সন্ত্রাসী হামলায় নিহত কমপক্ষে ৩৪ ব্যক্তি, আহত ১৭০৷ সেদিন সকাল আটটার দিকে ব্রাসেলস বিমানবন্দরে দু’টি বিস্ফোরণ ঘটে৷ আর তার একঘণ্টা পর মোলেনবেক মেট্রো স্টেশনে আরেকটি বিস্ফোরণ ঘটে৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট’ এ সব হামলার দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: Reuters/F. Lenoir
8 ছবি1 | 8
আজব শোনালেও, ফুটবলের ভাষায় বলতে গেলে, একদিকে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী, অন্যদিকে অজ্ঞাত সন্ত্রাসীদের মধ্যে এই ‘ফুটবল খেলায়' পুলিশ খেলছে ফুটবলের নিয়মকানুন অনুযায়ী; সন্ত্রাসীরা কিন্তু মাঠেও থাকতে পারে, আবার গ্যালারিতে দর্শকদের আসনেও থাকতে পারে; আরো বড় কথা, তারা সাইডলাইনের যে কোনো জায়গায় বল পাঠাতে পারলেই সেটা গোল বলে গণ্য হবে৷ এমনকি ভুল মাঠ বা ভুল স্টেডিয়াম হলেও আপত্তি নেই৷
ইউরোপের মানুষের আজ এটা জানা যে, তারা কোথাও নিরাপদ নয় – অন্তত পুরোপুরি একশ' ভাগ নিরাপদ নয়; মিশরে পিরামিড দেখতে গেলেও নয়; টিউনিশিয়ায় ছুটি কাটাতে গেলেও নয়; আবার ইউরোপের মূল ভূখণ্ডের বড় বড় শহরগুলিতেও নয়৷ কেননা সন্ত্রাসীরা সর্বত্র থাকতে পারে, সর্বত্র হানা দিতে পারে৷ তাহলে পুলিশ বা কর্তৃপক্ষের কর্তব্য?
প্রথমত সন্ত্রাসীদের সঙ্গে চোরপুলিশ খেলাটা আরো ভালোভাবে খেলা, বিশেষ করে চুরি হওয়া এবং চোর পালানোর আগে৷ ঠান্ডা লড়াইয়ের আমলের ‘স্পাই ভার্সাস স্পাই'-এর মতো আধুনিক পুলিশ ও গোয়েন্দাবাহিনীকে অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে এই অদৃশ্য সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে৷ এ যুদ্ধে সবচেয়ে বড় সাফল্য হবে, যখন কেউ টের পেল না, অথচ একটা সম্ভাব্য হত্যাকাণ্ড ব্যাহত হল, অপরাধীরা ধরা পড়ল৷
ইউরোপ জুড়ে বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা
ব্রাসেলসে একাধিক সন্ত্রাসী হামলার পর ইউরোপ জুড়ে নেয়া হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তা৷ বিশেষ করে বিমানবন্দর, ট্রেন স্টেশন, সীমান্ত এবং বিভিন্ন শহরের রাস্তায় পুলিশের বাড়তি উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/P. Golovkin
‘যুদ্ধে ইউরোপ’
ফরাসি প্রধানমন্ত্রী তো বলেই দিলেন, ইউরোপ এখন ‘যুদ্ধে আছে’৷ ব্রাসেলসের ঘটনার পর ইউরোপীয় নেতারা জরুরি নিরাপত্তা বৈঠক করেছেন এবং সর্বত্র নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি বাড়িয়েছেন৷ তাদের সঙ্গে রয়েছেন বোমা বিশেষজ্ঞ, প্রশিক্ষিত কুকুর এবং সাদা পোশাকের গোয়েন্দারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Roessler
সব বড় বিমানবন্দরে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে
লন্ডন, প্রাগ, অ্যামস্টারডাম, ভিয়েনাসহ ইউরোপের সব বিমানবন্দরে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে৷ লন্ডনের প্রধান বিমানবন্দর, হিথ্রোতে, পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতি দেখা গেছে৷ পাশাপাশি, লন্ডনসহ বিভিন্ন শহরেও বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/epa/A. Rain
ডাচ পুলিশের সতর্ক অবস্থান
নেদারল্যান্ডসের অ্যামস্টারডাম বিমানবন্দরে নিরাপত্তা দিচ্ছে ডাচ মিলিটারি পুলিশ৷ ব্রাসেলস বিমানবন্দরে হামলার পরপরই সেখানকার নিরাপত্তা বাড়ানো হয়৷ ব্রাসেলসে মঙ্গলবার একাধিক বিস্ফোরণে বেশ কয়েকজন নিহত এবং প্রায় দুই শত মানুষ আহত হয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/epa/E. Elzinga
ব্রিটেনে সতর্কতা
লন্ডনের বিমানবন্দরে পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/J. Mansfield
ফ্রাংকফুর্ট বিমানবন্দরে বাড়তি পুলিশ
জার্মান কর্তৃপক্ষও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিরাপত্তা বাড়িয়েছে৷ বিশেষ করে বিমানবন্দর, ট্রেন স্টেশন আর বেলজিয়াম, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, লুক্সেমবুর্গ সীমান্তে পুলিশের উপস্থিতি বাড়ানো হয়েছে৷ তবে পুলিশের সবচেয়ে বেশি উপস্থিতি চোখে পড়েছে জার্মানির সবচেয়ে বড় বিমানবন্দর ফ্রাংকফুর্ট বিমানবন্দরে৷ শহরটির ট্রেন স্টেশনেও পুলিশ অবস্থান নিয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/C. Stache
রেল যোগাযোগ সাময়িক বন্ধ
বেলজিয়ামে হামলার পর জার্মানির জাতীয় ট্রেন ব্যবস্থা, ডয়চে বান, ব্রাসেলসের সঙ্গে তাদের উচ্চগতির ট্রেন সেবা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়৷ ব্রাসেলসের বদলে জার্মানির সীমান্তের শহর আখেনে ট্রেনগুলো থামানো হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. A. Gekiere
প্যারিসে আবারো উচ্চ সতর্কর্তা
প্যারিসে গত নভেম্বর সন্ত্রাসী হামলায় অনেকে প্রাণ হারান৷ মঙ্গলবার ব্রাসেলসে হামলার পরপরই তাই সেখানকার নিরাপত্তা আরো বাড়ানো হয়৷ প্যারিসের মূল বিমানবন্দর এবং সংশ্লিষ্ট ট্রেন স্টেশন দু’টিতে নিরাপত্তা বাহিনীর পুরো দল নিয়োগ করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/epa/E. Laurent
রাশিয়ার নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুর্নমূল্যায়ন
রাশিয়ার যোগাযোগমন্ত্রী মাক্সিম সকোলভ জানিয়েছেন, ব্রাসেলসের ঘটনার পর সেদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও পুর্নমূল্যায়ন করা হবে৷ যদিও রাশিয়া আগে থেকেই বেশ সতর্ক৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/P. Golovkin
8 ছবি1 | 8
এ সংগ্রামের দ্বিতীয় অংশটা বস্তুত পুলিশের হাতে নেই, কেননা তার পটভূমি যেমন একদিকে সংশ্লিষ্ট দেশটির সমাজ, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক দৃশ্যপট৷ ইউরোপের যে দেশগুলিতে সন্ত্রাসের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি, তাদের সব ক'টিতেই একটি বড় আকারের অভিবাসী সম্প্রদায় আছে, যাদের একটি বড় অংশ আবার মুসলিম৷ এক্ষেত্রে ‘ইন্টেগ্রেশন' বা সমাজে অন্তর্ভুক্তিকে সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধের পন্থা ও অঙ্গ হিসেবে গণ্য করতে গেলে, পশ্চিমি, ইউরোপীয় সভ্যতাকে মুসলিম সংস্কৃতির সঙ্গে আরো অনেক বেশি নিবিড়ভাবে, গভীরভাবে লিপ্ত হতে হবে, সংশ্লিষ্ট হতে হবে৷ ইউরোপের জনসংখ্যাগত বিকাশের জন্য এই অভিবাসীদের প্রয়োজন, তা তারা যেভাবে এবং যে সংখ্যাতেই আসুক না কেন৷ তাদের আসা পুরোপুরি বন্ধ করার চেষ্টা করলে, অভিবাসন আইনি ছেড়ে আরো বেআইনি পথ ধরবে; যারা আসবে, তাদের সমাজের অন্তর্ভুক্ত করা আরো কঠিন হবে; বাড়বে অসন্তোষ, অতৃপ্তি ও সেই সঙ্গে ইসলামিক স্টেট প্রমুখ সন্ত্রাসী সংগঠনগুলির জন্য সোৎসাহী রংরুটদের সংখ্যা৷
অপরদিকে আন্তর্জাতিক দৃশ্যপট বলতে বোঝায় ইরাক, সিরিয়া, অধিকৃত ফিলিস্তিনি এলাকা, গোটা উত্তর আফ্রিকা জুড়ে যা কিছু ঘটছে বা ঘটছে না৷ এবং সে সব কিছুতে পশ্চিমা বিশ্বের ভূমিকা বা দায়িত্ব অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই৷ কাজেই হাত গুটিয়ে বসে না থেকে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বাস্তবিক সংগ্রামে নামতে হবে৷ ইউরোপের মানুষ ভবিষ্যতে নিরাপদ বোধ করবেন কিনা, সেটা সন্ত্রাসীরা যতটা জানে, ততটাই সম্ভবত জানেন ইউরোপের মানুষরা নিজে৷ জানা এক ব্যাপার, আর সচেতন হয়ে ওঠাটা আরেক ব্যাপার৷ এবার বোধহয় সচেতনতার সময় এসেছে৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷