ইউরোপে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের অভাব নেই৷ স্পেনে কাটালান কিংবা বাস্করা; ইটালির ভেনেতো অঞ্চল; বেলজিয়ামে ফ্লেমিশরা কিংবা বলকানে বসনীয় সার্বরা – সকলেই চায় আলাদা হতে৷ কিন্তু তার সম্ভাবনা কতটা?
বিজ্ঞাপন
বার্সেলোনায় গত সপ্তাহে বিশ লাখ মানুষ দু'টি রাজপথ জুড়ে একটি ‘ভি' বিজয়চিহ্ন তৈরি করেন৷ কাটালোনিয়া প্রদেশের হলুদ-লাল রঙের জোয়ারে কিন্তু মাঝে মাঝে স্কটল্যান্ডের পতাকাও দেখা গেছে৷ কাটালানদের স্বাধীনতার প্রয়াস আজ থেকে নয় এবং গত পাঁচ বছরে তার তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে৷ কিন্তু স্কটিশ গণভোট থেকে কাটালানরা যে নতুন প্রেরণা পেয়েছে, তা অনস্বীকার্য৷
কাটালান (বানানভেদে ক্যাটালান) রাজনীতিকরা ৯ই নভেম্বর অনুরূপ একটি গণভোটের ডাক দিয়েছেন৷ ভোটে দু'টি প্রশ্ন থাকবে: আপনি কি চান যে, কাটালোনিয়া একটি রাষ্ট্র হোক? তা যদি হয়, তাহলে সেই রাষ্ট্র কি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে? স্পেনের প্রধানমন্ত্রী মারিয়ানো রাখয়-এর দৃষ্টিতে কাটালানদের ভোট অবৈধ হবে – এবং তিনি ব্যাপারটা দেশের সাংবিধানিক আদালতের সামনে তুলে ধরবেন, বলে জানিয়েছেন রাখয়৷ আদালতে ফেডারাল সরকারের জয় প্রায় নিশ্চিত – কিন্তু তা বলে কাটালান অঞ্চলে স্বাধীনতার জন্য যে জনসমর্থন সৃষ্টি হয়েছে, সেটাকে তো পুরোপুরি উপেক্ষা করা চলে না৷ বলতে কি, কাটালানদের কাছে ব্রিটেন প্রকৃত গণতন্ত্রের নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়েছে, কেননা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সাংবিধানিক বেড়া সরিয়ে স্কটল্যান্ডের জনগণকে গণভোটের সুযোগ দেওয়া হয়েছে৷
স্কটল্যান্ডে গণভোট: সম্ভাবনা এবং অনিশ্চয়তা
গ্রেট ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতার পক্ষে, নাকি বিপক্ষে? ১৮ই সেপ্টেম্বর এ প্রশ্ন সামনে রেখেই স্কটল্যান্ডে গণভোট৷ তার আগে চলুন দু’পক্ষের মধ্যে নিষ্পত্তি হয়নি এমন কিছু বিষয় এবং সার্বিক পরিস্থিতির দিকে একটু নজর দেয়া যাক৷
ছবি: Getty Images
আশা এবং উৎকণ্ঠা
স্বাধীনত দেশ হিসেবে অভ্যুত্থান শুধু যে স্কটল্যান্ডের জন্যই একটা বিরাট পরিবর্তন এনে দেবে – তা কিন্তু নয়৷ এমন একটা ঘটনা ব্রিটেন, ইউরোপ, এমনকি ন্যাটো-কেও দাঁড় করাবে নীতিগত পরিবর্তন এবং নতুন চ্যালেঞ্জের সামনে৷
ছবি: Andy Buchanan/AFP/Getty Images
স্কটল্যান্ডের হাতে
স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার সমর্থকরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, স্বাধীনতায় লাভই হবে, এর ফলে ক্ষতির কোনো আশঙ্কা নেই৷ উত্তর সাগরের তেল ক্ষেত্রের আয় দিয়ে দেশটি সহজেই নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে বলে বিশ্বাস তাঁদের৷ ব্রিটিশ সরকারে কাছে অবশ্য রাজস্ব হারানোর ব্যাপারটি বড় রকমের ক্ষতি৷
ছবি: Getty Images/J. J Mitchell
মিলে থাকাই ভালো?
স্বাধীনতার বিপক্ষের সবাই একতার শক্তিতে বিশ্বাসী৷ তাঁরা বলছেন, স্কটল্যান্ড আর ব্রিটেনের মধ্যে অমিলের চেয়ে মিলই বেশি৷ তাছাড়া, স্বাধীনতার পরিনামে অর্থনৈতিক যে ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দেবে তা নিয়েও তাঁরা চিন্তিত৷ স্কটল্যান্ডের অংশে তেল আর গ্যাসের যে মজুদ রয়েছে এটাও গণভোটের বড় নিয়ামক৷
ছবি: Getty Images/A. Buchanan
মুদ্রা নিয়ে প্রশ্ন
স্কটল্যান্ড স্বাধীন হলে মুদ্রা নিয়েও জটিলতা দেখা দেবে৷ দুটো উপায় খোলা – হয় ইউরোজোনে থেকে বর্তমান মুদ্রা পাউন্ডকে রেখে দাও, অথবা নতুন মুদ্রা চালু করো৷ স্বাধীন স্কটল্যান্ড কোন পথ ধরবে?
ছবি: Getty Images/J. J Mitchell
আণবিক অস্ত্রমুক্ত এলাকা?
গ্লাসগোর উত্তর-পশ্চিমের ফ্যাসলেন নৌ-ঘাঁটিতে যে নিউক্লিয়ার সাবমেরিন রয়েছে সেগুলোর কী হবে? স্কটল্যান্ড কিন্তু আগে থেকেই আণবিক অস্ত্র রাখার বিপক্ষে৷
ছবি: AFP/Getty Images/A. Buchanan
রানি থাকবেন?
এমনও হতে পারে, স্কটল্যান্ড স্বাধীন হলো এবং স্বাধীন দেশেও সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের অংশ হিসেবে মাথার ওপরে থেকে গেলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ৷ সে সম্ভাবনা অবশ্য কম৷ বেশির ভাগ স্কটই যে প্রজাতন্ত্র চান!
ছবি: imago/i Images
নাগরিকত্ব এবং ঋণ
গণভোটের মাত্র কয়েকদিন বাকি, অথচ স্কটল্যান্ডের অনেকেই স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়াবেন, নাকি বিপক্ষে – এ নিয়ে বেশ দোদুল্যমান৷ স্বাধীনতা নতুন দেশের জন্য কিছু সংকটও ডেকে আনতে পারে! যুক্তরাজ্যের যে পরিমাণ জাতীয় ঋণ তার কতটা দায় উত্তরাধিকার সূত্রে স্কটল্যান্ড নেবে? দ্বৈত নাগরিকত্ব কি অনুমোদন পাবে? এ সব প্রশ্নের উত্তর আজও অজানা৷
ছবি: imago/United Archives
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে, নয়ত বাইরে
কোনো দেশ স্বাধীন হলে আপনা-আপনিই ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য হয়ে যাবে – এমন কোনো বিধান নেই৷ আগের কোনো দৃষ্টান্ত নেই বলে এ নিয়েও বিতর্ক আছে৷ ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আবেদন করেই স্কটল্যান্ডকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য হতে হবে৷
ছবি: Getty Images
8 ছবি1 | 8
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিভাজনরেখার কোনো অভাব নেই, কিন্তু সেই বিভাজন থেকে স্বাধীনতা পর্যন্ত যেতে হলে, আগে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বাস্তব সত্যগুলোর কথা স্মরণ করতে হবে৷ স্পেনের বাস্ক প্রদেশের রক্তাক্ত বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের কথা আপাতত বাদ রাখলেও, ইটালির ভেনেতো প্রদেশের কথা বলা যেতে পারে, যার মুকুটমণি হলো ভেনিস৷ গত মার্চের একটি অনলাইন ভোটে ৮৯ শতাংশ ভোটার ভেনেতোর স্বাধীনতার সপক্ষে ভোট দেন৷
বেলজিয়োমের ফ্ল্যান্ডার্স অঞ্চলের বিচ্ছিন্ন হবার প্রয়াস বহুদিনের৷ কিন্তু বেলজিয়ামের রাজনৈতিক দলগুলি সরকারগঠন সম্পর্কে একমত হতে না পারার কারণে দেশটি ১৮ মাস ধরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তাঁবে ছিল, এবং গত মে মাসে নির্বাচন সম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও আজও সরকারগঠন করতে পারেনি৷ এই পরিস্থিতিতে বস্তুত একক অঞ্চলগুলিই শাসন চালাচ্ছে৷ মজার কথা, তার ফলে ফ্লেমিশরা উপলব্ধি করেছে যে, তাদের বিশেষ স্বার্থগুলি যেমন আঞ্চলিক, তেমনই ইইউ পর্যায়ে রক্ষার ব্যবস্থা করা যায় – স্বাধীনতার পথে না গিয়েই৷ যা থেকে প্রমাণ হয় যে, অনেক ক্ষেত্রে ইউরোপের ‘স্বাধীনতা আন্দোলন'-গুলি যতটা না পৃথক হতে চায়, তার চাইতেও বেশি চায় যে, তাদের স্থানীয় স্বার্থ, আশা-আকাঙ্খাগুলি আরো বেশিভাবে প্রতিফলিত হোক৷