যুক্তরাষ্ট্রের থিংক ট্যাংক পিউ রিসার্চ সেন্টার বলছে বিশ্বের প্রায় সব দেশে বিভিন্ন ধর্ম পালনে কমবেশি সীমাবদ্ধতা রয়েছে৷ তবে ইউরোপের দেশগুলোতে এর মাত্রা তুলনামূলকভাবে কম বলে বিশ্লেষণে খুঁজে পেয়েছে তারা৷
বিজ্ঞাপন
গতবছর ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ সালে বিভিন্ন দেশে ধর্ম পালনে সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে পিউ রিসার্চ৷ আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন, জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় বিভিন্ন সংস্থা এবং স্বাধীন ও বেসরকারি সংস্থার প্রকাশিত এক ডজনের বেশি রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়৷
প্রতিবেদনে ‘সরকারি বিধিনিষেধ সূচক’ ও ‘সামাজিক হয়রানি সূচক’ নামে দুটি সূচকও প্রকাশ করা হয়েছে৷ ১৯৮টি দেশ ও অঞ্চলকে এসব সূচকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷
সরকারিবিধিনিষেধসূচক
এই সূচকে একটি দেশের আইন, নীতি ও কার্যক্রম ধর্মীয় বিশ্বাস ও রীতি পালনে কতটা বাধা দেয়, তা জানার চেষ্টা করা হয়েছে৷ ২০টি মাপকাঠির ভিত্তিতে সূচকটি তৈরি করা হয়৷ এর মধ্যে আছে একটি নির্দিষ্ট ধর্ম বা বিশ্বাসের উপর নিষেধাজ্ঞা, ধর্ম পরিবর্তনে বাধা, ধর্ম প্রচারে বিধিনিষেধ কিংবা এক বা একের বেশি ধর্মীয় গোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা দেয়া ইত্যাদি৷
ইউরোপের ধর্মের রূপ
ইউরোপ কতটা অসাম্প্রদায়িক? কোন দিকে বেশি ঝুঁকছে ইউরোপের মানুষ? ধর্ম নিয়ে রাষ্ট্রের অবস্থান কী? সাম্প্রদায়িকতা বা সম্প্রীতি কতটা? ছবিঘরে থাকছে এমন সব প্রশ্নের উত্তর৷
ছবি: René Arnold/House of One
কোন ধর্মের কত মানুষ
পিউ রিসার্চের ২০১৫ সালের এক জরিপ অনুযায়ী ইউরোপে সাড়ে ৭৪ শতাংশ জনগোষ্ঠী খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী৷ তারপর থাকা সবচেয়ে বেশি জনগোষ্ঠী ১৮ দশমিক ৮ শতাংশের কোনো ধর্ম নেই৷ তৃতীয় অবস্থানে থাকা মুসলিমরা প্রায় ছয় শতাংশ। এছাড়াও ইহুদি, হিন্দু, বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মের জনগোষ্ঠী এক শতাংশের কম করে৷
ছবি: Robert Harding/picture alliance
‘ধর্মহীন’ মানুষ
পিউ রিসার্চের ২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী, পশ্চিম ইউরোপের অনেক দেশেই অর্ধেকের বেশি মানুষ ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন৷ তবে বেছে নিতে হলে কোনটি বেছে নেবেন- এমন প্রশ্নে জার্মানির ৭১ শতাংশ ও ফ্রান্সের ৬৪ শতাংশ খ্রিস্ট ধর্মের কথা বলেছেন৷ আরেক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৫০ সাল নাগাদ এই অঞ্চলে খিস্টান ৬৫ শতাংশ, ‘ধর্মহীন’ ২৩ দশমিক তিন শতাংশ ও মুসলিমদের হার হবে ১০ দশমিক দুই শতাংশ৷ বাকিদের হার অনেকটা অপরিবর্তিতই থাকবে৷
ছবি: Diogo Baptista/ZUMAPRESS/picture alliance
রাষ্ট্র ও ধর্ম
পিউ রিসার্চের ২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী,পশ্চিম ইউরোপের বেশিরভাগ মানুষ সরকারি নীতি থেকে ধর্মকে দূরে রাখার পক্ষপাতী৷ সুইডেনে ৯০ শতাংশ, বেলজিয়ামে ৭২ শতাংশ মানুষই এমনটা মনে করেন৷ অন্যদিকে সুইজারল্যান্ডের ৪৫ ভাগ আর যুক্তরাজ্যের ৩৮ ভাগ মনে করেন সরকারের নীতিতে ধর্মকে সমর্থন দেয়া উচিত৷ ফ্রান্স, জার্মানিসহ ইইউভুক্ত বেশিরভাগ দেশে অসাম্প্রদায়িকতা এবং নাগরিকদের স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনের সাংবিধানিক স্বীকৃতি আছে৷
ছবি: Sebastian Gollnow/dpa/picture alliance
ধর্ম পালনে সমস্যা
পিউ রিসার্চের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ধর্ম পালনে সরকারের হয়রানিতে মধ্যপ্রাচ্য-উত্তর আফ্রিকার পরই রয়েছে ইউরোপ৷ এই অঞ্চলে ৯৮ শতাংশ দেশে ধর্মীয় গোষ্ঠীর উপর এবং ৯১ শতাংশ দেশে উপাসনায় হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে৷ বিভিন্ন আইনের কারণে ধর্মবিধি পালনে মানুষ সমস্যায় পড়েন৷ যেমন, স্লোভেনিয়ায় অচেতন ছাড়া প্রাণী হত্যা নিষিদ্ধ করায় মুসলিম ও ইহুদিরদের হালাল ও কোশার বিধি মানা কঠিন হয়ে পড়ে৷
ছবি: Mesut Zeyrek/AA/picture alliance
পোশাক ও প্রতীক
অনেক দেশেই জনসমক্ষে বা কর্মক্ষেত্রে ধর্মীয় পোশাকে নিষেধাজ্ঞা আছে৷ যেমন, অস্ট্রিয়ায় জনসমক্ষে মুখমণ্ডল আবৃত রাখা এবং স্কুলে ১০ বছরের কম বয়সিদের স্কার্ফ পরা নিষেধ৷ ফ্রান্সে জনসেবা প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের স্কার্ফ, টুপি, পাগড়ি বা ক্রস পরিধান নিষিদ্ধ৷ ২০১৫ সালে জার্মানির আদালত বিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের স্কার্ফ পরা নিষিদ্ধ করলেও তা বাস্তবায়ন রাজ্যগুলোর উপর ছেড়ে দিয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Johnson
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা
২০১৯ সালে ইউরোপে ১৭টি দেশে ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে সরকার, আগের বছর এমন দেশের সংখ্যা ছিল ১৯৷ এক্ষেত্রে সবার উপরে ছিল রাশিয়া৷ গত বছরের নভেম্বরে ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ধর্মীয় উগ্রবাদের অভিযোগে ২০১৭ সাল থেকে ৪৩টি মসজিদ বন্ধ করেছে ফ্রান্স৷ কোভিড-১৯-এর বিধিনিষেধের কারণে ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে দেশটির ক্যাথলিক চার্চ কর্তৃপক্ষ৷
ছবি: Ait Adjedjou Karim/Avenir Pictures/ABACA/dpa/picture alliance
উগ্রবাদ ও অসহিষ্ণুতা
সাম্প্রতিক বছরে ইউরোপের দেশে দেশে উগ্রবাদের বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে৷ ২০২০ সালে ফ্রান্সে জঙ্গিবাদ সমর্থক এক মুসলিম তরুণ এক কলেজ শিক্ষককে হত্যা করেন৷ তার আগে টিউনিসিয়ার এক অভিবাসী চার্চের ভিতরে তিন খ্রিস্টানকে হত্যা করেন৷ ২০১৯ সালে জার্মানিতে সিনাগগে হামলায় মারা যান দুইজন৷ সম্প্রতি সুইডেনে উগ্র ডানপন্থি দলের নেতা রাসমুস পালুদান সুইডেনে পবিত্র কোরানের কপি পোড়ানোর ঘোষণা দিলে ক্ষুব্ধ হন দেশটির মুসলিমরা৷
ছবি: Alain Jocard/AFP/Getty Images
সম্প্রীতির বার্তা
উগ্রতা আর সাম্প্রদায়িকতার বাইরে ইউরোপে সম্প্রীতির অনেক উদাহরণ আছে৷ ইহুদি এবং মুসলমানদের একত্রিত করতে জার্মানির মারবুর্গ শহরে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করেছেন দুই সম্প্রদায়ের মানুষ৷ বার্লিনে মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের এক ছাদের নীচে প্রার্থনার জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে ‘হাউস অব ওয়ান’৷ সম্প্রতি জার্মানির বুন্ডেসলিগার ম্যাচ চলার সময় এক ফুটবলারের ইফতারের জন্য কিছুক্ষণ খেলা বন্ধ রাখা হয় - যা আগে কখনও হয়নি৷
ছবি: Frank Senftleben/epd-bild
8 ছবি1 | 8
১০ পয়েন্টের মধ্যে স্কোরের ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশে বিধিনিষেধের পরিমাণ ‘অনেক বেশি- স্কোর ৬.৬ ও তার চেয়ে বেশি’, ‘বেশি- স্কোর ৪.৫-৬.৫’, ‘পরিমিত- স্কোর ২.৪-৪.৪’ ও ‘কম-’ এই চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে৷
এতে দেখা গেছে জার্মানি (স্কোর ৩.২) ও যুক্তরাজ্যসহ (স্কোর ৩.২) ইউরোপের দেশগুলো মূলত ‘পরিমিত' গ্রুপে (স্কোর ২.৪ থেকে ৪.৪) পড়েছে৷ তবে ইউরোপে সবচেয়ে বেশি মুসলমান বাস করা দেশ ফ্রান্স (স্কোর ৪.৬) পড়েছে ‘বেশি’ গ্রুপে৷ বাংলাদেশ (স্কোর ৪.৮), ভারত (স্কোর ৫.৬) ও পাকিস্তানও (স্কোর ৬.৩) আছে এই গ্রুপে৷
পিউ রিসার্চ সেন্টারের হিসাব বলছে ২০১৬ সালে ইউরোপে (তৎকালীন ইইউর ২৮টি দেশসহ নরওয়ে ও সুইজারল্যান্ড) মুসলিম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল প্রায় দুই কোটি ৫৭ লাখ ৭০ হাজার৷ সবচেয়ে বেশি মুসলমান বাস করতেন ফ্রান্সে (৫৭ লাখ ২০ হাজার)৷ এর পরে যথাক্রমে আছে জার্মানি (৪৯ লাখ ৫০ হাজার), যুক্তরাজ্য (৪১ লাখ ৩০ হাজার), ইটালি (২৮ লাখ ৭০ হাজার), নেদারল্যান্ডস (১২ লাখ ১০ হাজার) ও স্পেন (১১ লাখ ৮০ হাজার)৷
স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব, ধর্মের ইতিহাস ও জেন্ডার স্টাডিজ জানিয়েছে, ইউরোপে প্রায় ১৫ থেকে ২০ লাখ হিন্দু বাস করেন৷ যুক্তরাজ্যে ১০ লাখের বেশি হিন্দু বাস করেন বলে জানিয়েছে ‘ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ’৷
সামাজিকহয়রানিসূচক
এই সূচকে একক ব্যক্তি, কোনো গোষ্ঠী বা সংস্থা কর্তৃক ধর্মীয় বৈরিতাপূর্ণ কার্যক্রমের বিষয়টি তুলে ধরা হয়৷ ধর্ম সংশ্লিষ্ট সশস্ত্র সংঘাত কিংবা সন্ত্রাসবাদ, দাঙ্গা, ধর্মীয় পোশাক পরার কারণে হয়রানি, ধর্মের কারণে কাউকে ভয় দেখানো বা লাঞ্ছিত করাসহ মোট ১৩টি মাপকাঠির ভিত্তিতে সূচকটি তৈরি করা হয়৷
এই সূচকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে ভারত (স্কোর- ৯.১)৷ ভারত ছাড়াও পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ইসরায়েলসহ মোট আটটি দেশকে ‘অনেক বেশি’ গ্রুপে রেখেছে পিউ রিসার্চ৷ বাংলাদেশসহ ইউরোপের দেশ জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ইউক্রেন, রাশিয়া, স্পেন, বেলজিয়াম ও ডেনমার্ক আছে ‘বেশি’ গ্রুপে৷ ফ্রান্স আছে ‘পরিমিত’ গ্রুপে৷ অর্থাৎ ফ্রান্সে ধর্মের উপর সরকারি বিধিনিষেধ বেশি থাকলেও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী পর্যায়ে হয়রানি সেই তুলনায় কম৷
সম্প্রতি সুইডেনের উগ্র ডানপন্থি রাজনীতিবিদ রাসমুস পালুদান কোরানের একটি কপি পোড়ান বলে খবর বের হয়েছিল৷ তবে সরকারি বিধিনিষেধ সূচক ও সামাজিক হয়রানি সূচকে দেশটি ‘পরিমিত’ গ্রুপে রয়েছে৷
পিউ রিসার্চের প্রতিবেদনের আরও তথ্য
ধর্মীয় বিশ্বাস ও রীতিনীতির উপর সরকার ও সমাজের বিধিনিষেধ নিয়ে ২০০৭ সাল থেকে রিপোর্ট প্রকাশ করে আসছে পিউ রিসার্চ৷ ২০১৯ সালের তথ্য নিয়ে ২০২১ সালে প্রকাশিত পিউ রিসার্চের সবশেষ রিপোর্ট বলছে, তারা প্রতিবেদন প্রকাশ শুরুর পর বিভিন্ন দেশে ধর্মের উপর সরকারি বিধিনিষেধ ২০১৯ সালেই সবচেয়ে বেশি দেখেছে৷
ধর্মীয় পোশাক পরায় ৪২ দেশে হয়রানি, না পরায় ১৯ দেশে
পিউ রিসার্চ সেন্টার বলছে, ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ৫৬টি দেশের নারীরা তাদের পোশাক খুব বেশি ধর্মীয় অথবা খুব বেশি ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ায় সামাজিক হয়রানির শিকার হয়েছেন৷ জার্মানি, ভারতসহ পাঁচ দেশের নারীদের দুই অভিজ্ঞতাই হয়েছে৷
ছবি: Karim Sahib/AFP
পোশাকের কারণে হয়রানি
যুক্তরাষ্ট্রের থিংক ট্যাংক পিউ রিসার্চ সেন্টার বলছে, ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ৫৬টি দেশের নারীরা তাদের পোশাক খুব বেশি ধর্মীয় অথবা খুব বেশি ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ায় সামাজিক হয়রানির শিকার হয়েছেন৷ মৌখিক কটূক্তি থেকে শুরু করে শারীরিক আঘাত, এমনকি হত্যা এমন হয়রানির মধ্যে পড়ে৷ প্রতিবেদনটি পড়তে উপরে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: picture-alliance/PYMCA/Liat Chen
হিজাব পরায় হয়রানি, না পরায়ও হয়রানি
৫৬টি দেশের মধ্যে ৪২টি দেশে নারীরা ধর্মনিরপেক্ষ পোশাক রীতি লঙ্ঘন করায়, অর্থাৎ হিজাব বা অন্যান্য ধর্মীয় পোশাক পরায় হয়রানির শিকার হয়েছেন৷ আর ১৯টি দেশের নারীরা ধর্মীয় পোশাক রীতি না মানায়, অর্থাৎ হিজাব না পরায় কিংবা ধর্মীয় রীতির সঙ্গে মেলে না এমন পোশাক পরায় হয়রানির শিকার হয়েছেন৷ জার্মানি, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইসরায়েল ও রাশিয়ায় নারীদের দুই অভিজ্ঞতাই হয়েছে৷
ছবি: DW
সবচেয়ে বেশি ইউরোপে
৫৬টি দেশের মধ্যে ইউরোপের দেশ ২২টি৷ এর মধ্যে ২০টি দেশে নারীরা হিজাব বা অন্য ধর্মীয় পোশাক পরায় হয়রানির শিকার হয়েছেন৷ আর দুটি দেশে হিজাব না পরায় নারীদের হয়রানি হতে হয়েছে৷ ২০১৮ সালে ডেনমার্কে এক চালক হিজাব পরা এক মুসলিম নারীকে গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা ছেড়ে দিতে অস্বীকার করেন৷ জার্মানিতে এক নারী একজন মুসলিম নারীকে মেরে তার হেডস্কার্ফ খুলে ফেলার চেষ্টা করেন৷
ছবি: Imago/R. Peters
এশিয়া-প্যাসিফিক
এই অঞ্চলের ১৬ দেশে নারীরা হয়রানিতে পড়েছেন৷ ২০১৮ সালে হেডস্কার্ফ না পরায় এক নারীকে হামলা করায় মালয়েশিয়ায় এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল৷ ২০১৬ সালের কিরঘিস্তানে বিলবোর্ডে বিভিন্ন রকম ইসলামি পোশাক পরিহিত নারীর ছবি বিতর্ক তৈরি করেছিল৷
ছবি: Chong Voon Chung/Xinhua/picture alliance
সাব-সাহারা আফ্রিকা
এই অঞ্চলের সাত দেশের নারীরা পোশাকের কারণে হয়রানির শিকার হয়েছেন৷ ২০১৮ সালে কেনিয়ার কিছু অংশে নারী শিক্ষকদের হিজাব পরার নিয়ম করা হয়েছিল৷ আর লাইবেরিয়ায় হেডস্কার্ফ পরায় মুসলিম নারীরা কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Dai Kurokawa
অ্যামেরিকা
ছয়টি দেশে নারীদের হয়রানির মুখোমুখি হতে হয়েছে৷ ২০১৮ সালে ত্রিনিদাদ ও টোবাগোতে এক হিন্দু স্কুলে এক মুসলিম নারীকে হিজাব না খুললে স্কুল থেকে চলে যেতে বলা হয়েছিল৷ ২০১৬ সালে ক্যানাডায় এক নারী এক হিজাব পরিহিতার দিকে থুতু ছুড়ে তার হিজাব ও চুল ধরে টান দিয়েছিলেন৷
ছবি: imago images/tagesspiegel/K. Heinrich
মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা
পাঁচ অঞ্চলের মধ্যে একমাত্র এই অঞ্চলের দেশগুলোতে নারীরা হিজাব বা ধর্মীয় পোশাক পরার চেয়ে না পরায় বেশি হয়রানির শিকার হয়েছেন৷ ২০১৬ সালে কাতারে এক মুসলিম নারী হিজাব না পরে খবর উপস্থাপনা করায় সমালোচিত হয়েছিলেন৷ ২০১৮ সালে ইসরায়েলের একদল অর্থডক্স ইহুদিকে তাদের দৃষ্টিতে ‘অভদ্র’ পোশাক পরায় এক তরুণীর দিকে চিৎকার ও তাকে ধাওয়া করতে দেখা গিয়েছিল৷
ছবি: Karim Sahib/AFP
যেভাবে তথ্য সংগ্রহ করেছে পিউ রিসার্চ
ধর্মীয় বিশ্বাস ও রীতিনীতির উপর সরকার ও সমাজের বিধিনিষেধ নিয়ে প্রতিবছর রিপোর্ট করে পিউ রিসার্চ৷ এ লক্ষ্যে প্রথমে কয়েকটি প্রশ্ন ঠিক করা হয়৷ তারপর মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জাতিসংঘ ও বিভিন্ন সংস্থার প্রকাশিত ১৯টি রিপোর্টে থাকা প্রতিটি দেশের তথ্যের মধ্যে ঐ প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা হয়৷ এভাবে ‘সরকারি বিধিনিষেধ সূচক’ ও ‘সামাজিক হয়রানি সূচক’ প্রকাশ করা হয়৷ ছবিঘরের তথ্যগুলো ২০২০ সালে প্রকাশিত হয়েছে৷
ছবি: Alain Pitton/NurPhoto/picture alliance
8 ছবি1 | 8
১৯৮টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশি দেশে ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোকে কোনো না কোনোভাবে হয়রানি করা হয়েছে৷ মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলের ২০টি দেশেই এমন হয়রানি দেখা গেছে৷ ইউরোপের ৪৫টি দেশের মধ্যে ৪৪টিতেই হয়রানির ঘটনা ঘটেছে৷ সাব সাহারা আফ্রিকার ৯০ শতাংশ, অ্যামেরিকা অঞ্চলের ৮৯ শতাংশ ও এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের ৮৪ শতাংশ দেশে হয়রানির খবর পাওয়া গেছে৷
এছাড়া ১৬৩টি দেশের সরকার প্রার্থনায় কিছু না কিছু বাধা দিয়েছে৷ বাধা বলতে কিছু ধর্মীয় রীতি পালন করতে না দেয়া, প্রার্থনার স্থানে যেতে বাধা দেয়া কিংবা কোনো ভবনে ধর্মীয় কার্যক্রম করতে না দেয়া বোঝানো হয়েছে৷
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ধর্মীয় প্রতীক ও পোশাকের উপর বিধিনিষেধ দিতে দেখা গেছে৷ যেমন অস্ট্রিয়ায় প্রকাশ্য পুরো মুখ ঢাকা পোশাক পরার উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে৷ ১০ বছরের কম বয়সিদের হেডস্কার্ফ পরে স্কুলে যেতে নিষেধ করা হয়েছে৷
স্লোভেনিয়ায় কোনো প্রাণীকে অচেতন করার আগে জবাই করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷ ফলে মুসলমান ও ইহুদিরা যথাক্রমে হালাল ও কোশরের নিয়ম মেনে পশু জবাই করতে পারেন না৷
ফ্রান্স
২০১১ সালে ইউরোপের প্রথম দেশ হিসেবে ফ্রান্স প্রকাশ্যে মুখ ঢাকা পর্দা পরার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে৷
ফ্রান্সে সরকারি স্কুলের কর্মীরা ধর্মীয় পরিচয় বহন করে এমন কোনো প্রতীক পরতে পারেন না৷ শিক্ষার্থীরাও ‘সহজে দেখা যায় এমন ধর্মীয় প্রতীক’ যেমন মুসলমানরা হেডস্কার্ফ, ইহুদিরা টুপি, শিখরা দস্তর ও খ্রিষ্টানরা বড় ক্রস পরতে পারে না৷ পূর্বাঞ্চলের আলজাস-মোজেল এলাকা ও ফ্রান্সের ওভারসিজ ডিপার্টমেন্ট ও টেরিটরি ছাড়া ফ্রান্সের আর কোথাও সরকারি স্কুলে ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হয় না৷ তবে ইতিহাস বিষয়ের পাঠ্যসূচির অংশ হিসেবে বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী সম্পর্কে শিক্ষা দেয়া হয়৷
দেড় বছরে ২২টি মসজিদ বন্ধ করেছে ফ্রান্স
ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসেব বলছে, গত ১৮ মাসে ২২টি মসজিদ বন্ধ করা হয়েছে৷ তবে যে ক্ষমতাবলে এসব বন্ধ করা হয়েছে তার সমালোচনা করেছেন জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মীরা৷
ছবি: Stephane Mahe/REUTERS
১৮ মাসে ২২ মসজিদ
ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসেব বলছে, গত ১৮ মাসে ২২টি মসজিদ বন্ধ করা হয়েছে৷ এই সংখ্যা তার আগের তিন বছরে মোট মসজিদ বন্ধের তুলনায় অনেক বেশি বলে রয়টার্সকে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা৷ উপরের ছবিতে এক ব্যক্তিকে তার কম্পিউটারে বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি মসজিদ দেখাতে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Stephane Mahe/REUTERS
৯০ মসজিদে তদন্ত
ফ্রান্সে প্রায় আড়াই হাজার মসজিদ রয়েছে৷ এর মধ্যে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ মতাদর্শ প্রচার সন্দেহে ৯০টি মসজিদে তদন্ত চালানো হয়েছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে৷
ছবি: Vanessa Meyer/dpa/picture alliance
মুসলিমদের জন্য বৈরী হয়ে উঠছে ফ্রান্স
ইউরোপে সবচেয়ে বেশি মুসলমান বাস করেন এমন দেশগুলোর মধ্যে একটি ফ্রান্স৷ কিন্তু সেখানকার মুসলমানরা বলছেন, দেশটি ক্রমে মুসলমানদের জন্য বৈরী হয়ে উঠছে৷ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসেব বলছে, ২০২১ সালে মুসলিমবিরোধী বৈষম্যমূলক আচরণ বেড়েছে৷ আর অন্যান্য ধর্মের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা কমেছে৷
ছবি: Alain Pitton/NurPhoto/picture alliance
বন্ধ হয়ে যাওয়া আলন মসজিদ
ফ্রান্সের উত্তরপশ্চিমের আলন শহরের এই মসজিদটি গত অক্টোবরে বন্ধ করে দেয়া হয়৷ ছবিতে মসজিদের দরজায় বন্ধের নোটিশ দেখা যাচ্ছে৷ ‘ইসলামের মৌলবাদী রূপ’ প্রচার ও ‘ফ্রান্সের প্রতি ঘৃণার অনুভব চাষ’ করার অভিযোগ এনে মসজিদটি বন্ধ করা হয়৷ কিন্তু মসজিদের কর্মকর্তারা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, সরকার তার অভিযোগের সমর্থনে খুব কম প্রমাণ উপস্থাপন করেছে৷
ছবি: Stephane Mahe/REUTERS
রয়টার্সের বিশ্লেষণ
মসজিদ বন্ধ করার প্রমাণ হিসেবে সরকারের পক্ষে থেকে ২০ পাতার একটি নথি (যেটি ‘হোয়াইট মেমো’ নামে পরিচিত) আদালতে উপস্থাপন করা হয়৷ সেটি রয়টার্স বিশ্লেষণ করে বলছে, নথিটি কবে তৈরি হয়েছে, কে করেছে এবং তথ্য কোথা থেকে পাওয়া গেছে তার কোনো উল্লেখ নেই৷
ছবি: Vanessa Meyer/dpa/picture alliance
চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ
হোয়াইট মেমোতে আলন মসজিদের চারজনের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর ও ২০২১ সালের এপ্রিলে সংঘটিত দুটি সন্ত্রাসী হামলায় সমর্থন প্রকাশের অভিযোগ আনা হয়৷ এদের একজন করিম দাউদ (ছবি) স্থানীয় সরকারি অফিসে কাজ করেন৷ ২০২১ সালের অক্টোবরে তাকে সরকারি কর্মচারী হিসেব তার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পদক দেয়া হয়েছিল৷ ২০২০ সালে সন্ত্রাসী হামলার পর তিনি গির্জায় গিয়ে সংহতিও প্রকাশ করেছিলেন৷
ছবি: Stephane Mahe/REUTERS
পাঁচটি বই উদ্ধার
হোয়াইট মেমোতে মসজিদ থেকে পাঁচটি বই উদ্ধারের কথা বলা হয়েছে৷ এগুলোকে ‘মৌলবাদী’ বই বলে চিহ্নিত করা হয়েছে৷ অথচ এর মধ্যে চারটি বই বিশেষায়িত বইয়ের দোকান এবং অনলাইনে অনেক পাওয়া যায় বলে জানিয়েছেন লিল ইন্সটিটিউট অফ পলিটিক্যাল স্টাডিজের ইসলামিক স্টাডিজের শিক্ষক দাউদ রিফি৷ অন্য বইয়ের নাম ‘রিয়াদ আস-সালিহিন’৷ ১৩ শতকের এই বইটি ফ্রান্সের জাতীয় গ্রন্থাগারে রাখা আছে৷
ছবি: Fadel Senna/AFP/Getty Images
জিহাদের ডাক দেয়ার অভিযোগ
হোয়াইট মেমোতে আরও অভিযোগ করা হয়, আলন মসজিদের ধর্মপ্রচারকরা সশস্ত্র জিহাদের প্রশংসা করেছেন ও মুসল্লিরা সহিংসতার ডাক দিচ্ছেন বলে শোনা গেছে (যদিও কারা শুনেছেন তাদের পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি)৷ এ ব্যাপারে করিম দাউদ বলছেন, সরকার ‘জিহাদ’ শব্দটির ভুল ব্যাখ্যা করেছে৷ জিহাদের অর্থ সশস্ত্র সংঘাত হতে পারে৷ আবার ‘জিহাদ আল-আকবর’ বোঝাতে প্রায়ই এটি ব্যবহার করা হয়, যার অর্থ, নফস বা নিজ আত্মা পরিশুদ্ধ করার সংগ্রাম৷
ছবি: Stephane Mahe/REUTERS
সমালোচনা
অধিকার কর্মী, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন ও মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যদের অভিযোগ, ফ্রান্সে ধর্মীয় স্থান বন্ধের জন্য কর্তৃপক্ষকে এত ক্ষমতা দেয়া হয়েছে যে, যথাযথ পরীক্ষা না করেই মসজিদ বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে৷ এছাড়া অস্পষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করায় ও পর্যাপ্ত প্রমাণ না দেয়ায় মামলা পরিচালনা করা অনেকক্ষেত্রে সম্ভব হচ্ছে না৷
ছবি: Getty Images/AFP/I. Gaizka
সরকারের জবাব
এলিসি প্রাসাদ রয়টার্সের এই বিশেষ প্রতিবেদন নিয়ে মন্তব্য করতে চায়নি৷ তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসলামি সন্ত্রাসবাদ ঠেকাতে সরকার কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা বাড়িয়েছে এবং ‘আইনের প্রতি পূর্ণ সম্মান রেখে’ তা করা হয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/I. Gaizka
অস্থায়ীভাবে বন্ধ
যে আইনে মসজিদ বন্ধ করা হয় তাতে কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ ছয় মাসের জন্য মসজিদ বন্ধ করতে পারে৷ তবে অধিকার কর্মী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসেবে দেখা গেছে, অনেক মসজিদই আর কখনও খোলা হয় না৷ বন্ধ হওয়া ২২টি মসজিদের মধ্যে কতটি আবার খুলেছে সে হিসাব মন্ত্রণালয় জানায়নি৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Leroux
11 ছবি1 | 11
২০২১ সালের ২১ মে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত ‘২০২০ রিপোর্ট অন ইন্টারন্যাশনাল রেলিজিয়াস ফ্রিডম’ প্রতিবেদনে ফ্রেঞ্চ কাউন্সিল অফ দ্য মুসলিম ফেইথের হিসাব উল্লেখ করে বলা হয় ২০২০ সালে ফ্রান্সে মুসলমানদের লক্ষ্য করে ২৩৫টি অপরাধের ঘটনা ঘটেছে৷ একই বছর ৩৩৯টি ইহুদি-বিদ্বেষী ঘটনা ঘটে বলে জানায় দ্য জিউস কমিউনিটি প্রোটেকশন সার্ভিস৷ ২০২০ সালের জানুয়ারিতে অ্যামেরিকান জিউস কমিটির এক জরিপে অংশ নেয়া ৭০ শতাংশ ইহুদি জানান, তারা তাদের জীবনে অন্তত একবার ইহুদি-বিদ্বেষী ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন৷ মার্কিন এই প্রতিবেদন প্রকাশের সময় ফ্রান্সে খ্রিষ্টানদের উপর হামলার নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি৷ তবে যত হামলা হয়েছে তার বেশিরভাগই গির্জা ও কবরস্থানে ভাঙচুর ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়৷
২০১৫ সালে প্যারিসের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গি হামলায় ১৩০ জন নিহত হয়েছিলেন৷ মাক্রোঁ প্রেসিডেন্ট হওয়ার পাঁচ মাস পর ২০১৭ সালের অক্টোবরে দেশটির সংসদ একটি নতুন সন্ত্রাসবিরোধী আইন পাস করে৷ এর আওতায় ঘৃণা ছড়ানো সন্দেহে মসজিদ বন্ধ করে দিতে কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা বাড়ানো হয়৷ এছাড়া পুলিশের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাও বাড়ানো হয়৷ এই আইনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সর্বোচ্চ ছয় মাসের জন্য ধর্মীয় প্রার্থনার স্থান বন্ধ করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে৷
গত ৫ এপ্রিল রয়টার্সে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসেব উল্লেখ করা জানানো হয়, গত ১৮ মাসে দেশটিতে ২২টি মসজিদ বন্ধ করা হয়েছে৷ এই সংখ্যা তার আগের তিন বছরে মোট মসজিদ বন্ধের তুলনায় অনেক বেশি বলে রয়টার্সকে জানান ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা৷ অধিকার কর্মী, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন ও মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যদের অভিযোগ, ফ্রান্সে ধর্মীয় স্থান বন্ধের জন্য কর্তৃপক্ষকে এত ক্ষমতা দেয়া হয়েছে যে, যথাযথ পরীক্ষা না করেই মসজিদ বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে৷ উল্লেখ্য, ফ্রান্সে প্রায় আড়াই হাজার মসজিদ রয়েছে৷
ফ্রান্স ক্রমে মুসলমানদের জন্য বৈরী হয়ে উঠছে বলে রয়টার্সের প্রতিবেদন জানিয়েছে৷ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসেব বলছে, ২০২১ সালে মুসলিমবিরোধী বৈষম্যমূলক আচরণ বেড়েছে৷ আর অন্যান্য ধর্মের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা কমেছে৷
২০২০ সালের অক্টোবরে ফ্রান্সের নিস শহরের এক গির্জায় ঢুকে তিন ক্যাথলিককে হত্যা করেছিলেন টিউনিশিয়ার এক নাগরিক৷ এর প্রতিক্রিয়ায় প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ দেশের ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বীদের প্রতি শোক প্রকাশ করে সব ধর্মের মানুষকে এক হওয়ার এবং ‘বিভাজন নীতিতে যোগ না দেয়ার' আহ্বান জানিয়েছিলেন৷
জার্মানি
সম্প্রতি জার্মানির বুন্ডেসলিগার এক ম্যাচ চলার সময় মুসলমান এক ফুটবলারের রোজা ভাঙার সুবিধার্থে কিছুক্ষণের জন্য খেলা বন্ধ রাখা হয় - যা আগে কখনও হয়নি৷
কেন্দ্রীয় পশু নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী অ্যানেস্থসিয়া ছাড়া পশু হত্যা নিষিদ্ধ৷ হালাল ও ইহুদিদের কোশর রীতির ক্ষেত্রেও এই আইন প্রযোজ্য৷
জার্মানির সবচেয়ে বড় মসজিদ
জার্মানির সবচেয়ে বড় মসজিদটির নির্মান কাজ শুরু হয় ২০০৯ সালে, কোলনে৷ ২০১৭ সালে এটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে৷ ইতোমধ্যে বেশ বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে এই মসজিদ নিয়ে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Becker
ইউরোপের অন্যতম বড় মসজিদ
কোলনের কেন্দ্রীয় মসজিদ হিসেবে পরিচিত এই মসজিদটি ইউরোপের অন্যতম বড় এবং জার্মানির সবচেয়ে বড় মসজিদ৷ এটির আয়তন ৪৫০০ বর্গমিটার৷ এতে একসঙ্গে দুই থেকে চার হাজার মুসল্লির নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা রয়েছে৷ জার্মানিতে তুর্কি মুসলিমদের সংগঠন ডিটিব মসজিদটি নির্মাণ করেছে৷ নামাজের পাশাপাশি সেখানে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সংলাপ, খেলাধুলা আয়োজনের ব্যবস্থা এবং দোকান ও লাইব্রেরি রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/O. Berg
ভিন্ন ডিজাইনের মসজিদ
‘নন-অটোমান’ ডিজাইন অনুসরন করে মসজিদটি তৈরি করা হয়েছে৷ এতে কংক্রিট এবং কাঁচের দেয়াল ও গম্বুজ রয়েছে৷ দু’টি মিনারতের উচ্চতা ৫৫ মিটার করে৷ আর মসজিদের ভেতরে দেয়ালে বিভিন্ন ক্যালিগ্রাফি রয়েছে৷
ছবি: Picture alliance/dpa/M. Becker
দীর্ঘদিনের স্বপ্ন
কোলনে বসবাসরত তুর্কিরা দীর্ঘদিন ধরেই এমন এক মসজিদের স্বপ্ন দেখছিলেন৷ তবে মসজিদটির নির্মাণ কাজ শুরুর পর নানা বিতর্ক সৃষ্টি হয়৷ এমনকি ২০১১ সালে বিপুল প্রতিবাদের মুখে এটির নির্মাণকাজ কিছুদিনের জন্য মন্থরও করা হয়৷ অভিবাসীবিরোধী চক্র এটি নির্মাণের বিরোধিতা করে৷ তবে পত্রিকার এক জরিপে দেখা যায়, শহরের ৬৩ শতাংশ বাসিন্দা এটি তৈরির পক্ষে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চোখে পড়ার মতো স্থাপনা
জার্মানিতে প্রায় পাঁচ মিলিয়নের মতো মুসলমান বাস করেন৷ তাঁদের একটি বড় অংশই তুর্কি বংশোদ্ভূত৷ কোলনে বসবাসরত সোয়া লাখ মুসলমানের জন্য সত্তরটির মতো মসজিদ রয়েছে৷ অধিকাংশ মসজিদই এমন জায়গায় তৈরি যা সচরাচর চোখে পড়েনা৷ তবে এই মসজিদটি ব্যতিক্রম৷
ছবি: Picture alliance/dpa/O. Berg
খরচ কম নয়
মসজিদটি তৈরিতে কমপক্ষে সতের মিলিয়ন ইউরো খরচ হয়েছে৷ তবে এখনও কিছু কাজ বাকি রয়েছে বলে জানা গেছে৷ এই অর্থের অধিকাংশই দিয়েছে ডিটিব৷ কিছু অর্থ সংগ্রহে সহযোগিতা করেছে একটি গির্জা৷
ছবি: picture alliance/dpa/Geisler
পল ব্যোম, স্থপতি
কোলন কেন্দ্রীয় মসজিদটির নকশা করেছেন পল ব্যোম৷ তিনি এবং তাঁর বাবা মূলত গির্জার ডিজাইন করার জন্য বিখ্যাত৷ তবে সমজিদটি তৈরির মাধ্যমে তিনি তাঁর দক্ষতাকে অন্যস্তরে নিয়ে গেছেন৷
ছবি: AP
প্রার্থনার এক স্বচ্ছ ঘর
‘উন্মুক্ত’ এবং ‘উজ্জ্বল’৷ মসজিদটির ডিজাইন সম্পর্কে এই দুটো শব্দই উচ্চারণ করেছেন ব্যোম৷ মসজিদটির মধ্যে প্রাকৃতিক আলো নিশ্চিত করতে দেয়ালে প্রচুর কাঁচ ব্যবহার করা হয়েছে৷ আর মসজিদটি অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের জন্যও উন্মুক্ত৷ যেকেউ সেখানে প্রবেশ করতে পারেন৷
ছবি: Lichtblick Film GmbH/Raphael Beinder
জার্মান স্টাইলে তৈরি মসজিদ
কোলনের মানুষ মসজিদটিকে স্থানীয় ভাষায় বলেন, ‘ক্যোলশ ম্যুশি’৷ আর মসজিদটির ডিজাইনেও জার্মান ছোঁয়া রয়েছে৷ প্রচলিত তুর্কি মসজিদগুলো যেরকম, এই মসজিদটি মোটেও সেরকম নয়৷
ছবি: picture alliance / dpa
কিছু শর্ত
কোলন কর্তৃপক্ষ মসজিদটি নির্মাণের অনুমতি দেয়ার পাশাপাশি কিছু শর্তও জুড়ে দিয়েছে৷ এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, সেখানে জার্মান ভাষা শিক্ষার আয়োজন থাকতে হবে৷ পাশাপাশি ইমামকে জার্মান ভাষায় দক্ষ হতে হবে৷ আর খুতবা দিতে হবে এমন ভাষায়, যা নামাজ পড়তে আসা মুসল্লিরা বুঝতে পারেন৷ মোটের উপর, প্রার্থনায় অংশ নিতে আসা পুরুষ এবং নারীদের সমান মর্যাদা দিতে হবে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
9 ছবি1 | 9
২০১৫ সালে জার্মানির ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত সরকারি স্কুলে শিক্ষকদের হেডস্কার্ফ পরার উপর নিষেধাজ্ঞা ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিপন্থি বলে রায় দেয়৷ তবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা রাজ্যগুলোর উপর ছেড়ে দেয়া হয়৷
২০১৯ সালে দুই হাজার ৩২টি ইহুদি-বিদ্বেষী ঘটনা ঘটে৷ এর মধ্যে ৭২টি সহিংস ছিল৷ বাকিগুলো মৌখিক হয়রানি, হুমকি, বৈষম্য ও ভাঙচুরের ঘটনা ছিল৷
২০২০ সালে এক হাজার ২৬টি মুসলিমবিরোধী হামলা হয়েছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে৷
গত অক্টোবরে কোলন শহরের মসজিদগুলোকে আগামী দুই বছরের জন্য প্রতি শুক্রবার দুপুর ১২টা থেকে তিনটার মধ্যে সর্বোচ্চ পাঁচ মিনিটের মধ্যে মাইকে আজান দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়৷ তবে মসজিদের অবস্থান ভেদে মাইকের শব্দ মাত্রা ঠিক করে নিতে বলা হয়েছে৷ কোলনের কেন্দ্রীয় মসজিদ জার্মানির মধ্যে সবচেয়ে বড়৷ জার্মানির উগ্র ডানপন্থি দলগুলোর মুসলিমবিরোধী তৎপরতার লক্ষ্য হচ্ছে এই মসজিদ৷
২০২০ সালে বাডেন-ভ্যুর্টেমব্যার্গ স্কুল শিক্ষার্থীদের মুখ ঢাকা পোশাক পরার উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়৷ শিক্ষকদের জন্য এই নিষেধাজ্ঞা আগে থেকেই কার্যকর ছিল৷
বিভিন্ন কোম্পানি কিছু শর্তের আওতায় কর্মীদের হেডস্কার্ফ পরে কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা দিতে পারবে বলে গত জুলাইতে একটি রায় দিয়েছিল ইউরোপিয়ান কোর্ট অফ জাস্টিস৷ জার্মানিতে দুজন মুসলিম নারী কর্মক্ষেত্রে যোগ দেয়ার কয়েক বছর পর মাতৃত্বকালীন ছুটি থেকে ফিরে হেডস্কার্ফ পরা শুরু করলে তাদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়৷ এরপর তারা মামলা করলে ইউরোপীয় আদালত ঐ রায় দেয়৷
যুক্তরাজ্য
ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে আইন করে ধর্মীয়ভাবে অনুপ্রাণিত বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রদান এবং শব্দ ব্যবহার বা লিখিত উপাদান প্রকাশ বা বিতরণের মাধ্যমে ধর্মীয় বিদ্বেষ উসকে দেওয়ার উদ্দেশ্যে কোনো কাজ নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷
সরকারি স্কুলগুলোতে তিন থেকে ১৮ বছরের শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় শিক্ষা ও প্রার্থনা বাধ্যতামূলক৷ ধর্মীয় শিক্ষার পাঠ্যসূচিতে ‘খ্রিষ্টান মূল্যবোধের’ প্রতিফলন ঘটাতে বলা হয়েছে৷ তবে বাবা-মা চাইলে তাদের বাচ্চাদের ধর্মীয় শিক্ষা থেকে অব্যহিত চাইতে পারে৷
ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের সরকারি স্কুলগুলোতে প্রতিদিন সম্মিলিতভাবে প্রার্থনা (পুরোপুরি বা প্রধানত... খ্রিষ্টান ধর্মীয়) আয়োজনও বাধ্যতামূলক৷ তবে এক্ষেত্রেও মা-বাবা চাইলে তাদের বাচ্চাদের প্রার্থনা থেকে অব্যহিত চাইতে পারে৷
স্কুলের পোশাক নির্ধারণের সময় কর্তৃপক্ষকে বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর রীতিনীতি বিবেচনায় নিতে বলা হয়েছে৷
নিউজিল্যান্ডে মসজিদের হামলার এক বছর পূর্তিতে ২০২০ সালের মার্চে যুক্তরাজ্য সরকার মুসলিম, খ্রিষ্টান, শিখ ও হিন্দুদের প্রার্থনাস্থলে নিরাপত্তা বাজেট দ্বিগুন করার ঘোষণা দেয়৷
রাজনৈতিকদলেরউদ্যোগ
অর্থোডক্স, ক্যাথলিক, প্রোটেস্ট্যান্ট, ইসলাম ও ইহুদিদের মধ্যে ধর্মীয় শান্তি বজায় রাখতে প্রতিবছর সম্মেলন আয়োজন করে ইউরোপিয়ান পিপলস পার্টি৷ ইউরোপীয় সংসদের সাংসদ, ধর্মীয় নেতা, সরকারি প্রতিনিধি, এনজিও প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্টরা এসব সম্মেলনে অংশ নিয়ে থাকেন৷
জাহিদুল হক (পিউ রিসার্চ, মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন)