জামাল খাশগজি, ডাফনি কারুয়ানা গালিৎসিয়া, ইয়ান কুৎসিয়াক– এঁদের হত্যা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত বলে মনে করেন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস-এর ক্রিস্টোফ ডেলোয়ার৷
বিজ্ঞাপন
বিশ্বের প্রতি দুইজনে একজন মানুষ স্বাধীনভাবে পরিবেশিত সংবাদ এবং তথ্যের সন্ধান পান না৷ ইউরোপীয় হিসেবে আমরা বেশ সৌভাগ্যবান যে আমরা, ‘অন্য সবার স্বাধীনতার মর্যাদা দেয়ার মতো’ স্বাধীনতা ভোগ করি৷
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ)-এর প্রকাশ করা ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স অনুসারে আমাদের মহাদেশেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সবচেয়ে বেশি রয়েছে৷ কিন্তু এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে, গত কয়েক বছরে এই ভিত্তি বেশ ভালোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷
ইস্তানবুলে খাশগজির হত্যা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সাংবাদিকদের ওপর কিছু দেশের ভয়াবহ বর্বরতার কথা৷
ইউরোপও এর বাইরে নয়৷ মালটায় ডাফনি কারুয়ানা গালিৎসিয়াকে অর্থ পাচার কেলেঙ্কারি নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করায় হত্যা করা হয়েছিল৷ স্লোভাকিয়ায় ইয়ান কুৎসিয়াক বড় আকারের কর ফাঁকি নিয়ে অনুসন্ধান করায় হত্যা করা হয়৷ এই হত্যাকাণ্ডগুলো গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর বড় ধরনের আঘাত৷ এ ঘটনাগুলো থেকে প্রমাণ হয় যে, এ সমস্যার শেকড় বহুদূর বিস্তৃত৷
গণমাধ্যমের প্রতি কিছু রাজনৈতিক নেতার অবিরাম বিষোদগার ইউরোপে সাংবাদিকতাকে দুর্বল করে ফেলছে৷ এদের কেউ কেউ এরই মধ্যে ক্ষমতায় আছেন, কেউ কেউ যাওয়ার চেষ্টা করছেন৷ ফ্রান্সে ইয়েলো ভেস্ট আন্দোলনের সংবাদ প্রচার করতে গিয়ে অনেক সাংবাদিকই অনেকের চক্ষুশূল হয়েছেন৷ কাউকে কাউকে তো ধর্ষণের হুমকিও দেয়া হয়েছে৷
হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান একই ধরনের ‘অবিশ্বাস’ উসকে দেন, যখন তিনি তাঁর দলের পক্ষে সংবাদ প্রচার করে না এমন মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান এবং তাদের ‘ভুয়া সংবাদ’ বলে খারিজ করে দেন৷
আমরা এমন পরিস্থিতিতে চুপ করে বসে থাকচতে পারি না৷ সুনির্দিষ্ট কিছু সমস্যা চিহ্নিত হয়েছে, যার বিরুদ্ধে ইউরোপ শক্ত ব্যবস্থা নিতে পরে৷ এর মধ্যে একটি হলো আইনি হয়রানি৷ কিছু ব্যক্তি আইনের অপব্যবহার করে একের পর এক মামলা করে সাংবাদিকদের ওপর এমন চাপ সৃষ্টি করে যে, সে সাংবাদিক চুপ হয়ে যেতে বাধ্য হয়৷
২০১৯ সালেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব, যদি ইউরোপীয় নির্বাচনগুলোতে মহাদেশজুড়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়টিতে জোর দেয়া হয়৷
ইইউ কমিশনারের প্রয়োজনীয়তা
অন্য সব পাবলিক পলিসির মতো গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এ বৈচিত্র্য রক্ষারও সুনির্দিষ্ট নীতি থাকা উচিত৷ এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সুনির্দিষ্ট ম্যান্ডেট দিয়ে একজন কমিশনারকে নিয়োগ দেয়া হোক, পরবর্তী ইউরোপীয় কমিশনের কাছে এটাই আমাদের দাবি৷ বুখারেস্ট থেকে মাদ্রিদ, নিকোসিয়া থেকে স্টকহোম, ডাবলিন থেকে ভিয়েনা, একজন উচ্চ-পর্যায়ের প্রতিনিধি থাকা উচিত, স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হলে যার কাছে যাওয়া যাবে৷
তাঁকে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে হবে, সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সংবাদ প্রকাশের অধিকার বিষয়ে নিয়মিত সংলাপ আয়োজন করতে হবে এবং ইইউ-তে প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কারের পদক্ষেপ নিতে হবে৷
করপোরেট সংস্থাগুলোর হাতে সংবাদমাধ্যম চলে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা গণমাধ্যমকে মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যূত করে নিজেদের অথবা সরকারে থাকা নিজেদের বন্ধুদের কাজে লাগানোর সুযোগ পাচ্ছেন৷ গণমাধ্যমকে এই কর্পোরেট স্বার্থরক্ষার হাত থেকে বাঁচাতে হবে৷
স্ট্রাসবুর্গে হতে যাওয়া ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের নির্বাচনে প্রার্থীদের আমরা আহ্বান জানাই, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় কমিশন নেতারা যাতে সচেষ্ট হন৷
বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স৷ সাংবাদিকদের সব সময় ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয় এমন দেশগুলোর উল্লেখ তো আছেই, সঙ্গে মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য প্রশংসিত ইউরোপের সমালোচনাও রয়েছে প্রতিবেদনে৷
ছবি: Imago/IPON
সাংবাদিকদের সবচেয়ে বড় ‘জেলখানা’ তুরস্ক
কোন দেশে গণমাধ্যম কতটা স্বাধীন বা পরাধীন, তা মূল্যায়ন করে প্রকাশিত এ বার্ষিক প্রতিবেদনে তুরস্ককে উল্লেখ করা হয়েছে ‘সাংবাদিকদের সবচেয়ে বড় জেল’ হিসেবে৷ ২০১৬ সালের কথিত ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর থেকে সে দেশে অনেক সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করেছে এর্দোয়ান সরকার৷ প্রতিবেদনে তুরস্ক আছে ১৫৭ নম্বরে৷
ছবি: Reuters/M. Cetinmuhurdar
গণমাধ্যমের ‘শত্রু’ ট্রাম্প
ট্রাম্পের আমলে যুক্তরাষ্ট্রে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্রমাগত প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে বলে মনে করে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স৷ ট্রাম্পকে প্রায়ই মিডিয়ার বিরুদ্ধে আপত্তিকর কথা বলতে শোনা যায়৷ গণমাধ্যমকে ‘জনগণের শত্রু’ বলে বিষোদগার করতেও দেখা গেছে তাঁকে৷ তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ৪৫তম স্থানে৷
ছবি: Reuters/K. Lamarque
রাশিয়া এবং চীনে গণমাধ্যমের দুরবস্থা
রাশিয়া, চীন এবং উত্তর কোরিয়ারও সমালোচনা করেছে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স৷ প্রতিবেদনে বলা হয়, পুটিন ক্রেমলিনে ফেরার পর থেকে নানাভাবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করা হচ্ছে৷ সাংবাদিকরা গ্রেপ্তার হচ্ছেন৷ সাম্প্রতিক সময়ে অন্তত ৫০ জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করার কথা উল্লেখ করে চীনেরও সমালোচনা করেছে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স৷ তালিকায় রাশিয়ার অবস্থান ১৪৮, চীন তার অনেক নীচে ১৭৬তম স্থানে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Klimentyev
সেরা দশে এখনো ইউরোপের প্রাধান্য
গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য ইউরোপ সবসময়ই প্রশংসিত৷ এবারও সেরা দশে ইউরোপেরই প্রাধান্য৷ তাই প্রথম থেকে পঞ্চম স্থানে রয়েছে যথাক্রমে নরওয়ে, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস, ফিনল্যান্ড এবং সুইজারল্যান্ড৷ তারপর সপ্তম ও নবম স্থানেও ইউরোপের দুই দেশ বেলজিয়াম ও ডেনমার্ক৷ সবাইকে অবাক করে সেরা দশের ষষ্ঠ স্থানে ঢুকে পড়েছে ক্যারিবীয় দেশ জ্যামাইকা৷ নবম স্থানে রয়েছে নিউজিল্যান্ড৷
ইউরোপের কয়েকটি দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ভয়ানকভাবে খর্ব হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স৷ গাড়িবোমা বিস্ফোরণে সাংবাদিক, ব্লগার ডাফনে কারুয়ানা গালিজিয়া নিহত হওয়ার পর ১৮ ধাপ পিছিয়ে ৬৫ নম্বরে নেমে গেছে মাল্টা৷ স্লোভাকিয়াতেও এক সাংবাদিক নিহত হয়েছেন৷ তাই সেই দেশ ১০ ধাপ পিছিয়ে ২৭-এ৷ সাংবাদিকদের ‘স্লোভাকবিরোধী নোংরা বেশ্যা’ বলেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ফিকো৷
ছবি: picture alliance/AP/P.D. Josek
সবচেয়ে খারাপ কারা?
১৮০টি দেশকে নিয়ে তৈরি করা তালিকার শেষ দশে ইউরোপের কোনো দেশ নেই৷ সেখানে ১৭১তম দেশ ইকোয়েটোরিয়াল গিনি৷ তারপর থেকে ১৮০তম স্থান পর্যন্ত যথাক্রমে রয়েছে কিউবা, জিবুতি, সুদান, ভিয়েতনাম, চীন, সিরিয়া, তুরস্ক, ইরিত্রিয়া এবং উত্তর কোরিয়া৷
ছবি: picture-alliance/Yonhap
এবং বাংলাদেশ
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে অন্তত ২৫ জন সাংবাদিক ও কয়েকশ’ ব্লগার এবং ফেসবুক ব্যবহারকারীর বিরুদ্ধে আইসিটি অ্যাক্টে মামলা হয়েছে৷ দেশে সংবিধান এবং ইসলামের সমালোচনা করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে আরো বলা হয়, বাংলাদেশে প্রায়ই স্পষ্টবাদী ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তি, সাংবাদিক এবং ব্লগারদের অনলাইনে হত্যার আহ্বান জানায় ইসলামী জঙ্গিরা৷ সূচকে এবার বাংলাদেশের অবস্থান আগের বছরের মতোই আছে, ১৪৬৷