মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে ইরান, মধ্যপ্রাচ্য, চীন ইত্যাদি বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসন ও ইউরোপের মধ্যে আরো সংঘাতের আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ মার্কিন পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী এমন বার্তা নিয়ে আসছেন৷
বিজ্ঞাপন
বাৎসরিক মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে গোটা বিশ্বের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র নীতির প্রতিফলন দেখা যায়৷ নেতাদের ভাষণের পাশাপাশি আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই নেপথ্যে এমন সব সংলাপের পথ খুলে যায়, যা সহজে সম্ভব হয় না৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই মঞ্চের গুরুত্ব যেন আরও বেড়ে গেছে৷ চলতি বছর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এস্পারের উপস্থিতি সেই ধারা বজায় রাখবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে৷
ট্রাম্পের কার্যকালে অ্যামেরিকা ও ইউরোপের মধ্যে ব্যবধান বেড়েই চলেছে৷ বার বার দুই পক্ষের স্বার্থের সংঘাত দেখা যাচ্ছে৷ ট্রাম্প তাঁর নিজস্ব আন্তর্জাতিক অ্যাজেন্ডা কার্যকর করতে গিয়ে ইউরোপের সমর্থন পাচ্ছে না৷ অন্যদিকে ইউরোপের স্বার্থ রক্ষার প্রশ্নে আর আগের মতো অ্যামেরিকার সমর্থন দেখা যাচ্ছে না৷ আপাতত ট্রাম্প প্রশাসন আফগানিস্তানে শান্তি চুক্তি চূড়ান্ত করতে ব্যস্ত৷ ইরানের উপর আরও কড়া নিষেধাজ্ঞা চাপানোর তোড়জোড় করছে ওয়াশিংটন৷ ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে শান্তি আনতে বিতর্কিত এক পরিকল্পনা পেশ করেছেন ট্রাম্প৷ ফাইভ-জি যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রসারে চীনের হুওয়ায়েই কোম্পানির প্রভাব যতটা সম্ভব কম রাখার জন্য ইউরোপের উপর চাপ সৃষ্টি করে চলেছে অ্যামেরিকা৷
শুক্রবার মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলন শুরু হচ্ছে৷ সেখানে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরফ গনিও উপস্থিত থাকবেন৷ শুক্রবারই পম্পেও ও এস্পার তাঁর সঙ্গে বৈঠকে বসবেন৷ সাত দিন ধরে হিংসা কমানোর বোঝাপড়ার ভিত্তিতে আফগানিস্তানের বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের চেষ্টা চলছে৷ সেই প্রচেষ্টা সফল হলে ট্রাম্প আফগানিস্তান থেকে আরও মার্কিন সৈন্য দেশে ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর৷ নির্বাচনের বছরে এমন পদক্ষেপ তাঁর জন্য সুবিধাজনক হবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে৷ এতকাল তিনি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী খুব বেশি মার্কিন সৈন্য দেশে ফেরাতে পারেন নি৷
ট্রাম্প প্রশাসন এককভাবে ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি প্রত্যাহার করে সন্তুষ্ট নয়৷ জার্মানি, ফ্রান্স ও ব্রিটেনকেও সেই চুক্তি বর্জনের জন্য চাপ দিয়ে চলেছে ওয়াশিংটন৷ ইরান চুক্তির শর্ত মানছে না, এমন অজুহাতে সে দেশের উপর জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা আবার চাপাতে চান ট্রাম্প৷ অথচ ইউরোপ সে পথে এগোতে নারাজ৷ বরং ইরানের সঙ্গে বিরোধ মেটাতে জাতিসংঘের দ্বারস্থ হওয়ায় ওয়াশিংটন আরও বিরক্ত হয়েছে৷ পম্পেও ইউরোপের নেতাদের উপর আরও চাপ বাড়াতে পারেন বলে অনুমান করা হচ্ছে৷ মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে এই মর্মে ইঙ্গিত দিয়েছে৷ ইরান পরমাণু চুক্তিকে কেন্দ্র করে অ্যামেরিকার সঙ্গে বাকি স্বাক্ষরকারী দেশগুলির বিরোধ চরমে উঠলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে৷
ইরানের বিভিন্ন গণমাধ্যম মার্কিন ঘাঁটিতে হামলায় ৮০ জন নিহতের তথ্য জানালেও ট্রাম্প বললেন ভিন্ন কথা৷ ভাষণে ডনাল্ড ট্রাম্প বলেন, এই হামলায় কোনো মার্কিন বা ইরাকি নিহত হননি৷ ট্রাম্পের বক্তব্যের মূল অংশগুলো দেখুন এই ছবিঘরে৷
ছবি: AFP/S. Loeb
প্রতীক্ষিত ভাষণ
ইরানের হামলার পরপরই বেশ কিছু দেশ তাদের কোনো সৈন্য নিহত হয়নি জানালেও, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু জানায়নি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ রাতে টুইট করে ‘সব ঠিক আছে’ বললেও ক্ষতির পরিমাণ অ্যামেরিকার স্থানীয় সময় সকালে জানাবেন বলেও জানান ট্রাম্প৷ ভাষণের সময় ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স, প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক স্পেনসার, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এবং ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা ছিলেন ট্রাম্পের পাশে৷
ছবি: AFP/S. Loeb
‘ইরান পরমাণু অস্ত্র পাবে না’
ভাষণের প্রথম বাক্যেই ট্রাম্প বলেন, ‘‘আমি যতদিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট আছি, ইরানকে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে দেয়া হবে না৷’’ তিনি বলেন, ‘‘পরমাণু বোমার পেছনে ছুটে ইরান ‘সভ্য’ বিশ্বকে হুমকির মুখে ফেলেছে৷ আমরা তা কখনও হতে দেবো না৷’’
ট্রাম্প জানান, ইরানের হামলায় কোনো অ্যামেরিকান বা ইরাকি আঘাতপ্রাপ্ত হননি৷ কেউই হতাহতও হননি৷ সব মার্কিন সৈন্য নিরাপদে আছে এবং সেনা ঘাঁটিতেও খুব সামান্য ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে৷ পূর্বসতর্কীকরণ ব্যবস্থা, আক্রমণ ঠেকানোর সক্ষমতার জন্য মার্কিন সেনাদের ধন্যবাদও জানান ট্রাম্প৷
ছবি: picture-alliance/dpa/N. Nasser
‘পিছু হটেছে’ ইরান
মার্কিন সেনাবাহিনীকে ‘মহান’ এবং শক্তিশালী উল্লেখ করে তিনি বলেন, শক্তি থাকলেই তা ব্যবহার করতে হবে তা তিনি মনে করেন না৷ ইরাকের মার্কিন ঘাঁটিতে হামলার পর ইরান ‘পিছু হটেছে’ বলে মনে করেন ট্রাম্প৷ ইরানের এমন অবস্থান সকল পক্ষ এবং বিশ্বের জন্যেও ভালো বলে মন্তব্য করেন তিনি৷
ছবি: Mehr
‘সন্ত্রাসী সোলেইমানি’
ইরাকে মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত ইরানের কুদস ফোর্সের কমান্ডার কাসেম সোলেইমানিকে বিশ্বের ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ বলে উল্লেখ করেন ট্রাম্প৷ তিনি বলেন, হেজবুল্লাহর মতো ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠনকে প্রশিক্ষণ দেয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি করা, রাস্তার পাশে বোমা পেতে রাখা এবং হাজার হাজার মার্কিন নাগরিককে হত্যা করার অভিযোগ ছিল সোলেইমানির বিরুদ্ধে৷
ইরানের সঙ্গে বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর পরমাণু চুক্তি ‘ছুঁড়ে ফেলার’ আহ্বান জানিয়েছেন ট্রাম্প৷ ওবামার শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু চু্ক্তিতে স্বাক্ষর করলেও ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর চুক্তি থেকে নাম প্রত্যাহার করেন৷ চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী অন্য দেশগুলো- জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া ও চীনকেও চুক্তি বাতিল করতে আহ্বান জানালেন ট্রাম্প৷ সোলেইমানি হত্যার পর ইরান এ চুক্তি না মানার ঘোষণা দিয়েই রেখেছে৷
ছবি: picture-alliance/abaca/SalamPix
‘চুক্তির টাকায় সন্ত্রাস’
ট্রাম্প দাবি করেন, পরমাণু চুক্তির ফলে বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে পাওয়া অর্থে মধ্যপ্রাচ্যে ‘সন্ত্রাসী কার্যক্রম’ চালাচ্ছিল ইরানের বর্তমান সরকার৷ তিনি বলেন, এর ফলে ইয়েমেন, সিরিয়া, লেবানন, আফগানিস্তান এবং ইরাক ‘নরকে’ পরিণত হয়েছে৷
ছবি: AFP/Iranian Presidency
আরো অবরোধ
ইরানের বিরুদ্ধে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট৷এই নিষেধাজ্ঞা আরো কঠোর হবে বলেও ঘোষণা দেন তিনি৷ নতুন অবরোধ কেমন হবে সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু উঠে আসেনি তার বক্তব্যে৷ তবে ইরান তার ‘ব্যবহার’ পরিবর্তন করার আগ পর্যন্ত এ অবরোধ জারি থাকবে বলেও জানান তিনি৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Brandon
নতুন অস্ত্র আসছে
মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক জোট ন্যাটোকে আরো বেশি সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ট্রাম্প৷ নিজের প্রশাসনের অধীনে আড়াই লাখ কোটি ডলার খরচ করে মার্কিন সেনাবাহিনীকে ঢেলে সাজানো হয়েছে বলে জানান তিনি৷ তিনি বলেন, ‘‘মার্কিন সেনাবাহিনী আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি শক্তিশালী৷ আমাদের বড়, শক্তিশালী, নির্ভুল, প্রাণঘাতি এবং দ্রুতগামী মিসাইল রয়েছে৷ হাইপারসনিক মিসাইল তৈরি হচ্ছে৷’’
ছবি: picture-alliance/AP Photo/U.S. Department of Defense/S. Apel
ইরানের প্রতি আহ্বান
ভাষণের শেষে ইরানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও এবং জনতাকে সম্বোধন করেন ট্রাম্প৷ তিনি বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ইরানিদের জন্য ‘দারুণ’ এক স্বপ্নের ভবিষ্যত চান তিনি৷ যারা শান্তি চায়, তাদের পাশে দাঁড়াতে অ্যামেরিকা সর্বদা প্রস্তুত বলেও ভাষণে বলেন ট্রাম্প৷