তাইওয়ান নিয়ে ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাক্রোঁর মন্তব্যে আলোড়ন পড়ে গেছে। ইইউ-র সার্বভৌমত্ব নিয়ে মন্তব্য করেছেন মাক্রোঁ।।
বিজ্ঞাপন
ছয় বছর আগে মাক্রোঁ প্রথম ইউরোপীয় ইউনিয়নের সার্বভৌমত্বের বিষয়ে বলেছিলেন। ইইউ-তে বারবার 'কৌশলগত স্বশাসন' কথাটা ব্যবহার করা হয়। দুটোর মানে একই, তা হলো, গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক ও আর্থিক বিষয়ে অন্য কোনো দেশের মুখাপেক্ষি না থেকে ইইউ নিজের মতো করে নীতি নিতে পারা। এটাই ইইউ পার্লামেন্টের থিংক ট্যাংকের বক্তব্য।
সম্প্রতি চীন সফর সেরে ফেরার পথে মাক্রোঁ আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কাছে আবার ইইউ-র সার্বভৌমত্বের প্রশ্নটি তুলেছেন। তাইওয়ান নিয়ে তার মন্তব্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে প্রবল বিতর্ক শুরু হয়েছে। মাক্রোঁ সেখানে বলেছেন, ইইউ-কে অ্যামেরিকার উপর নির্ভরতা কম করতে হবে। সব বিষয়ে অ্যামেরিকার লাইন নেয়ার প্রবণতা থেকে সরে আসতে হবে।
এই সপ্তাহের গোড়ায় ইইউ-র সার্বভৌমত্ব নিয়ে তার ভিশন কী, সেটা বলেছেন মাক্রোঁ। গত মঙ্গলবার হেগ-এ মাক্রোঁ আর্থিক সার্বভৌমত্বের কথা বলেছেন। প্রশ্ন হলো, তার এই মত কি রূপায়ণ করা যেতে পারে?
চীনের উপর ইইউ-র নির্ভরতা
মাক্রোঁর আর্থিক স্বনির্ভরতার পাঁচটি স্তম্ভ আছে, প্রতিযোগিতা, শিল্প নীতি, বাজার সুরক্ষা, বাণিজ্যিক সম্পর্কে পারস্পরিক সুবিধা দেয়ার নীতি এবং সহযোগিতা।
ইউক্রেন ছেড়ে আসা মানুষের জন্য ইইউ-র নীতি
রাশিয়ার হামলার পর ইউক্রেন ছেড়ে প্রতিবেশী দেশগুলিতে চলে এসেছেন প্রায় ৬০ লাখ মানুষ। শেষপর্যন্ত কোথায় আশ্রয় পাবেন তারা?
ছবি: Fabrizio Bensch/REUTERS
প্রথমে প্রতিদিন এক লাখ করে
রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত শুরু হওয়ার পর প্রথমদিকে দিনে এক লাখ করে মানুষ ইউক্রেন ছেড়েছেন। প্রাণ বাঁচাতে তারা চলে গেছেন প্রতিবেশী দেশগুলিতে। উপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, পোল্যান্ডের একটি স্টেশনে ইউক্রেন থেকে আসা মানুষদের সাময়িকভাবে রাখা হয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের কমিশনার ফর হোম অ্যাফেয়ার্স জানিয়েছে, এখন দিনে ৪০ হাজার মানুষ ইউক্রেন ছেড়ে ইউরোপের দেশগুলিতে আসছে।
ছবি: Fanny Facsar/DW
অর্ধেক বাচ্চা
যারা ইউক্রেন ছেড়ে ইউরোপের দেশগুলিতে আশ্রয় নিচ্ছেন, তাদের অর্ধেকই বাচ্চা। আসলে বহু পুরুষ ও নারী হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছেন। তারা বয়স্ক ও বাচ্চাদের পাঠিয়ে দিয়েছেন নিরাপদ আশ্রয়ে। উপরের ছবিটি স্লোভানিয়ায় ইউক্রেন থেকে আসা বাচ্চাদের।
ছবি: Robert Nemeti/AA/picture alliance
সবচেয়ে বেশি মানুষ পোল্যান্ডে
পোল্যান্ডেই ২২ লাখের বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। পোল্যান্ড জানিয়েছে, এত কম সময়ের মধ্যে এত মানুষ আশ্রয় নেয়ায় তাদের অভিবাসন নীতি ভেঙে পড়ার মুখে।
ছবি: Sergei Grits/AP/picture alliance
জার্মানিতে তিন লাখ
জার্মান চ্যান্সেলর ওলফ শলৎস জানিয়েছেন, ইউক্রেন থেকে তিন লাখ মানুষ জার্মানিতে এসেছেন। উপরের ছবিতে বার্লিনের সেন্ট্রাল স্টেশনের সামনে ইউক্রেন থেকে আসা মানুষরা।
ছবি: Michael Kuenne/PRESSCOV/Zuma/picture alliance
জার্মানির প্রস্তাব
জার্মানির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ন্যান্সি ফ্রেজার চিঠি লিখে পোল্যান্ডের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, ইউক্রেন ছেড়ে আসা প্রত্যেকের জন্য ইইউ-র সদস্য দেশগুলি এক হাজার ইউরো করে দিক। ছবিতে পোল্যান্ডের একটি স্টেডিয়ামে ইউক্রেন থেকে আসা মানুষদের প্রবেশের জন্য লম্বা লাইন।
ছবি: Beata Zawrzel/NurPhoto/picture alliance
ইইউ-র সিদ্ধান্ত
ইইউ-র মন্ত্রীরা সোমবার বৈঠকে বসে ১০ দফা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। সেখানে বলা হয়েছে, ইউক্রেন থেকে আসা মানুষদের রেজিস্ট্রেশনের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হবে। তাদের যাতায়াত ও পরিবহণের জন্য একটি হাব তৈরি করা হবে। ইইউ কমিশন সেফ হোম নীতি নেবে। তার ফলে যেখানে সবচেয়ে বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন, সেখান থেকে অন্য দেশে কিছু মানুষকে নিয়ে যাওয়া হবে।
ছবি: Hannibal Hanschke/Getty Images
সহযোগিতার সিদ্ধান্ত
ইইউ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বিভিন্ন দেশে ইউক্রেন থেকে আসা মানুষদের পুনর্বাসনের জন্য সাহায্য করা হবে। এই মানুষদের পাশে দাঁড়াবে সব দেশ। প্রতিটি দেশকে সাধ্যমতো শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে বলা হয়েছে। উপরের ছবিতে ওয়ারশর একটি স্টেডিয়ামে ইউক্রেন ছেড়ে আসা মানুষদের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। অ্যামেরিকাও ইউক্রেন ছেড়ে আসা মানুষদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়াবে বলে জানিয়েছে।
ছবি: Evan Vucci/AP/picture alliance
কোটায় আপত্তি
কোটা ব্যবস্থায় আপত্তি আছে জার্মানির। তারা চায়, ইউক্রেন থেকে আসা মানুদের বিভিন্ন দেশে ভাগ করে রাখা হোক। সব দেশ যেন ইউক্রেন থেকে আসা মানুষদের প্রতি সমর্থন জানায়।
ছবি: Hannibal Hanschke/Getty Images
9 ছবি1 | 9
তার মত হলো, ইইউ-কে সবচেয়ে প্রতিযোগিতামূলক দামে ভালো মানের জিনিস উৎপাদন করতে হবে। এজন্য ইইউ-র প্রতিটি দেশের মধ্যে সম্পূর্ণ সহযোগিতা দরকার। তিনি ইইউ-র দেশগুলির সাধারণ শিল্প নীতির পক্ষে। এই নীতি বাজারকে আরো শক্তিশালী করবে। আর পরিবেশ নিয়ে ইইউ-র লক্ষ্যপূরণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তির উপর জোর দিতে হবে।
আর এখানেই চীনের উপর ইইউ-র নির্ভরশীলতা সামনে আসে। কলম্বিয়ার বার্সেলোনা সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের গবেষক কারণে কোলোমিনা ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''ডিজিটাল ও গ্রিন প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ইইউ চীনের উপর নির্ভরশীল। সম্প্রতি ইইউ কমিশন একটা নতুন আইন প্রস্তাব করেছে। সেই আইনে খুব জরুরি কাঁচামাল নিয়ন্ত্রণ করার কথা থাকবে।''
এই গবেষকের মতে, ''এই ধরনের আইন দ্রুত রূপায়ণ করা সম্ভব কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। বিশেষ করে, ইইউ যখন ইতিমধ্যেই এই ব্যাপারে চীনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।''
নিরাপত্তা নিয়ে অ্যামেরিকার উপর নির্ভরশীল
২০১৭ সালে মাক্রোঁ যখন ইউরোপের সার্বভৌমত্বের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন, তখন তিনি ইউরোপের যৌথ বাহিনী, সাধারণ প্রতিরক্ষা বাজেট, অ্যাকশনের জন্য যৌথ পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন।
ইইউ-অ্যামেরিকা বাণিজ্য
সম্প্রতি অ্যামেরিকার সঙ্গে ক্যানাডায় শীর্ষ সম্মেলনে জি-সেভেন নেতৃত্বের বাণিজ্য ভারসাম্য নিয়ে বেশ একচোট লড়াই হয়ে গেল৷ ছবিঘরে দেখে আসা যাক কেমন আসলে অ্যামেরিকা ও ইইউ-এর বাণিজ্য৷
ছবি: Imago/Hoch Zwei Stock/Angerer
এক ট্রিলিয়নেরও বেশি বাণিজ্য
অ্যামেরিকার সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক অঞ্চলগুলোর তালিকায় রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ অ্যামেরিকার মোট রপ্তানির ৫ ভাগের একভাগ হয় ইইউতে৷ আবার ইইউ থেকেও মোট রপ্তানির ৫ ভাগের একভাগ হয় অ্যামেরিকায়৷ ২০১৭ সালে অ্যামেরিকা ও ইইউ-এর বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৬৯ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার৷ এর মধ্যে ইইউ আমদানি করেছিল ২৫৬ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য বা সেবা৷ এর বিপরীতে অ্যামেরিকার আমদানি ছিল ৩৭৫ দশমিক ৮ বিলিয়ন ইউরো৷
ছবি: Imago/Hoch Zwei Stock/Angerer
ইইউ-এর বাণিজ্য উদ্বৃত্ত
অ্যামেরিকা ও ইইউভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে মূলত মেশিনারি, গাড়ি, কেমিক্যাল যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য শিল্পজাত পণ্য বাণিজ্য হয়৷ ২০১৭ সালে দুই দেশের বাণিজ্যের মোট ৮৯ শতাংশই এসব পণ্যের লেনদেনের মধ্য দিয়ে হয়েছে৷ খাদ্য এবং পানীয়সহ তিনটি রপ্তানি খাতে ইইউ-এর অ্যামেরিকার সাথে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে৷ তবে অ্যামেরিকা জ্বালানি এবং কাঁচামাল রপ্তানিতে ইইউ-এর তুলনায় এগিয়ে রয়েছে৷
ছবি: Reuters
রপ্তানির শীর্ষে গাড়ি ও যন্ত্রপাতি
অ্যামেরিকাতে ১৬৭ বিলিয়ন ইউরোর যন্ত্রপাতি ও মেশিনারি বিক্রি করে, যা এ অঞ্চলের মোট রপ্তানির ৪৪ দশমিক ৪০ শতাংশ৷ বিপরীতে ১১১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের যন্ত্রপাতি ও পরিবহন যোগাযোগ যন্ত্রপাতি ইইউতে রপ্তানি করে অ্যামেরিকা, যা দেশটি থেকে ইইউতে রপ্তানির ক্ষেত্রে শীর্ষ স্থান দখল করে আছে৷ আর ইইউ-এর মোট আমদানি ব্যয়ের এটি সাড়ে ৪৩ শতাংশ৷
ছবি: picture-alliance/U. Baumgarten
ক্ষুদ্র একটি অংশ!
এ বছরের মে মাসে অ্যামেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে ট্রাম্প প্রশাসন ইইউ থেকে ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম আমদানির ওপর ২৫ শতাংশ বাড়তি করারোপ করেছে৷ অথচ ইউরোপ থেকে অ্যামেরিকায় ২০১৭ সালে মাত্র ৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ইউরোর ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম আমদানি করেছিল৷
ছবি: Reuters/Y. Herman
প্রতিশোধমূলক করারোপ
ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্তের বিপরীতে ইউরোপীয় ইউনিয়নও কর বাড়ানোর জন্য অ্যামেরিকা থেকে আমদানি করা হয় এমন কিছু পণ্যের তালিকা করেছে৷ এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে চিনাবাদাম থেকে তৈরি মাখন, বোরবন হুইস্কি, হার্লে ডেভিডসন মোটরসাইকেল, জিন্স এবং কমলার রস৷ এসব আমদানি পণ্যের মোট মূল্য ২ দশমিক ৮ বিলিয়ন ইউরো বলে জানিয়েছেন ইইউ কর্মকর্তারা৷
ছবি: Shaun Dunphy / CC BY-SA 2.0
সেবা আমদানি-রপ্তানি
ইইউ ২১৯ দশমিক ৩ বিলিয়ন ইউরোর সেবা আমদানি এবং ২১৮ বিলিয়ন ইউরোর পণ্য রপ্তানি করে৷ এসব সেবার আওতায় রয়েছে দক্ষ ব্যবস্থাপনা সেবা, ইন্টেকলেকচুয়েল প্রোপার্টি, পর্যটন এবং শিক্ষা৷ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আন্তঃলেনদেনের মাধ্যমে অ্যামেরিকা-ইইউ-এর মোট বাণিজ্যের এক তৃতীয়াংশ হয়ে থাকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
6 ছবি1 | 6
রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার একমাস পর ইউরোপের নেতারা আবার তাদের সার্বভৌমত্বের কথা বলেন। তারা প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ইইউ-র শক্তি বাড়াবার কথা বলেন। ন্যাটোর দায়বদ্ধতা মেনে নিয়ে এই কাজ করার কথা বলেন।
জার্মান কাউন্সিল অফ ফরেন রিলেশনসের গবেষক বেঞ্জামিন তালিস বলেছেন, ''মাক্রোঁ যে পথের কথা বলেছেন তা বাস্তসম্মত নয়। এই যে সার্বভৌমত্বের কথা বলা হচ্ছে, তা মিথ ছাড়া আর কিছুই নয়। তার মতে মাক্রোঁ অ্যামেরিকার থেকে আরো স্বশাসন চেয়েছেন।''
তার মতে, ''নিজেকে রক্ষা করার ক্ষমতা ইউরোপের নেই। ইউরোপের হাতে আধুনিক কামান আছে, সেনা আছে, কিন্তু তাও তারা অ্যামেরিকার উপর নির্ভরশীল। অ্যামেরিকার পরমাণু অস্ত্রসম্ভার তাদের সুরক্ষা দেয়।''
ইউরোপের ভিতর বিরোধ
পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি ইউরোপ গিয়ে বলেছেন, অ্যামেরিকার সঙ্গে জোট হলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভিত্তি।
তালিস মনে করেন, ''মাক্রোঁও গোটা ইউরোপের হয়ে কথা বলেননি। জার্মান চ্যান্সেলর শলৎস তো রাশিয়া-ইউকত্রেন সংঘাতের আগের পরিস্থিতিতে ফিরতে চান। আর মাক্রোঁ চান, ফ্রান্সকে বড় শক্তি বানাতে।'' তালিসের দাবি, ''মাক্রোঁর এই দাবি, ইউরোপের দেশগুলির মধ্যে বিভেদ বাড়াতে পারে।''
বিশেষজ্ঞদের মতে, মাত্রোঁ যা বলছেন, তা হওয়ার সম্ভাবনা কম। মাক্রোঁ শুধু এটা বলতে পারেন, 'আমি স্বপ্ন দেখি'। তবে তার স্বপ্ন সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম।